১৬ জানুয়ারী ২০১৮ প্রকাশিত : একটি খবরের অংশ বিশেষ -
রাজন ভট্টাচার্যে র করা খবরে বলা হয় - মাগুরার রাঘবদাইড় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী মিনু খাতুন। পরীক্ষা শেষে রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে চলন্ত ট্রাকের চালক মিনুর চুল ধরে টান দেয়! এতে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। মুহূর্তের মধ্যে নিভে যায় একটি তাজা প্রাণ।
জানা গেছে, ঘটনার পর মামলা হলেও চালক এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে! তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন হলো এই হত্যাকা-ের বিচার আদৌ হবে কিনা। কতদিনই বা অপেক্ষা করতে হবে বিচারের। পরিসংখ্যান বলছে, পথচারী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৪২ ভাগের বেশি পথচারী! যা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আশাবাদী হওয়ার কোন খবর নেই। দুর্ঘটনা রোধে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জও নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২২ ভাগ পর্যন্ত।
আমাদের দেশে গাড়ি দুর্ঘটনার হার বিশ্বের সর্বোচ্চ। যেখানে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে মৃত্যুহার সিঙ্গাপুরে ৮ দশমিক ৩, নিউজিল্যান্ডে ৪ ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩ দশমিক ৪– সেখানে ইউনিসেফের তথ্যমতে– বাংলাদেশে এ হার ১৬৯ জন।
২০১০ জানুয়ারি থেকে ২০১১ র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যার শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৩৬৫ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৪৫ জন, যাদের অনেকেই হয়েছেন পঙ্গু। আর্থিকভাবেও পর্যুদস্ত হয়েছেন পথ-দুর্ঘটনার শিকার প্রায় ১২ হাজার পরিবার। এ সংখ্যাটি মোট পথ-দুর্ঘটনার অর্ধেকেরও কম। কারণ সব দুর্ঘটনা থানায় রেকর্ড হয় না।
২০১৭ সালে দুর্ঘটনায় ৭৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত
সূত্র: বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি
‘বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬ (বিএইচআইএস)' শিরোনামে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়৷ প্রকল্পের পরিচালক ফারুক আহমেদ ভুইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা দুর্ঘটনায় এবং আঘাতে মৃত্যু নিয়ে এই জরিপ চালিয়েছি৷ তাতে দেখা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ১৬৬ জন নিহত হন৷ আর তাতে প্রতিদিন গড়ে নিহতের সংখ্যা ৬৪ জন৷'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সড়ক দুর্ঘনায় প্রতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি'র ২ শতাংশ ক্ষতি হয়৷ বাংলাদেশের জিডিপি ১৭ লাখ কোটি টাকা৷ তার ২ শতাংশের পরিমান ৩৪ হাজার কোটি টাকা৷ তবে এই ক্ষতি বাস্তবে আরো বেশি৷
এই জটিল কঠিন পরিসংখ্যান, বাস্তবতা এবং এমন এক সময়ে সরকার এ আইনের খসড়া অনুমোদন করল, যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য দায়ী চালকের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন করছে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মূখে যেখানে বারবার সরকার পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখেই নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে/হবে। কিন্তু আজ মন্ত্রী সভায় সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার যা কেবলই পরিবহন শ্রমিক-মালিকের স্বার্থ সুরিক্ষত হয়েছে। সেখানে
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রেখে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘সম্পূরক এজেন্ডা’ হিসেবে এ অইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
সুত্র: দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সর্বোচ্চ সাজা হবে ৫ বছর জেল বিডিনিউজ২৪ডটকম
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “মোটরযান দুর্ঘটনায় আহত বা প্রাণহানি হলে পেনাল কোড অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
“তবে শর্ত থাকে যে, পেনাল কোডে যা কিছু থাকুক না কেন অবহেলাজনিত কারণে গুরুতরভাবে আহত বা প্রাণহানি হলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
এ সংক্রান্ত আইনে আগে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বা প্রাণহানির জন্য সর্বোচ্চ সাজা ছিল তিন বছরের কারাদণ্ড।
“এখন সব শ্রেণির সর্বসম্মত মত অনুযায়ী পাঁচ বছর করা হয়েছে, অর্থদণ্ডের বিষয়ে লিমিট দেওয়া নেই।”
সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে বলেন, তদন্তে দুর্ঘটনা যদি উদ্দেশ্যমূলক হিসেবে প্রমাণিত হয় তাহলে তা দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় (হত্যা, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড) যাবে। আর চালকের কারণে প্রাণহানি হয়ে থাকলে ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী সাজা দেওয়া হবে। তদন্ত কর্মকর্তাই ঠিক করবেন- অপরাধ কোন ধারায় যাবে।
