দ্বিজুদা, আপনি একটা সিম্পল ভূতের গল্প বলুন, আজ।
সিম্পল ভূত মানে তো তোমাদের ইয়ার্কি-ফাজলামির ভূত? ভূত-গবেষক দ্বিজপদ সাঁতরা বিরক্ত হল, এই করে করে তোমরা লেখকরা ভূতের জাত মেরে বেড়াচ্ছ! ও আমি জানি-টানি না যাও!
দ্বিজুদা ভূতের গল্পের জীবন্ত খনি। কিন্তু ভদ্রলোক যে চটে যাবেন কে জানত! তাঁকে অনেক কষ্টে ঠান্ডা করে জানালাম, তাঁর অসুবিধে থাকলে থাক।
থাকবে কেন? দ্বিজুদার মেজাজ ফিরল, সিম্পল ভূত কি না জানি না ধ্রুব, তবে রীতিমতো প্রকৃতিপ্রেমিক ভূতের সন্ধান পেয়েছিলাম মেঘাতুবুরু সানসেট পয়েন্টে।
মেঘাতুবুরু মানে সারেন্ডার জঙ্গলের যমজ লৌহশহর কিরিবুরু-মেঘাহাতুবুরুর কথা বলছেন তো? ওখানে অনেক দিনের যাওয়ার ইচ্ছে, কিন্তু যাওয়া আর হয়নি।
আরে আমিও কি যেতাম যদি না এক পরিচিতর মুখে কোম্পানির ফ্রি বাসসার্ভিসের কথা শুনতাম! দ্বিজুদা বললেন, লোহার খনির কোম্পানি তাদের স্টাফদের যাতায়াতের জন্য বারবিল রেলস্টেশন থেকে বাস চালায়, তাতে সাধারণ পাবলিকও চড়তে পারে, বিনা পয়সায় চলে যাওয়া যায় আটাশ কিলোমিটার রাস্তা। যাওয়ার পথে বাস ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠে, দুপাশে সারেন্ডার ঘন বন। এক দিন সাতসকালে ট্রেন ধরে চলে গেলাম বারবিলে, কোম্পানির গাড়ি ধরে মেঘাতুবুরুতে পৌঁছে গেস্ট হাউসে উঠে স্নান-খাওয়া-দাওয়া করতে করতেই দুপুর কাবার। তত ক্ষণে সূর্য ঢলে গেছে পশ্চিমে, সানসেট পয়েন্ট যেতে আরও মিনিট কুড়ি, স্পটে পৌঁছে বেজায় দমে গেলাম, শীতের ছুটকো মেঘে সূর্য মুখ ঢেকেছে, সানসেট দেখার বারোটা বেজে গেছে, টুরিস্টরাও হতাশ। এক জন আমাকে বলল, কোথায় যাচ্ছেন? আজ আর কিছু দেখতে পাবেন না।
আমি তার কথায় কান না দিয়ে জোরে জোরে পা চালিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে স্তব্ধ হয়ে গেলাম, সূর্যাস্ত দর্শন ফস্কে যাওয়ার দুঃখ ভুলে গেলাম। সামনে যত দূর দৃষ্টি যায় ঘন জঙ্গলে ঠাসা পাহাড়, পাহাড় আর পাহাড়। এই জন্যই সারেন্ডাকে বলে সাতশো পাহাড়ের দেশ। আমি রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
কত ক্ষণ চেয়ে ছিলাম জানি না, হঠাৎ টুরিস্টদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে মুগ্ধতার ঘোর কেটে গেল, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। টুরিস্টরা প্রায় সকলে নেমে গেলেও একটা দল তখনও রয়ে গেছে, তারা সূর্যাস্তের ছবি তুলবে বলে বড় বড় ক্যামেরা এনেছিল, সঙ্গে স্মার্টফোন তো ছিলই। কিন্তু মেঘ তাদের প্ল্যান মাটি করে