কে যে ওর নামটা স্বপন রেখেছিল কে জানে? জীবনটাই ওর স্বপ্নময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু’দণ্ড আয়েশ করে ঘুমিয়েছে কিনা ঠিক করে ও বলতে পারবে না। স্বপ্নহীন ঘুম কখনোই হয় নি। কার লেখায় যেন পড়েছিল― “প্রত্যেক মানুষ ঘুমোলে স্বপ্ন দেখে চাই দু’সেকেন্ড হোক না কেন?” কথাটা ওর জীবনে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। বিন্দু-বিসর্গও এদিক সেদিক হয় নি। কেবল ঘুমোলেই স্বপ্ন দেখে ব্যাপারটা এমন হলে ভালই হত। কিন্তু স্বপনের বেলায় ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। জাগ্রত থেকে স্বপ্ন আঁকে আরো অনেক বেশি। একটুখানি পিচ্চি ছোড়া ইয়া বড় বড় স্বপ্ন দেখে। ওর স্বপ্নের জগৎ কল্পনাকেও হার মানাবে। পাঠ্য বইতে পড়েছে―নীল আর্মস্টং চাঁদের দেশে যাবার জন্যে একটি দ্রুতগামী নভযান আবিষ্কার করেছেন। ইতোমধ্যে নাকি চাঁদের দেশ থেকে ঘুরেও এসেছেন তারা। স্বপনের এখন স্বপ্ন― যে করেই হোক চাঁদের মা বুড়ির সাথে দেখা করবেই। রাতের পর রাত চাঁদের কোলে বসে গল্প করবে দু’জন। গল্প গল্প করতে করতে যখন রাত্র গভীর হবে তখন ঘুমোতে যাবে ওরা। নানুর কাছে গল্প শুনেছে যে, চাঁদের বুড়ি নাকি দিনভর সুতো কাটে। স্বপন ভাবে এত্ত সুতো দিয়ে বুড়ি কী করে― এটা ওকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। যতক্ষণ এ প্রশ্নের উত্তর না মিলবে ততক্ষণ ওর স্বস্তি নেই। মাকে সময় পেলেই জিজ্ঞেস করে―আচ্ছা মা, চাঁদের দেশে মানুষ থাকে না? ওখানে কি ঢাকা শহরের মত দালান-কুঠা নেই? নেই দামী দামী গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি?
-কী আজে বাজে বকসিস সোনা? গল্প তো নিছক গল্পই হয়। সব গল্প সত্য হয় না। সব গল্পের মাানে হয় না। স্বপন তো নাছোড় বান্দা। একের পর এক প্রশ্ন করেই চলছে― চাঁদবুড়ি খায় কী? অমন বুড়ো বয়সে চাঁদে কী করে গেল? সে কি দেখতে চাঁদের মতই সুন্দর? ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার মা কিছু বললেন না। চুপটি মেরে বসে রইলেন। শুধু ভাবলেন স্বপন ইদানিং অমন প্রশ্ন করছে কেন? কিছু একটা হয়ে যায় নি তো! শঙ্কায় পড়লেন বৃষ্টি। স্কুলে গেলেও বন্ধুদের সাথে সেই একই গল্প। স্বপনের বন্ধুরাও ওর মত ছোট। কয়েকটা কচি দেমাগ এক সাথে হয়ে ব্যাপারটা আরো গোলমিলের হয়ে দাঁড়াল। রীতিকার মত নানুর কাছে নতুন নতুন গল্প শোনে। হা করে গিলতে থাকে স্বপন। পড়া-লেখায়ও পিছিয়ে নেই। ক্লাসের ফাস্ট বয়। দুষ্টুমিতেও সেরা। তবে