somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শার্ল বোদলেয়ার: অশুভ পুষ্পের উপাসক

৩০ শে জুন, ২০০৯ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬২ ) : ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি, সমালোচক ও অনুবাদক। ছিলেন ভীষন আঙ্গিক সচেতন ; এ বিষয়ে ধ্রুপদী বোধ ছিল তাঁর । যথাযথ শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে ছিল অসামান্য দখল। সাংগীতিক ভাষায় লেখার দৈবশক্তি ছিল ইর্ষনীয়। ফরাসি ভাষায় বেশ কিছু নিষ্ঠুর কিন্তু মনোরম কবিতা লিখে চিরস্মরনীয় হয়ে রয়েছেন বোদলেয়ার; তিনি এতই মৌলিক ছিলেন যে- তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন অতুলনীয় বা বলা যায় অদ্বিতীয়। তাঁর কাব্যকে বলা হয় রোম্যান্টিকতাবাদের সর্বশেষ সারৎসার। শার্ল বোদলেয়ারই প্রতীকবাদের অগ্রদূত, আধুনিক কাব্যকৌশলের প্রথম নির্মাতা। তাঁর মতে মানুষ এক মিশ্র প্রাণি। মানুষের চরিত্র যুগপৎ ঈশ্বর ও শয়তানের বৈশিষ্ট্যসম্বলিত। পাপ ও পুন্যের চিরায়ত বিষয়টি নিয়ে তাঁর কবিতা জর্জরিত। তাঁর কাব্যে ও ব্যাক্তিগত জীবনে মানবীয় অভিজ্ঞতার মহৎ ও নীচ- সব ধরনের পরিস্থিতিই লক্ষ করা যায়। বোদলেয়ার-এর তিনটি উদ্ধৃতি পাঠ করা যাক:

১/ পুরুষের হৃদয়ে থাকে বেশ্যা সম্ভোগের এক প্রবল বাসনা -যা তাকে এক ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতার বোধ এনে দেয়; সে বাধ্য হয় দ্বৈতজীবন যাপন করতে । এই ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতার বোধ থেকেই পুরুষের নারীমাংশে বিলীন হওয়ার বাসনা জাগে... ভদ্রলোকে যাকে বলে: প্রেমতৃষ্ণা। প্রতিভাবান পুরুষ অবশ্য এই উভয়সঙ্কট থেকে মুক্ত-সে একাকী জীবনযাপন করতে পারে।

২/ যৌনতা দমন করতে না পেরে গির্জে মানুষের দেহমনকে ‘জীবাণুমুক্ত’ করার জন্য সৃষ্টি করেছে বিবাহপদ্ধতি।

