somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্ব রাজনীতি: নীতি-নৈতিকতার অবস্থান, প্রয়োগ, উপযোগীতা ও পরিবর্তন

২১ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০১.
আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাথে নীতিবিদ্যা তথা নৈতিকতার বিষয়াবলী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রকৃতি কি? সময়ের বিবর্তনে বিশ্ব রাজনীতির তিনটি মৌলিক পদ্ধতি গড়ে উঠেছে: বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও নৈরাজ্যবাদ। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশষেজ্ঞগণ নৈরাজ্যবাদকে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট বলে মনে করে থাকনে। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি সর্ম্পকে জে. নায়ে অভিমত দিয়েছেন- `.....an anarchic system of states, composed of states that are relatively cohesive but with no higher government abovr them.’ এর বাস্তব উদাহরণ হলো প্রাচীন গ্রীসের নগর রাষ্ট্রসমূহ অথবা পঞ্চদশ শতকের ম্যাকিয়াভেলীয় ইতালি কংবা বর্তমান উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির বিশ্ব। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাধারণ সার্বভৌমত্বের অনুপস্থিতি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের শুন্যতা ইত্যাদি চলকসমূহ নৈরাজ্যবাদী তত্ত্বকে আরো গভীরে প্রোথিত করেছে। মূলত `an-archy’ অর্থ হচ্ছে `The absence of any ruler.’ এদিক থেকে বলা যায়-`International politics is a self-help system.’ ইংরেজ দার্শনিক থমাস হবস যাকে ‘স্টেট অব নেচার’ বলে উল্লেখ করেছেন। নৈরাজ্যবাদ বিশ্লেষণে বাস্তববাদী তাত্ত্বিকেরা হবসের ধারণার ধারাবাহিকতায় যুদ্ধ ও বিশৃংখলাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধাণ অ্যাকটর হিসেবে চিহ্নত করেছেন। অন্যদিকে উদারবাদীরা মন্টেস্কু, কান্ট, বেনথাম ও মিলের চিন্তাদর্শের আলোকে একটি বৈশ্বিক সমাজের ( গ্লোবাল সোসাইটি) ইমজে তৈরি করেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক বাস্তববাদী ও উদারবাদী-এ দুই ঘরানার সমর্থকেরাই তাদের ডিসকোর্সে নৈতিকতাকে বিভিন্ন মানদন্ডে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে নীতবিদ্যিা বা নৈতিকতা বিষয়ে প্রথমেই একটা ধারণা থাকা দরকার। নীতিবিদ্যা বা নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ `Ethics’ , যা `Ethica/Ethos’ (চরিত্র) থেকে উদ্ভূত। এব আরকে নাম ‘মোরাল ফিলসফি’। জ্ঞানবদ্যিার গুরু এ্যারিস্টটল বলেন- নীতিবিদ্যা হলো সে বিদ্যা যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের ভালো-মন্দ বিচার করে। ম্যাকেঞ্জী মনে করেন যে এ বিদ্যা ন্যায়ত্ব বা অন্যায়ত্ব ও ভালো বা মন্দ প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ক্রিয়াকলাপের মূল্যায়ণ করে। সেথ ও মুরহেড এর ব্যাপকতা বিচারে একে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। ফলে সঙ্গতভাবেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নৈতিকতার অবস্থান ও প্রয়োগ সুবিদিত। আর বিভিন্ন মত ও পথের বিশ্লেষকগণ বিশ্ব রাজনীতির বিস্তৃত আঙিনায় এর প্রয়োগ ও উপযোগিতা যাচাই বাছাই করেছেন যৌক্তিকতার নানা মানদন্ডে।

০২.