মেধাবী হওয়ায় দুষ্টুমিটা ঢাকা পড়ে গেছে অবশ্য। বাড়িতে এলে এক লহমাও স্থির থাকে না। সারাক্ষণ দুষ্টুমি আর দুষ্টুমি। ছোট বোন সিনথিয়াকে চিমটি কাটবে, নানুর পিকদানী লুকিয়ে রাখবে, পান খেয়ে ঠোঁট রাঙা করতে হবে, নানুর চমশাটা পরে ডাক্তার সাজতে হবে। আরো কত কী! লিখতে গেলে দুষ্টুমির ছোটখাট একটা ফিরিস্তি হয়ে যাবে। আর কিছু না পেলে রিমোট নিয়ে টিভির সামনে বসে থাকবে সারাক্ষণ। আব্বু অফিস থেকে ফেরার আগ অবধি পুরো বাড়ি অশান্ত করে তোলে স্বপন। মাকে একদম ভয় পায় না। ফোনে আব্বুকে জানাব বলতেই পড়াশোনায় নিমগ্ন। আর আব্বু বাড়িতে এলে এমন সভ্য-ভদ্র ছেলে আর দু’টো হয় না। ও খুব অল্পতেই বেশ পড়তে পারে। আর যা পড়ে তা-ই স্বচ্ছ কাচের মত ঝকঝকে, তকতকে। একবার গো ধরল আব্বুর সাথে অফিসে যাবে। ছোট বলে কথা! বস’র অনুমতি হলে রওয়ানা দিল বাপ-বেটে দু’জন। আব্বু আজ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছেন। ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে চুটিয়ে গপ্প করছে স্বপন। দুষ্টুমি এখানেও বন্ধ নেই। কখনো মাথা বের করে বড় গাড়িটাকে দেখতে হবে, উটকো ট্রাকটাকে থুথু দিতে হবে, কখনো পেছনে কোন্ গাড়িটা চলে গেল তা দেখবার জন্যে লোকিং গ্লাসটা বাঁকা করতে হবে। এত্তসব কিন্তু আব্বুর চোখ ফাঁকি দিয়ে। আসিফ এক-আধবার শুধু ডাক দিয়েছেন―স্বপন...! সেজন্যেই কিনা অনেক্ষণ চোপচাপ থাকা গেল। আব্বুকে জমের মত ভয় করে স্বপন। আজ বড্ড জ্যাম পড়েছে রাস্তায়। পুরো রাস্তা জুড়ে গাড়ির জটলা বেঁধে আছে। না জানি বসের বকুনি শুনতে হয় আজ ছেলের সামনে। এ নিয়ে বেশ চিন্তিত আসিফ। চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ। অবশেষে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে অফিসের সামনে এসে থামল গাড়ি। ভাগ্যিস সময় মত পৌঁছুতে পেরেছে। ছেলেটাকে সঙ্গে করে এই প্রথম অফিসে। মনিটরের স্ক্রিনে স্বপনের ছবি দেখে বস কতবার বলেছেন―
ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসেন আসিফ সাহেব। কী মিষ্টি দেখতে! নাম কী ওর?
-জি স্যার, স্বপন।
-খুব ভাল নাম।
কখনোই সাহস হয় নি অফিসে ছেলেকে নিয়ে আসবে। যেই দুষ্ট কী না কী করে বসে! শেষে বদনামের শেষ থাকবে না। অনেক আগ-পিছ ভেবেই আজ নিয়ে এসেছে। এসেই বসকে পা ছুঁয়ে সালাম করল স্বপন। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। যেমন মিষ্টি চেহারা তেমনই সুন্দর ওর মুখের ভাষা।
-কী খাবে আব্বু? চিপস্, ললিপপ, চকোলেট?