৩/ যতই মানুষ শিল্পেরচর্চা করে-তার প্রবৃত্তি থেকে বর্বরতা কমে যেতে থাকে; কেবল স্থূল ও রুক্ষরাই যৌনক্রিয়ায় সফল; যে কারণে রতিক্রিয়াই জনতার অন্যতম লক্ষ .... জনতা একে অন্যের ভিতরে ঢোকে; অপরদিকে শিল্পী নিজের থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না!
এই হলো শার্ল বোদলেয়ার: উনিশ শতকেই যিনি বিংশ শতাব্দীর নেতিবাচক ভাবনার জীবাণু বহন করেছিলেন ।
সবার আগেই টের পেয়েছিলেন আধুনিক মানুষের দুঃস্থ মনের সঙ্কেতটি । টের পেয়েছিলেন প্রবৃত্তি সমাজ আর প্রকৃতির রোষানলে পড়ে মানুষ হয়ে উঠেছে এক অসহায় প্রাণি। এসব ভাবনায় বিপর্যস্ত হয়েই, ১৮৬২ সালে ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং স্বাস্থ্য পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়তে থাকে। ১৮৬৩ সালে তিনি শিল্পসাহিত্য বিষয়ে লেকচার দানের জন্য প্যারিস ছেড়ে চলে যান ব্রাসেলস এ। ওখানেই স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের ফলে শরীরের একাংশ যায় অবশ হয়ে । তারপর বেশি দিন আর বাঁচেননি বোদলেয়ার; ১৮৬৭ সালে ৩১ আগস্ট, ৪৬ বছর বয়েসে মারা যান প্যারিসে । দীর্ঘকাল আগেই সিফিলিস হয়েছিল। সেটিই মৃত্যুর অন্যতম কারণ ...। বোদলেয়ার-এর মৃত্যুর পর কবি স্তেফান মার্লামে, পল ভারলেইন, আর্তুর র‌্যাবো প্রমূখ স্বীকার করলেন: বোদলেয়ার ছিলেন আমাদের প্রথপদর্শক । কুড়ি শতকে জাঁ পল সার্ত্রে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, রবার্ট লোয়েল-এমন কী কবি সিমাস হিনি অবধি আধুনিক শিল্পজগতে বোদলেয়ার-এর ভূমিকার অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন।
তো, বোদলেয়ার কি ভাবতেন নিজের সম্বন্ধে?
একটি কবিতায় (সৌন্দর্য) বোদলেয়ার নিজের সম্বন্ধে বলেছেন-

একটি পাথরের স্বপ্ন? হ্যাঁ, আমায় সেরকমও ভেবে নিতে পার:
আমার বুক, যেখানের মরণশীলেরা এসে কাঁদে,
কবিদের চঞ্চল হৃদয়ে তৈরি,
পদার্থের মতন মৌন ও মহৎ।
আমার মাংশ তুষার; হৃদয় বরফ
উঁচুতে বসে আমি ছদ্মবেশহীন স্ফিনিক্স
ইর্ষায় বেদির উত্তোরণ
কখনও আমি কাঁদিনি কি হাসিনি।
তন্ময় বিস্ময়ে কবির বিস্তার
আমার ব্যাপক অবস্থানের সামনে
গর্বিত মঞ্চের দিশারী
পোষা প্রেমিকের বশ্যতায় নই গাথা
আমি নিখুঁত আয়নায় বিশ্বকে জমিয়ে দিই
আমার আয়তচোখের কালহীন আলোয়।



বোদলেয়ার ম্রিয়মান কবিতার জনক ঠিকই-তবে প্যারিসে কবির শৈশব জীবনটা শুরুটা মন্দ হয়নি; বাবা, জোসেফ ফ্রানকোইস বোদলেয়ার; প্রথম জীবনে ছিলেন যাজক। ১৭৯৩ সালে ‘পবিত্র বর্গ’ ছেড়ে সরকারি চাকরি গ্রহন করেন। বিপতিœক ছিলেন জোসেফ ফ্রানকোইস বোদলেয়ার । তিরিশ বছরের ছোট ক্যারোলিন ডিফাইসকে বিয়ে করে প্যারিসে বাস করতে থাকলেন। ক্যারোলিন ডিফাইস ছিলেন অনাথ। অনাথ হলেও সুন্দরী। ১৮২১ সালের ৯ এপ্রিল; ক্যারোলিন ডিফাইস এক ছেলে হয়। ছেলের জন্মের পর ক্যারোলিন ডিফাইস কি ভাবতে পেরেছিলেন যে এই ছেলে একদিন “অশুভ ফুল” (Les Fleurs du mal) নামে বিতর্কিত কবিতার বই লিখে একদিন ফরাসি তথা ইউরোপীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে?। যা হোক। ক্যারোলিন ডিফাইস -এর স্বামী জোসেফ ফ্রানকোইস বোদলেয়ার টুকটাক কবিতা লিখতেন, ছবিও আঁকতেন। ছেলের স্বভাবে সুন্দরের প্রতি মোহ সম্ভবত তিনিই প্রোথিত করে থাকবেন।
কোনও কোনও মৃত্যু মানুষের সংসারে সমস্ত সুখ ও স্বাচ্ছন্দ কেড়ে নেয়। জোসেফ ফ্রানকোইস বোদলেয়ার মারা গেলেন।
বোদলেয়ার -এর বয়স তখন মাত্র ছ বছর। বোদলেয়ার এর জীবনে বিশাল বাঁক নিতে শুরু করল। খরচ কমাতে ক্যারোলিন ডিফাইস ছেলেকে নিয়ে প্যারিসের বাইরে চলে গেলেন । বাবার শোক ভুলে থাকতে বোদলেয়ার মাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচল। মাকে বড় ভালো লাগত। বোদলেয়ার ছিল ড্যান্ডি। মানে, যে শারিরিক সৌন্দর্যে কাতর। ক্যারোলিন ডিফাইস ছিলেন সুন্দরী; বোদলেয়ার তাঁর একটা কবিতায় লিখেছিলেন