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নৈতিকতার স্পষ্ট প্রয়োগ ও বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন গ্রীসরে নগর রাষ্ট্রসমূহ থেকে অদ্যাবধি তা দৃশ্যমান হয়। বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক থুকিডাইডিস দেখান যে, পিলোপনেশীয় যুদ্ধের সময় কর্সিরা এথেন্সের নিকট করিন্থের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে সাহায্য চাইলে সেখানে নৈতিকতার প্রয়োগ করা হয়। কর্সিরার প্রতি এথেন্সের উপদেশ ছিল থুকিডাইডিসের ভাষায়-`First of all you will not be helping aggressors, but people who are the victims of aggression. Secondly, you will win our undying gratitude.’ ঐতিহাসিক পিলোপনেশীয় যুদ্ধের নৈতিকতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো আধুনকি কালের বিশ্ব রাজনীতিতেও আবর্তিত হতে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে কর্সিরার পরিবর্তে বসনিয়া এবং করিন্থের বদলে সার্বিয়ার তুলনা করা যেতে পারে। মোরাল আর্গুমেন্ট জনগণকে একদিকে আন্দোলিত বা সক্রিয় অন্যদিকে নিষ্ক্রীয় করে রাখতে পারে। অনেক সময় একে প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পিলোপনেশীয় যুদ্ধের সময় এথনেীয়রা মেলিয়ানদের বিরুদ্ধে ‘বিজয় নয় মৃত্যু’ এমন মরণ পণ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। মেলিয়ানরা এর প্রতবিাদে সোচ্চার হয় এবং বলতে থাকে তারা তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। মেলিয়ানরা এথেনীয়দের তুলনায় ছিল শক্ত-সামর্থে যথেষ্ট দুর্বল ছিল। ফলে এথনেীয়রা মেলিয়ানদের বড়ভাই সুলভ এবং অবজ্ঞাসূচক বিশেষণে বিশেষায়িত করল। তারা স্পষ্ট ঘোষণা করে বসল- `... the strong do what they have the power to do and weak accept what they have to accept.’ এক্ষেত্রে এথেনীয়রা নৈতিকতার পথ না মাড়িয়ে নিরেট বাস্তবতার নিরিখে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী পেশ করে। তাদের এ মনোভাবে স্পষ্ট হয় শক্তিমানরাই শ্রেষ্ঠ। এ রকম নৈতিকতাশুন্য যুক্তিতেই ইরাক কুয়েতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রানাডা, ইরাক ও লিবিয়ায় এবং ইন্দোনেশিয়া র্পূব তিমুরে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে, সোজা কথা আগ্রাসন চালায়। সিরিয়ায় আমেরিকা, রাশিয়াসহ বৃহৎ শক্তরি খেলা বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির নীতি বিবর্জিত ক্ষমতার লড়াই বললে অত্যুক্তি হবে না।

০৩.
অনেক সময় নৈতিক বিষয়ের সাথে যৌক্তিক উপলব্ধির সংমশ্রিণ ঘটে থাকে। ফিলিস পারমাণবিক
যুদ্ধাস্ত্রকে আশির্বাদ মেনেছেন। কারণ তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে ঈশ্বর পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন। এর বিরোধীতা করেছেন অনকেই। তারা বলছনে যে, ঈশ্বর তাহলে কেন স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নকে, মাও সেতুং এর চীনকে, এমনকি দুর্বল ব্যর্থ উত্তর কোরিয়াকে তা প্রদান করেছেন। অবশ্য তারা পুঁজিবাদী দেশসমূহের বিপুল পারমাণবিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র সর্ম্পকে অজানা কারণে নিরব থেকেছেন। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্টই ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ নামক পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করে। ইতিহাসের জঘন্যতম ও বর্বোরচিত এ হামলায় জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। যার রেশ এখনো বহমান। ফলে নৈতিক যুক্তিগুলো সব সময় সমান আচরণ করে না তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

০৪.