দেওয়ায় নিজেদেরই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, দেদার ছবি উঠছে, আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের ঠাট্টাতামাশা, এক যুবতী সেলফি তুলতে গিয়ে আর একটু হলেই আমার ঘাড়ে পড়ছিল, অনেক কষ্টে সামলে সরি কাকু বলে এমন হাসি জুড়ল, বুঝলাম এই জন্যই সূর্য মেঘের আড়ালে ঘাপটি মেরেছে। প্রকৃতির মধ্যেও প্রাণ থাকে, তাদেরও বিরক্তি-অভিমান-প্রেস্টিজ থাকে যার তার কাছে তারা ধরা দেয় না।
হুঁ, ঠিক তাই। আচমকা পশ্চিম আকাশে লিকলিকিয়ে উঠল বিদ্যুতের রেখা, গড়গড়িয়ে উঠল আকাশ, হা-হা করে ছুটে এল দমকা হাওয়া, ঝপ করে দিনের আলো নিভে গিয়ে চার পাশটা ঘোর ঘোর হয়ে এল, ছবি তোলা মাথায় উঠল টুরিস্টদের, বৃষ্টি আসছে, বৃষ্টি আসছে, বলে সব মারল দৌড়, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কেউ নেই কোথাও, আমি একা।
আজ আর সূর্যের মুখদর্শনের আশা নেই বুঝে আমিও গেস্ট হাউসে ফিরে যাব বলে পেছন ফিরেছি, কে যেন গম্ভীর গলায় বলে উঠল, কাকু দাঁড়ান! যাবেন না!
চমকে ঘুরে দেখি রেলিংঘেরা প্লাটফর্মের নীচে জঙ্গলময় পাহাড়ি শুঁড়িপথে দাঁড়িয়ে আছে একটি অল্পবয়েসি ছেলে। রোগাপাতলা চেহারা, উসকোখুসকো চুল, পরনের ট্রাউজার্স-জ্যাকেট-স্নিকার ধুলোময়লায় মাখামাখি। কে রে বাবা! হঠাৎ করে কোত্থেকে উদয় হল? গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে তত ক্ষণে।
ভূত? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হাঁকপাক করো না, ধ্রুব। চুপ করে শোনো! দ্বিজুদা বলে চলল, আমি চেয়ে আছি দেখে ছেলেটা এগিয়ে এল, ভাল করে তার দিকে চেয়ে আমি তো থ। কপালে গভীর ক্ষত, সারামুখে কাটাছেঁড়ার অজস্র দাগ, রক্তে মাখামাখি হয়ে আঁট হয়ে চুল লেগে আছে মাথায়। ব্যস্ত ভাবে বললাম, কে তুমি ভাই? এই অবস্থা হল কী করে তোমার?
পড়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটি বলল।
কোথায়?
খাদে। সানসেটের ছবি তুলছিলাম, সবশুদ্ধ একেবারে নীচে। ক্যামেরাটা যে কোথায় গেল তন্ন তন্ন করে দুবছর ধরে খুঁজছি, ট্রেসই করতে পারছি না।
দুবছর! তার মানে?
দুবছর আগেই ঘটেছিল ঘটনাটা।
দুবছর ধরে পোশাক বদলায়নি, ক্ষতর চিকিৎসা করায়নি, এখনও সেই চেহারা নিয়ে ক্যামেরার খোঁজে বনজঙ্গল ঢুঁড়ে মরছে। তার মানে শিয়োর সেদিনই ওর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল, সানসেটের ছবি তুলতে গিয়ে নিজেই ছবি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এত দিন পরে আমাকে দেখা দেওয়ার মানে?