অনেক অনেকক্ষণ ধরে তোমার চুলের গন্ধ
টেনে নিতে দাও আমার নিশ্বাসের সঙ্গে;
আমার সমস্ত মুখ ডুবিয়ে রাখতে দাও তার গভীরতায়
ঝর্নার জলে তৃষ্ণার্তের মত;

অনুবাদ: বুদ্ধদেব বসু

অবশ্য বাস্তববাদী ক্যারোলিন ডিফাইস ভাবলেন অন্যরকম। ছেলে আর কত দিন ...বড় হলে নিজের জগতে চলে যাবে...নিজের জীবন আছে না? অনাথ ছিলেন। দারিদ্র কি জিনিস বোঝেন। ক্যারোলিন ডিফাইস এসব ভেবে বিয়ের কথা ভাবছিলেন। পেলেও গেলেন পাত্র- ফরাসি সৈন্যবাহিনীর একজন মেজর; মেজর জ্যাক আউপিক।
মায়ের বিয়ের কথা শুনে বালক বোদলেয়ার এর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তার ভীষন মন খারপ হয়ে যায়। সে এক গভীর অন্ধকার অস্বস্তির মধ্যে ডুবে যায়। যে আঘাত সে কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
বিয়ের পর মেজর জ্যাক আউপিক তার পরিবার নিয়ে ফ্রান্সের লিয়ন এ চলে আসেন।
বোদলেয়ারকে বোর্ডি স্কুলে ভরতি করে দিলেন। ভালো লাগে না। মাকে দেখতে পায় না। ছুটিতেও বাড়ি যেতে পারে না। সৎপিতা ভয়ানক কড়া। কাজেই ফল খারাপ হতে লাগল। সেই অজুহাতে সৎপিতা ছুটিতেও বাড়ি যেতে দেয়না। বালক বোদলেয়ার মাকে দেখতে পায় না। বালকের কান্না টের পায় না কেউই ... সে এক গভীর অন্ধকার অস্বস্তি তে ডুবে যেতে থাকে। বিষন্নতা কাটা তে বই পড়ত খুব। লেখার ইচ্ছে মনে তখনই গেঁথে গিয়েছিল। বোডিং স্কুলে ভালো ইংরেজি শিখছিল। পরে মার্কিন লেখক এগডার অ্যালান পো-র লেখা ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ছবি, মানে, চিত্রকলায় ওই বয়েসেই যথেস্ট আগ্রহ গড়ে উঠেছিল।
সব মিলিয়ে স্পর্শকাতর স্নিগ্ধ এক কিশোর।
স্কুলের বন্ধুরা পরে বলেছিল, বোদলেয়ার ছিল আমাদের চেয়ে আলাদা। ভীষন সফিসটিকেটেড। উৎকৃষ্টমানের সাহিত্যের বই পড়ত।
যা হোক। কিশোর বোদলেয়ার লেখক হতে চায়। তবে তাঁর সৎ পিতা মেজর জ্যাক আউপিক চান সুশৃঙ্খল এক জীবন। তো, একটাই জীবন ...একে তাড়িয়ে তাড়িয়ে চাখতে হবে-কিশোর ভাবে। অত হিসেবী হলে চলে?
স্কুল শেষ হল না। সামান্য কী এক অপরাধে বহিস্কৃত হল বোদলেয়ার। সে তখন তরুণ। সৎপিতা অইন পড়তে বললেন। কে পড়ে আইন? তত দিনে পেয়ে বসেছে কবিতা। আর, প্যারিস শহরটা টানছিল খুব।
তরুণ কবি প্যারিস চলে এলেন।