পক্ষপাত বা পক্ষপাতহীন আচরণ বিষয়ক নৈতিকতা সংক্রান্তে পাশ্চাত্যে দুটি সনাতন মডেল গড়ে উঠেছে। যথা- জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ‘কান্ট মডেল’ এবং ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেনথামের ‘ইউটিলিটারিয়ান বা উপযোগবাদী মডেল’। কান্টের বক্তব্য অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি বা রাষ্ট্র নৈতিকতার বিষয়াবলী কঠোরভাবে প্রতিপালন করবে। কিন্তু উপযোগবাদীরা বলে থাকেন যে, প্রয়োজনে ও বাস্তবতার নিরিখে নৈতিকতার মৃদু বা পূর্ণ লঙ্ঘন হলেও ক্ষতি নেই। যেমন- ধরা যাক কোনো এক ব্যক্তি দরিদ্র একটি গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সে দেখল এক সেনা কর্মকর্তা একটি দেয়ালের বিপরীতে তিনজন দরিদ্র কৃষককে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করতে যাচ্ছে। লোকটি জিজ্ঞাসা করল যে, কেন তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ তাদের দেখতে নিরপরাধ মনে হচ্ছে। কর্মকর্তা উত্তর দিল গতরাতে এ গ্রামের কে বা কারা এক সেনা সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে। একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তিন ব্যক্তিকে গুলি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মনে করা হচ্ছে এদের যে কোন একজন একাজে জড়িত ছিল। কেউ স্বিকার না করায় তিন জনকেই শেষ করে দেয়া হবে। তখন লোকটি বলল আপনি একাজ করতে পারেন না। কারণ একজন যদি দোষীও হয় তবে অন্য দুজন অবশ্যই নিরপরাধ, সম্ভবত তিনজনই নিরপরাধ। কর্মকর্তা তার কথা শুনে তাকে কাছে ডাকলেন এবং তার হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন অপরাধীকে গুলি করে অন্য দুজনকে ছেড়ে দিন। পাশাপাশি তিনি তাকে বললেন-`I am going to teach you that in civil war you can not have these holier than thou attitude.’ এ অবস্থায় লোকটির করণীয় হতে পারে; উপস্থিত সৈন্যদেরকে ব্যাপক কলা-কৌশল ও শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ধরাশয়ী করে তিনজনকে উদ্ধার করা। সেটা তার দ্বারা প্রায় অসম্ভব, কারণ তার দিকে বন্দুক তাক করে রাখা আছে। এখন তার সামনে দুটি পথ খোলা: দুজনকে রক্ষা করতে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যা করা অথবা অস্ত্র জমা দিয়ে নিজের হাত পরিস্কার রাখা। কান্টের মডেল অনুযায়ী , লোকটি অস্ত্র ত্যাগ করে নিজেকে খুনের মত অপরাধের সাথে জড়াতে পারবে না। কিন্তু উপযোগবাদীদের মতে সে দুজনের জীবন রক্ষা করতে একজনকে হত্যা করতে পারবে। কান্টের মত কে সমর্থন করলে একটা সমস্যা থেকে যায়। ধরা যাক একটা দেয়ালের বিপরীত পাশের ১০০ ব্যক্তিকে সন্ত্রাসীর বোমা হামলা থেকে এক ব্যক্তি বাঁচাতে সক্ষম। এক্ষেত্রে তার হামলাকারীকে পরাস্ত করা উচৎি। এভাবে বলা যায় শত, সহস্র, মিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করতে লোকটির কি হাত গুটিয়ে বসে থেকে নিজেকে পূত-পবিত্র রাখা ন্যায়সংগত হবে? তবে এ ধরণরে পরিস্থিতিতে তিনটি বিষয় বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। বেনথামের ভাষায়-`.... at some points or intentions involved, by the means used, and by their consequences of net effects.’ তবে সব সময় এ তিনটি মাত্রাকে একসাথে বিবেচনায় নিয়ে আসা সম্ভবপর হয় না। ফলে বলা যায় নৈতিকতার বিষয়াবলী সর্বদা পক্ষপাতহীন হয় না। অনকে সময় তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে।


০৫.