-না স্যার, তার আর দরকার হবে না। গাড়িতেই কয়েক পেকেট চিপস্ খেয়েছে। চকোলেট তো পকেটেই থাকে। বলল আসিফ।
-যমিরুল! ফাহিম সাহেব ডাকলেন প্রাইভেট এসিস্টেন্ডকে।
-জী স্যার - সবগুলোই নিয়ে এসো।
-জি স্যার। এক্ষুনি আসছি। পি. এ চলে গেল। আসিফও কাজে লেগে গেল। আর স্বপন আঙ্কেলের সাথে গল্প করছে। পুরো কম্পানি ঘুরে দেখালেন ফাহিম সাহেব। দু’টো চিপস্, পাঁচটা চকোলেট, আর তিনটে ললিপপ নিয়ে হাজির পি. এ যমিরুল। অফিসের সকলেই ভাল জানল স্বপনকে। কী করে যে স্বপন এতক্ষণ নীরব ছিল আল্লাহই ভাল জানেন। একটু-আধটু দুষ্টুমি তো করবেই। এ বয়সে অতটুকুন দুষ্টুমি সবাই মেনে নেয়। একে চঞ্চচলতা বলেই উড়িয়ে দেয় সবাই। তাই দুষ্টুমি বলে উল্লেখ করা গেল না। আসিফের বস ফাহিম সাহেব আসিফের সমবয়সী। বেশিদিন হয় নি কম্পানির গরুভার তার ঘারে চেপেছে। এখনো বিয়ে করেন নি। বাচ্চা-কাচ্চা তার খুব ভাল লাগে। ছোটদের নিয়ে মেতে থাকতে বড্ড আনন্দ পান তিনি। স্বপনকে নিজের ছেলের মতই আদর করেন। এক সাথে এই প্রথম বসের সাথে লান্স করছে আসিফ। হয়তো স্বপনের সুবাদেই। বিকেল পাঁচটা নাগাদ স্বপন খুশি খুশি ফিরে এল বাড়িতে। এসে আম্মু, নানুর কাছে আঙ্কেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
-তোমার আঙ্কেলের নাম কি? বৃষ্টি জিজ্ঞেস করল।
-ফাহিম সাহেব। জান আম্মু, আঙ্কেল খুব ভাল মানুষ। ফাহিমের নামটা বৃষ্টির কানে পড়তেই ছ্যাত করে ওঠল ভেতরটা। বৃষ্টি চলে গেল প্রায় আড়াই বছর আগে। আম্মু, আম্মু! স্বপনের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল বৃষ্টি। খাবে চলো। কী হল আম্মু! আঙ্কেল কত ভাল মানুষ। তার নামটা বলতেই তুমি কেমন হয়ে গেলে। তুমি কি চেন ফাহিম আঙ্কেলকে। দেখেছ কোথায়? বল না আম্মু। -কই, না তো। কেমন দেখতে তোমার আঙ্কেল জিজ্ঞেস করতে করতে আঁচলের খুটায় অশ্রু মুছলেন বৃষ্টি। স্বপনকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে এক দৌড়ে চলে এল বাথরুমে। ঝরনা ছেড়ে অঝোর ধারায় গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলেন বৃষ্টি। এই সেই ফাহিম যার সাথে দীর্ঘ সাত সাতটা বছর নিবিড় প্রেম ছিল দু’জনের। আজ হঠাৎ ফাহিমের নামটা শুনে মূর্ছিত শোক চাগাড় দিল আরেকবার। বিধাতার খেলা। কার সাথে কার জুটি বেঁধেছেন তিনিই ভাল জানেন। প্রেম ছিল ফাহিমের সাথে আর ঘরকন্যা করছে আসিফের সাথে। সবই তার লীলা। [বৃষ্টি এটা একবারের জন্যও ভাবল না যে, তার এই প্রেম ইসলাম সমর্থন করে কী না? যেই বিধাতার ভাগ্য লিখনের কথাই বলছে সেই বিধাতার বিধান কী? ইসলামী শিক্ষা না থাকলে অবৈধ প্রেমকেই মানুষ পবিত্র প্রেম বলেই চালিয়ে দেয়।] স্বপনের একা একা খেতে একদম ভাল লাগে না। ফ্রেশ হয়ে আব্বু এলেন। নানুকে নিয়েই আজ খেয়ে নিল স্বপন। বাদ মাগরিব খানিক্ষণ পড়া-শোনা করে টিভির সামনে বসে পড়ল স্বপন। আব্বু বাড়িতে এলেও পি.