উঠলেন প্যারিসের লাতিন কোয়াটারের এক মৃয়মান ফ্ল্যাটবাড়িতে। এরপর শুরু হল উদ্দাম জীবন। প্যারিসের বোহিমিয়ান শিল্পীদের সঙ্গে শুরু হল মেলামেশা। সেই সঙ্গে নানাধরনের নেশাভাঙ্গ। বিশেষ করে লাউডানাম; এটি আফিম থেকে তৈরি।
নেশাভাঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে চলছিল বেশ্যা-সংসর্গ।
তৎকালে আপোলোনিয়ে সাবাতিয়ের ছিল একজন প্রখ্যাত রক্ষিতা- প্যারিসের শিল্পীদের মিউজ বা দেবী। এক শিল্পীবন্ধু এক সন্ধ্যায় সেই প্রখ্যাত রক্ষিতার বাড়ি নিয়ে গেল। আপোলোনিয়ে সাবাতিয়ের বোদলেয়ারের চোখের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল। মনে মনে বলল, ওহে, কৌতূহলী যুবক। আমি তোমাকে জীবনের উষ্ণতম একটি দিক দেখাব।
দু’- বছরের মতো লাতিন কোয়াটারে কাটল। নেশা করেন আর যাই করেন, এরই মধ্যে প্রচুর লিখলেন। অজস্র পড়লেন। কিছু কিছু লেখা ছাপাও হল। হৃদয়ে তীব্র ইচ্ছে -লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ...অত সহজ? বরং, ঋনগ্রস্থ হলেন। বেশ্যাগমন তো চলছিলই। সেই সঙ্গে আপোলোনিয়ে সাবাতিয়ের -এর ফ্ল্যাটে আড্ডা।
ওই সময়েই সিফিলিস আক্রান্ত হয়েছিলেন বোদয়োর-পরে যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জীবন অসহ্য ঠেকছিল সম্ভবত; সুখস্বপ্নের জগতটা সরে গেছে। বাবা মরে গেল। মা তো-পরের ঘরে ...এসব মিলিয়ে বিতৃষ্ণা- ৩ কবিতায় লিখেছেন-

আমি যেন রাজা, যার সারা দেশ বৃষ্টিতে মলিন,
ধনবান, নষ্টশক্তি,যুবা, তবু অতীব প্রবীণ,
শিক্ষকের নমস্কার প্রত্যেহ যে দূরে ঠেলে রেখে
শিকারি কুকুর নিয়ে ক্লান্ত করে নিজেই নিজেকেই
কিছুই দেয় না সুখ-না মৃগয়া, না শ্যেনচালন,
না তার অলিন্দতলে মৃতপায় তারই প্রজাগন!
মনঃপূত বিদূষক প্রহসনে যত গান গাঁথে
আনত ললাট থেকে রোগচ্ছায়া পারে না সরাতে;
ফুলচিহ্ন আঁকা তার শয্যা, তাও নেয় রুপান্তর
কবরে, এবং যার সাধনায় রাজারা সুন্দর,
জানে না সে-মেয়েরাও, লজ্জাহীন কোন প্রসাধনে
আমোদ ফোটানো যায় এ-তরুণ কঙ্কালের মনে।
করেন কাঞ্চনসৃষ্টি, সে-মুনিরও মেলেনি সন্ধান
কোন বিষময় দ্রব্যে অহোরাত্রি নষ্ট তার প্রাণ।
এমন কী রক্তস্নান, লিপ্ত যাতে সব ইতিহাস,
পুরাতনী রোমকের, অর্বাচীন দস্যুর বিলাস,
তাও এই মূঢ় শবে তাপলেপ পারে না জোগাতে,
লিথির সবুজ স্রোত-রক্ত নয়-বহে যে শিরাতে।