এ যেন পর্বতের মুসিক প্রসব। সাধারন মানুষের জীবন এখানে পুরোই মুল্যহীন প্রতিভাত। সর্বসাধারনের দীর্ঘদিনের দাবী দাওয়া পুরোই উপেক্ষিত হল । পরিবহন মালিক শ্রমিকরা সুযোগ পেল আরো বেপরোয়া হবার! একটা প্রাণের হত্যার শাস্তি মাত্র ৫ বছর! পরিবহন সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে গেল কোটি কোটি মানুষের জীবন। এ যেন সেই ব্রিটিশ আইনের ভূতই নতুন নামে সাওয়ার হলো আমজনতার কাঁধে। ব্রিটিশরা নিজেদের প্রভু জ্ঞানে আর নেটিভদের কিড়ে মাকোড়া জ্ঞানেই আইন প্রণয়ন করে। ফলে তাদের আইনে আমজনতার মানবিকতার বিষয় বরাবরই উপেক্ষিত। চালক বা তাদের অনুগত পোষ্যদের বাঁচানোর জন্যেই আইনের ফাক ফোকর রাখা হয়েছে।
১৮৬০ সালে লর্ড মেকলে দণ্ডবিধি বা পেনাল কোডের মাধ্যমে অধিকাংশ অপরাধ ও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে বেশিরভাগ অপরাধের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির বিবেচনা থাকলেও, সাহেব বাবুদের গাড়ি চালানোর ফলে পথ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কারও মৃত্যু হলে বা বেপরোয়া চালনার ফলে কারও ক্ষতি বা জখম হলে তার জন্য লঘুদণ্ডের বিধান করা হয়েছিল।
কারণ সে সময় যাদের গাড়ি ছিল এবং যারা গাড়িচালনা করতেন তারা সবাই না হলেও, তাদের ৯০ শতাংশই ছিলেন ইংরেজ বেনিয়া বা তাদের অনুগত। ফলে শ্রেণিস্বার্থে ইংরেজরা দণ্ডবিধিতে পথ-দুর্ঘটনার শাস্তি নাম মাত্র করেছিল।
দণ্ডবিধি বা পেনাল কোডের ৩০৪-খ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জনপথে যান বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২৭৯ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি জনপথে এমন বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কোনো যান চালায় বা অশ্বারোহণ করে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, অন্য কোনো ব্যক্তিকে আহত বা জখম করার আশঙ্কা থাকে, তিনি তিন বছর কারাদণ্ড বা এক থেকে তিন হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩৩৮-ক ধারায় বলা আছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে গণপথে গাড়ি বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তিকে গুরুতর আঘাত করেন, যাতে মনুষ্যজীবন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্ন হয়, সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২৮০ ধারায় বেপোরোয়া নৌ-চালনার শাস্তির কথা বলা রয়েছে। হত্যার মতো ঘটনা থাকার পরও এই সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কিত বিধি তিনটির কোথাও অধিক কারাবাস নেই; এমনকি যে কারাবাসের কথা বলা আছে তাও বিনাশ্রম!
উল্লিখিত তিনটি অপরাধই জামিনযোগ্য করে অপরাধীদের মুক্তির পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ সে যুগে বিচারক এবং অপরাধী উভয়েই ছিলেন প্রায় একই শ্রেণী স্বার্থভূক্ত প্রভুশ্রেণির অনুগত। নিজেদের রক্ষার জন্য সেদিনের প্রণীত আইন আজকের যুগে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে অচল। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানই সকলকে সমান বলে ঘোষনা করেছে। এখানে রাজা প্রজা স্বত্ত্ব আইন অচল।
সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এ ধরনের একদেশদর্শী, একপেশে অকার্যকর অহিতকর আইনই সামান্য অনুবাদ করে বা উনিশ-বিশ করে সমাজে আজও বিদ্যমান। আমাদের এ ভূখণ্ডে দুর্ঘটনার আইনের প্রতি অবজ্ঞা তাই আসলে শুরু থেকেই ছিল। কারণ আইনগুলোর সুদ ও আসল কিছুই নেই। সাজার দিক থেকেও হালকা-পলকা এবং প্রকৃতির দিক থেকে জামিনযোগ্য। তাছাড়া ওই বিধি তিনটিতে কোনো সহযোগী অপরাধীর সাজারও ব্যবস্থা নেই।
তারই চর্বিত চর্বন পুনরাবৃত্তি দেখতে পেলাম ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ায় !
যেখানে ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হল। সাংবিধানিক মৌলিক মানবাধিকার অরক্ষিত হল। একটা সংখ্যা লঘু শ্রেণীর হাতে আরেকটা সংখ্যাগুরু শ্রেণীর জীবন হাতের মোয়া হয়ে গেল। অথচ সকলেরই দাবী ছিল দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির বিধান অন্তর্ভূক্ত করা। মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড; যাতে অনন্ত শাস্তির ভয়ে হলেও যেন তারা স্বাভাবিক সুস্থ ড্রাইভীং করে।
কিন্তু সারা দেশবাসীকে দীর্ঘদিন পরিবহন সংকটে জিম্মি করে তারা যেন নিজেদের ষোলআনার উপরে আঠার আনা বুঝে নিল!
আমজনতা তবে এখন কোথায় যাবে?
আশা করি কর্তৃপক্ষ আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করার আগে পুন:বিবেচনা করবেন। ব্রিটিশ আইনি ভুতের অনুসরনে নয় বরং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের নাগরিক অধীকারের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে এবং সকল নাগরিকের প্রতি সংবিধানের দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে এত লঘু শাস্তি না দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা রাখবেন, যাতে ১৮ কোটি মানুষ আশ্বস্ত হতে পারে- তাদের কেউ চাইলেই মেরে বিনা বিচারে পার পাবেনা।
সংকলিত।
তথ্যসূত্রে কৃতজ্ঞতা:
ডয়েচে ভেলে
বিডিনিউজ
বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:০৫