somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৯৭১ সালের পর জন্মেও জামায়াতে ইসলামী বা শিবির কর্মীরা কেন রাজাকার?

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জামায়াতে ইসলামী নামে সংগঠনটির জন্ম সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর হাত ধরে, জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে, ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্টে লাহোরে। (মওদুদীর জন্মস্থান যদিও ভারতের আওরঙ্গাবাদে। বর্তমানে মহারাষ্ট্র)

১৯৪৭ সালে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কার্যালয় লাহোরের ইছরায় স্থানান্তর করা হয়। এবং 'ইসলামী সংবিধান' ও 'ইসলামী সরকার' প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াত প্রচারণা শুরু করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে কারাগারে বন্দী করলেও ১৯৪৯ সালে জামায়াত প্রভাবিত 'ইসলামী সংবিধানের রূপরেখা' গ্রহণ করে। এবং ১৯৫০ সালে মওদুদী কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে 'কাদিয়ানী সমস্যা' নামে একটি বই লিখে মওদুদী কাদিয়ানী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এবং সহস্র মানুষ হতাহত হয়। ব্যপক গোলযোগ সৃষ্টির জন্য এবং হত্যার প্ররোচনা দেয়ার জন্য মওদুদী দোষী সাব্যস্ত হন এবং সরকার তাঁর মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়। (যদিও কাদিয়ানী সমস্যা নামক বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি)। পরবর্তীতে মৃত্যুদন্ডাদেশ পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড করা হয়, এবং তা-ও প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণিত মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মওদুদী সহ ৬০ জন জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন। গোলাম আযম তাদের একজন।

গোলাম আযম ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে জামায়াতে ইসলামীতে সহযোগী (মুত্তাফিক) হিসেবে যোগদান করার পর ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হয়ে রংপুর কারাগারে অবস্থানকালেই জামায়াতের রুকন হন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তিনি রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এর এক বছর পর তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এবং রাজশাহী বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে গোলাম আযমকে তদানীন্তন পূর্ব পাক জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। একাদিক্রমে এক যুগ তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে তাঁর উপর পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

জামায়াতের ইসলামী, আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ছয় দফা এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত ১১ দফার তারা তীব্র বিরোধিতা করে। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে।

২৫ মার্চ রাতে সংঘটিত অপারেশন সার্চলাইট এর ছয় দিন পর গোলাম আযম ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি ভারতের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন: " ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্বপাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।...আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের নিকট হতে কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।"

জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলেন। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে কাজ করে।

৩০ জুন লাহোরে সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আযম বলেন, "তাঁর দল পূর্ব পাকিস্তানে দুস্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) তৎপরতা দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এবং এ কারণেই দুস্কৃতকারীদের হাতে বহু জামায়াত কর্মী নিহত হয়েছে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্য ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্য ছিলেন পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বরা। গোলাম আযম ও এই কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম এ গোলাম আযমের পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালের একটি সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ দুই কিস্তিতে ছাপা হয়। এই সাক্ষাতকারে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে তার দলের সদ্স্যদের সংঘর্ষের বিভিন্ন বিবরণ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থতির ওপর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতকে মনে করতো পহেলা নম্বরের দুশমন। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামায়াতের লোকদের বেছে বেছে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর লুট করছে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এতদসত্বেও জামায়াত কর্মীরা রেজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে 'বাংলাদেশে' ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কোন স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না

১৯৭১ সালের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত ও এর আওতায় পড়ে। গণহত্যার সহযোগী গোলাম আজমসহ তার প্রধান সহকারীদের প্রায় সকলেই পাকিস্তানে পালিয়ে বাঁচেন। ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল সরকারী এক আদেশে আরো ৩৮ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে গোলাম আযমকেও বাংলাদেশের নাগরিক হবার অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সকল ধরণের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন এ সময় ইসলামিক ডেমোক্র‌্যাটিক পার্টি নামক একটি দলের সাথে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত ছিল। জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে সাময়িক ভাবে বাংলাদেশে আসেন এবং কোন ভিসা ছাড়াই ১৯৭৮-১৯৯৪ পর্যন্ত বাস করেন।

গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ গঠিত হয়। তিনি অলিখিত ভাবে বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক দল যাদের অধিকাংশই ১৯৭১ সালে দেশ বিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল তাদের আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, যার পূর্বনাম ছিলো জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, আজ বাংলাদেশের একটি বড় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। দলটি ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ১৮ টি এবং ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ২ টি আসন লাভ করে।

ইসলামী আদর্শকে দলটি মিশ্র সাফল্যের সাথে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। কিন্তু দলটির "ডাইরেক্ট একশন" প্রবনতা বার বার সাধারন মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে।

যার ফলস্রুতিতে দলটি ইসলামী আদর্শের পরিবর্তে সন্ত্রাসী আদর্শের দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এতে মূল ক্ষতি হয়েছে ইসলামী আদর্শেরই। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনকে বহুলাংশে পিছিয়ে দেয়ার পিছনে জামায়াতের ভ্রান্ত নীতিই দায়ী।

১৯৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয়, নিপীড়িত বাংলাদেশীদের মন ও মননের সবচাইতে গৌরবজনক ও সংবেদনশীল অংশ। জামায়াত বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হলেও, আজ পর্যন্ত জনসমক্ষে ১৯৭১ এর ভ্রান্ত নীতি ও গনণহত্যার সহযোগিতার জন্য কোন রকম ক্ষমা চায়নি। যার অর্থ হল তারা এখনও মনেপ্রানে বিশ্বাস করে 'বাংলাদেশে' ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কোন স্থান হতে পারে না। তারা এখনও বিশ্বাস করে "জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।" ঠিক যেমনটি মনে করে নিও নাজী বা নিও ফ্যাসিস্টরা।

১৯৭১ সালের পর জন্ম নেওয়া জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক জামায়াতে ইসলামী অথবা ইসলামী ছাত্র শিবির এর সমর্থক, কর্মী, নেতারা অনেকেই এই প্রচারনা চালাতে চায় যে, তারা তো রাজাকার নয়! তারাতো ইসলামী আদর্শের পথে লড়ছে!

কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী যে ভ্রান্ত নীতির ওপর ভিত্তি করে তারা বাংলাদেশে আজ রাজনীতি করছে, তারা কি সেই ফ্যাসিস্ট আদর্শ থেকে বেরুতে পেরেছে?

বর্জন করতে পেরেছে ১৯৭১ এর বিরোধী নেতৃত্ব কে?

ক্ষমা চাইতে পেরেছে ১৯৭১ এর ভ্রান্ত নীতির জন্য?

১৯৭১ গণহত্যার পরিকল্পনাকারি ও সহযোগী শক্তিকে ধিক্কার জানাতে পেরেছে?

বিশ্বাস করতে পেরেছে বাংলাদেশ' ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য একটি সুন্দর স্থান হতে পারে ?


বিষয়টা নৈতিকতার। যদি আজকের নবীন জামায়াত কর্মীরাও ১৯৭১ এর সেই ভ্রান্ত নীতির চক্রে আবদ্ধ থাকে, তবে তারাও রাজাকার। নব্য রাজাকার।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:৩৭
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×