অনুবাদ: বুদ্ধদেব বসু

১৮৪১ সাল। বোদলেয়ার এর বোহেমিয়ান জীবন সৎপিতা মেজর জ্যাক আউপিক কে ভীষনই ক্ষেপিয়ে দিল। তিনি প্রখর নিয়মশৃঙ্খলায় বিশ্বাসী এক রীতিনিষ্ট মানুষ- আদপেই বাউন্ডেলেপনা সহ্য করতে পারেন না। কী করা যায় ভাবলেন। ততদিনে তিনি বেশ ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন-তাঁর বেশ জানাশোনা ছিল। তিনি বোদলেয়ারকে ভারতে পাঠিয়ে দেবেন বলে মনস্থ করলেন। ভারতের কোথায়? কলকাতায়। চেনাশোনা এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথাও বললেন এ বিষয়ে।
কাজেই, বোদলেয়ার কে জাহাজে উঠতে হল।
হয়তো এক ধরনের কৌতূহল ছিল। জাহাজে উঠে সমুদ্রবিষয়ক কবিতা লিখলেন-

যখন ফুলে ওঠে আঁচলে ঢেউ তুলে হাওয়ার অভিমান
তখন মানি তোরে সুতনু তরণীর সাগর-অভিযান।
তেমনি চঞ্চল, উত্তাল,
শিথিল, মন্থর ছন্দে হেলে-দুলে ছড়িয়ে দিলি পাল।

(অনুবাদ: বুদ্ধদেব বসু)