সিতে অফিসের কাজ সারেন। ইংলিশ মুভি দেখতেই স্বপন বেশি পছন্দ করে। অদ্ভুদ দৃশ্য, নতুন নতুন প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের চোখ ধাঁধাঁনো আবিষ্কার দেখতেই অভ্যস্ত স্বপন। ওর চিন্তা-ধারাও ঠিক অমন। সারাক্ষণ কী যেন ভাবে। গাবেষক গবেষক ভাব। ভাবুক বললে বাহুল্য হবে না। সে থেকে বৃষ্টির কী যে হয়েছে। বেশি একটা কথা বলে না। চেখে-মুখে বিষণœতা ও হতাশার ছাপ। আসিফের অতকিছু দেখবার সময় নেই। বৃষ্টি ভালবাসার বৃষ্টিতে আসিফকে ভিজিয়ে রাখলেই খুশি। ও বাড়িতে এলেও দু’দ- অফসর থাকে না। বরঞ্চ বাড়িতে এলে আরেককাঠি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বৃষ্টির অতীত জীবনে করুণ ইতিহাস আছে এটা আসিফের আজও অজানা। আজ খুব শিগগির শুতে গেল স্বপন। বিছানায় গায় এলাতে দেরী ভাব রাজ্যে বিচরণ করতে দেরী হয় না। শুয়ে শুয়ে চাঁদের মা বুড়ির কথা ভাবছে স্বপন। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এল বুঝতে পারে নি ও। অফিসের কালিগদের স্নেহের কথা, তাদের আশির্বাদ ও বসের অভাবনীয় খুশির কথা বৃষ্টির সাথে শুতে শুতে গল্প করছে আসিফ। বৃষ্টির ভেতরে তুমুল ঝড় বইলেও স্বামীকে বিন্দুমাত্র বুঝতে দেয় না। জগদ্দল পাথর বুকে চেপে সয়ে যায় নানান কষ্ট। ভণিতা করে বৃষ্টি বলল, তাই নাকি! তোমাদের বস অন্নেক ভাল মানুষ তাই না? ফাহিম নামটাই কেমন দয়ামিশ্রিত বল। আমাদের বাবুকে এত আদর করেছে। কেউ প্রথম দেখায় এত মিশুক কী করে হয়। এমন দয়ালু মানুষ দ্বিতীয়টি পাওয়া ভার। স্বপন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। নানুর সাথে আজকে আর গল্প করা হল না। আজ নিজেই চাঁদের দেশে যাচ্ছে স্বপন। স্বপ্নে দেখছে―বাগানে ফুল গাছে পানি দিতে গেল। চকিতেই দেখতে পেল অ-নেক বড় একটা মৌমাছি। এত বড় যে, পাখা দু’টোই ওরচে’ বড়। আগ-পিছ না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ল মৌমাছির উপর। মৌমাছিটাও ওড়াল দিল অমনি। কী আশ্চর্য! মৌমাছিটার বাগডোর স্বপনের হাতে। ও যেদিকেই হাঁকাচ্ছে সেদিকেই চটজলদি ছুটে চলছে মৌমাছিটা। চাঁদের দেশে যাবার নেশায় ক্লান্তির ছোঁয়া ওর গায়ে লাগল না। মৌমাছিটাও ক্লান্ত-শ্রান্ত। ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। মধ্যাকার্ষণ শক্তির গণ্ডি পেরোনোর আগে খানিক্ষণ জিরোল দু’জন। আবার দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলল। মহাশূন্য পেরুতে বেগ পেতে হয় নি ওদের। অনেক দৌড়-ঝাঁপ ও কাঠ-খড় পুড়ানো শেষে পৌঁছুতে পারল চাঁদের দেশে। গিয়ে সত্যি তাই দেখল যা শুনেছিল নানুর কাছে। চাঁদনি রাতে মাদুড় পাতা উঠোনে বসে এই চাঁদের কথা, চাঁদের বুড়ির কথা কত্ত শুনেছে। আজ স্বচক্ষে দেখছে বিশ্বাসই হচ্ছে না। এ কেবল স্বপ্নেই সম্ভব। চাঁদের বুড়ি দিব্যি সুতো কাটছে। কেটেই চলছে অবিরত। স্বপন যে এতটা পথ পেরিয়ে, পাহাড়-উপত্যকা ও ভয়ানক মহাশূন্য মাড়িয়ে তার কাছে এলো এতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। খুব কষ্ট পেল স্বপন। মনঃক্ষুণœ হল তীব্রভাবে। চাঁদের দেশে কী সুন্দর সুন্দর দৃশ্য, মেঘবালিকা ওড়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে যেন। এত্তসব মনোরঞ্জনের বস্তু থাকতেও জগতের সব পানসে লাগছে স্বপনের। অভিমানে বিড়বিড় করে বলল― বুড়ি মা, চোখ তুলে একবারের জন্যেও তাকালে না। যাও, তোমার সাথে আড়ি! আর কোনদিন তোমার সাথে কথা বলব না। তোমাকে নিয়ে ভাবব না। নানুর কাছে তোমার গল্প শুনবার বাইনা আর ধরব না। অনেক্ষণ ঘুরে বেড়াবার পর চাঁদের গায়ে হাতের আঙুল টেনে এঁকে দিল ‘স্বপন’। যেন অনাহত পৃথিবী যেনে নেয় কোনদিন স্বপনও এসে ছিল চাঁদের দেশে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০০