তা হলে শুনুন। বলে এই মানেটাও পরিষ্কার করেই ছেলেটা বুঝিয়ে বলল, দুবছর আগে এই রকমই এক বিকেলে আমিও এখানে এসেছিলাম ছবি তুলতে। আজকের মতো সে দিনও মেঘে আকাশ ছেয়ে ছিল। লোক জন যারা এসেছিল তারা তো বিরক্ত হয়ে পালাল, কিন্তু এই যে কাকু আপনি ঠিক আপনার মতোই আমিও আশা না ছেড়ে আকাশের দিকে ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে রইলাম আর মনে মনে সূর্যঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম, এক বার দেখা দাও! জাস্ট ওয়ান শট প্লিজ! কিন্তু কোথায় কী, উলটে বৃষ্টি শুরু হল, ক্যামেরা গুটিয়ে গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম, ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি।
কষ্ট দেখে সূর্যঠাকুরের দয়া হল বোধ হয়। হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল, মেঘগুলো পাকাতে পাকাতে মাঝ আকাশে চলে গেল, খুলে গেল সূর্যের মুখ। বৃষ্টিধোওয়া চকচকে আকাশে সে যে কী দৃশ্য কী বলব কাকু! আমি ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে তুলতে রেলিং গলে বাইরে চলে গেলাম, তার পর তো আকাশের দিকেই নজর আমার, কোথায় যাচ্ছি, কোথায় পা ফেলছি ভুলে গিয়েছি, ঘোর লেগে গিয়েছে, ফলে যা হওয়ার সেটাই হল পা ফস্কে সোজা চলে গেলাম খাদে। তা গিয়েছি দুঃখ নেই, মরেও গিয়েছি তাতেও দুঃখ করি না, কিন্তু ক্যামেরাটা হারিয়ে যেতে অমন চমৎকার ছবিগুলো নষ্ট হল এই ভেবে মরেও শান্তি পাচ্ছি না, বুঝলেন? আপনার কাছে ক্যামেরা আছে? এনেছেন ক্যামেরা?
ক্যামেরা! আমি তো অবাক।
হুঁ, ছবি তুলব। বলতে বলতে ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে উঠল, আজও ঠিক সেই দিনের মতো ওয়েদার হয়েছে, এই তো বৃষ্টিও শুরু হয়ে গিয়েছে, একটু পরেই দেখবেন বৃষ্টি ধরে যাবে, আকাশ ক্লিয়ার হয়ে যাবে, সূর্য উঠবে। যা রূপ খুলবে আজ সূর্যর দেখবেন পাগলা হয়ে যাবেন কাকু! ছেলেটি হাত পাতল, দিন না ক্যামেরাটা! কয়েকটা স্ন্যাপ নেব জাস্ট! প্লিজ কাকু!
ক্যামেরা থাকলে তার পেছনে প্রচুর সময় চলে যায়, প্রকৃতিকে ভাল করে উপভোগ করা যায় না এই ভেবে আমি বেড়াতে বেরিয়ে কখনও ক্যামেরা সঙ্গে রাখি না। আজও আমার হাত খালি। ছেলেটিকে তা বলতেই সে বেজায় মুষড়ে পড়ল, ধুস বলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে যেখান থেকে এসেছিল ঝোপজঙ্গল ঠেলে সেখানেই মিলিয়ে গেল, আর এল না। বোধ হয় নিজের ক্যামেরার খোঁজেই গেল তোমার সিম্পল ভূত।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি সত্যি সে দিন সূর্য উঠেছিল দ্বিজুদা?
উঠবে না মানে? ভূতপ্রেত মানুষ নাকি মিথ্যে বলবে? ছেলেটি যেমন বলেছিল ঠিক তাই হল। বৃষ্টিটা বাড়তে বাড়তে এক সময় থেমে গেল, তার পর মেঘের আড়ালে রক্তাক্ত বৃত্তের একটা গোল ড্রয়িং দেখা দেল, আস্তে আস্তে সেটা স্পষ্ট হতে হতে এক সময় মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সূর্য। লোহাকে আগুনে ফেলে গরম করলে যেমন রং হয় অবিকল সেই রং সূর্যের, থালার মতো বিরাট। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল! মনের ক্যামেরায় একটার পর একটা ছবি তুলতে লাগলাম। আজও চোখ বুজলেই মনের মধ্যে ছবিগুলো জ্বলজ্বল করে, বুঝলে ধ্রুব
দ্বিজুদা থামল।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:২৪