পরে জাহাজের ক্যাপ্টেইনকে বুঝিয়ে বোদলেয়ার বললেন যে, দেখুন আমার এইসব নিয়মমাফিক জীবনযাপন ভালো লাগে না। আমি লিখতে চাই। আর, একটাই জীবন যখন ...একে ...একে তাড়িয়ে তাড়িয়ে চাখাই ভালো। অত হিসেবী হলে চলে, বলুন?
জাহাজের ক্যাপ্টেইন যা বোঝার বুঝলেন।
প্যারিস ফিরে এলেন বোদলেয়ার; সময়টা ১৮৪২ সাল।
প্রথমেই গেলেন আপোলোনিয়ে সাবাতিয়ের-এর বাড়ি । ওখানে নাদার বসে ছিল। নাদার-এর আসল নাম ফেলিক্স টোরনাচন। বিজ্ঞানী। ফটোগ্রাফার। বোদলেয়ার নাদারকে খুব পছন্দ করতেন। বলতেন, আশ্চর্য তার প্রাণশক্তি। নাদারের সঙ্গে একটি মেয়েও ছিল। ছিমছাম, শ্যামলা; আর সুন্দরী। বোদলেয়ার তো অবাক। কে এ? নাদার পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, এর নাম জান দিভাল। হাইতির মেয়ে।
ও।
বোদলেয়ার জানেন, হাইতি ক্যারবিয় সমুদ্রের একটা দ্বীপদেশ।
যা হোক। পরে জানা গেল জান দিভাল এর জন্ম ১৮২০ সালে। রক্তে ফ্রেঞ্চ ও কৃষ্ণ-আমেরিকিয় মিশ্রণ। ক্যারিয়ারের টানেই প্যারিস এসেছে জান দিভাল । অভিনয় ও নাচের প্রতিভা রয়েছে। পরবর্তী ২০ বছর বোদলেয়ার-এর সঙ্গে জান দিভাল-এর সম্পর্ক ছিল। বোদলেয়ার-এর জীবনে মায়ের পরে জান দিভাল এর গুরুত্ব।
যা হোক। প্যারিস ফিরে বোদলেয়ার উত্তরাধিকাসূত্রে ধনসম্পদ পেলেন। শুরু হল বিলাসী জীবনযাপন। দামী দামী পোষাক কিনতে লাগলেন। প্যারিসের ক্যাফেতে আর আর্ট গ্যালারিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ... সঙ্গে জান দিভালের । সেই সঙ্গে চলছিল প্রচুর আফিম সেবন।
শীঘিই্র টাকাপয়সা সব ফুরিয়ে গেল।
অর্থ উপার্যনের জন্য সমালোচনামূলক গ্রন্থ লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রথম সাহিত্য সমালোচনা Les salons (1845-1846); এটি সমকালীন চিত্রকরদের ওপর আলোচনা; যেমন Honoré Daumier, Édouard Manet, and Eugène Delacroix. আর অ্যাগডার অ্যালান পোর অনুবাদ করছিলেন । পো-র প্রতি গভীর অনুরাগ বোধ করতেন বোদলেয়ার; বলতেন, পো- হচ্ছে দ্বৈত আত্মা । ১৮৫৭ সাল অবধি পো-র অনুবাদ করেন। । তাঁর অনুবাদগুলি ফরাসী পাঠকসমাজে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছিল।
১৮৪৭ সালে একখানি আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখে ফেললেন। লা ফানফারলো।
১৮৫৭ সালে বেরয় কবিতার সঙ্কলন “অশুভ ফুল” বা “অশিব পুষ্প”-র (দি ফ্লাওয়ার্স অভ ইভিল) প্রথম সংস্করণ। বইটির ছাপার মান নিয়ে বোদলেয়ার এতই খুঁতখুতে ছিলেন যে প্রেসের কাছেই একটি রুম ভাড়া করলেন থাকার জন্য। উত্তেজনাকর দিনগুলি কাটছিল। জান দিভাল আসতেন। আসতেন নাদার। ও অন্যান্য শিল্পীরা।
অশিব পুস্পের ৬টি কবিতা লেসবিয়ান প্রেম ও ভ্যাম্পায়ার সংক্রান্ত ছিল বলেই ফ্রান্সের মিনিস্ট্রি অভ ইনটেরিওর এর পাবলিক সেফটি সেকসন অশ্লীলতার অজুহাতে বইটি ব্যান করল। প্যারিসের অগ্রসর শিল্পীসমাজ তীব্র প্রতিবাদ ফেটে পড়ল। দুঃসময়ে তারা বোদলেয়ারের পাশে ছিলেন।
যা হোক। ১৯৪৯ সালের এর আগে অশিব পুস্পের ওপর থেকে ব্যান তুলে নেয়নি ফরাসি সরকার!
১৮৬১ সালে অশিব পুস্পে আরও ৩৫টি নতুন কবিতা যুক্ত করেন বোদলেয়ার । বইটি বোদলেয়ারকে খ্যাতি ও অখ্যাতি দুইই দিয়েছিল। গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, ভিক্তর হুগো বইটির প্রশংসা করেছিলেন। ফ্লবেয়ার লিখলেন, ""You have found a way to inject new life into Romanticism. You are unlike anyone else [which is the most important quality]." আসলে বোদলেয়ার তাঁর শিল্পের প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নাগরিক জীবন । প্রায়ই বলতেন, ... art must create beauty from even the most depraved or "non-poetic" situations.
এভাবে আধুনিক শিল্পের ভিতটি স্থাপিত হয়ে গেল।
‘অশিব পুষ্প’ তে যৌনতা ও নাগরিক সৌন্দর্যর প্রাচুর্য থাকায় বোদলেয়ারকে বলা হল অভিশপ্ত কবি। সেই সঙ্গে যুক্ত হল বোদলেয়ার সম্বন্ধীয় যাবতীয় উৎকেন্দ্রীকতা। একবার নাকি কথাবার্তার ফাঁকেই সবার সমানেই এক বন্ধুকে বোদলেয়ার বলে বসলেন, এক সঙ্গে গোছল করলে কেমন হয়? এরকম অনেক গল্পছড়িয়ে আছে। কোন্ টা সত্য আর কোন্ টা মিথ্যা কে বলতে পারে?
১৮৬০। সব ধরনের লেখা লিখছিলেন। প্রবন্ধনিবন্ধ। ছন্দবিহীন গদ্য কবিতাও লিখলেন। নাম দিলেন, “গদ্যে ছোট কবিতা।” মনে রাখতে হবে বোদলেয়ারই প্রথম গদ্য কবিতা লিখে কবিতার দীর্ঘকালীন আঙ্গিকটি ভেঙ্গেছিলেন । অন্যকথায় বোদলেয়ার আধুনিক গদ্য কবিতার জনক।
সেই সঙ্গে চলছিল নেশাভাঙ্গ। আর, অবাধ বেশ্যাচারিতা। রক্ষিতা আপোলোনিয়ে সাবাতিয়ের-এর বাড়িতে আদিম আড্ডা তো ছিলই। জান দিভালের সঙ্গে ‘লিভিং টুগেদার’। বোদলেয়ার ছাড়াও জান দিভাল অবশ্য প্যারিসের বোহিমিয়ান শিল্পীদের সঙ্গে অবাধে মিশতেন। চিত্রকরেরা তার ছবি আঁকত। অত্যন্ত বেপরোয়া জীবনযাপন করতেন জান দিভাল, ভীষন নেশা করতেন ।
অর্থকষ্ট, নেশা-শরীর ক্ষয়ে আসছিল। মধ্য-চল্লিশেই কী রকম বুড়িয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন ধরে লাউডানাম (আফিম থেকে তৈরি সেই নেশারু তরল) সেবন করছেন। তাতেই তাঁর জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে নিভে আসছিল।
বোদলেয়ারের মা ক্যারোলিন ডিফাইস এবার ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন। কিছুদিনের জন্য ছেলের সঙ্গে সমুদ্রতীরের হ্যানফ্লেয়ুর শহরে ভাড়া বাড়িতে একসঙ্গে থাকতে রাজি হলেন । বোদলেয়ার আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলেন। “লা ভয়েজ” নামে কবিতা লেখায় হাত দিলেন। আর খুব গান শুনতেন। জার্মান কম্পোজার রিচার্ড ভাগনার এর অনুরাগী হয়ে উঠলেন।
সুখ অবশ্য কপালে দীর্ঘকাল সইলনা।
১৮৬১ সালে বোদলেয়ারের প্রকাশক (পওলে মালাসিস) দেউলিয়া হয়ে গেলেন।
অর্থকষ্ট চরমে উঠল। মরিয়া হয়ে এখানে-ওখানে শিল্পসাহিত্য বিষয়ক লেকচার দিয়ে অর্থ উপার্যন করতে লাগলেন বোদলেয়ার। ১৮৬৪ সালে সেজন্যই বেলজিয়াম গেলেন। ওখানেই স্ট্রোক করলেন।
তারপর জীবনের শেষ দুটো বছর কাটল দুঃসহ অবস্থায় অবশ শরীর নিয়ে। জান দিভাল পাশে ছিলেন না। কারণ, ১৮৬২ সালে জান দিভাল মারা যান । মৃত্যুর কারণ সিফিলিস।
৩১ আগস্ট ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ; শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বোদলেয়ার।
প্যারিসের একটি সেমিট্রিতে কবিকে সমাহিত করা হয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১:২২
৩৪টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×