জাতীয় আভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আঙিনায় নীতিবিদ্যা বা নৈতিকতার চর্চা তুলনামুলক ভাবে কম পরিলক্ষিত হয়। সহজে বলতে গেলে একটা দেশের জাতীয় জীবনে নৈতিকতার বেশ প্রভাব থাকে। কিন্তু বিশ্ব পরিসরে তা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপালনই হয় না। বিশ্ব রাজনীতিতে নৈতিকতার এ দুর্বল অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করতে কয়কেটি দিক সামনে আনা যেতে পারে ক) আদর্শ ও বাস্তবতা (ভ্যালুস এ্যান্ড রিয়ালিটি) -আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন এবং নরম্স্-ভ্যালুস এর উপর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নৈতিক আবেদনকে সীমিত করে তোলে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কার্যক্রম/ঘটনা/সাংগাঠনিক তৎপরতা বিচার-বিশ্লেষণে বহুমুখী সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গতি প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন- সংগঠন হিসেবে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, ওআইসি প্রভৃতি এবং ব্যবস্থাপনা হিসেবে বিশ্বায়ন, বাজার অর্থনীতি, আকাশ সংস্কৃতি প্রভৃতির কথা বলা যায়। বহুজাতিক ব্যবস্থাপনায় তাই নৈতিক বিষয়াবলী তেমন প্রতিপালিত হতে দেখা যায় না। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়- জাতিসংঘ দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে বৃহৎ শক্তির স্বার্থেই পরিচালিত হয়। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে প্রকৃতপক্ষে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশের পরিবর্তে ধনী ও উন্নত দেশের উন্নয়ন সাধতি হয়ে থাকে। খ) ব্যক্তি ও রাষ্ট্র: ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নৈতিকতার চর্চায় স্পষ্ট র্পাথক্য দেখা যায়। ব্যক্তি হিসেবে দেশের মানুষ অনেক সাধারণ নৈতিক বিষয়াবলী মেনে চলে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে তার প্রতিফলন খুব কম ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। কারণ রাষ্টসমূহ ব্যক্তির মত আচরণ করে না বা করতে পারে না। রাষ্ট্র হলো বিমূর্ত আর এর নেতৃবৃন্দ হলো ব্যক্তি। একজন রাষ্ট্রনায়ক ব্যক্তিগতভাবে নানামুখী কর্মতৎপরতার মাধ্যমে একটি ব্যক্তিগত ইমেজ তৈরি করতে পারে । নৈতিকতার চর্চা থেকে তাকে জনগণ সেভাবইে মূল্যায়ণ করে। আবার একই ব্যক্তি রাষ্টনায়ক হয়ে ভিন্ন আচরণ করে। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠী, দলীয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা র্স্বাথ তাকে এ পথে ধাবিত করে। অর্থ্যাৎ ব্যক্তিগত নীতি নৈতিকতার চর্চা সেখানে গৌণ বিবেচিত হয়। পিলোপনেশীয় যুদ্ধের সময় এথেনীয়রা মেলান দ্বীপের নেতৃবৃন্দকে হুমকি দেয় যে, তারা এথেনীয় আক্রমণে বাধা দিতে আাসলে তাদের নেতৃবৃ্ন্দকে হত্যা করা হবে। মেলিয়ানরা তাদের স্বাধীনতা স্পৃহা থেকে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন । পরিণতিতে তীব্র প্রতাপশালী এথেনীয়দের কাছে তাদের জনগণ নির্বিচারে গণহত্যার সম্মুখীন হয়। এখানে উভয় নগর রাষ্টের নেতৃবৃন্দের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। ১৯৬২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি বিশ্ব থেকে তথাকথিত পারমাণাবিক যুদ্ধের হুমকি মোকাবিলা করার জন্য কিউবা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল প্রতিরক্ষা অপসারণের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে, একই ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে স্থাপন করে। ফলে ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রের হয়ে আচরণ করে তখন নৈতিকতার প্রশ্ন নিরবে নিভৃতে কেঁদে মরে। গ) কার্যকারণের জটিলতা: আভ্যন্তরীণ রাজনীতির চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কার্যকারনের জটিলতা অনেক বেশি। তাই নৈতিকতা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন। কারণ এখানে থাকে রাষ্ট্রের আন্তঃকার্যগত উপাদান বা পারস্পারিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ( দ্য ইন্টারঅ্যাকশান অফ স্টেট)। এই বহুমাত্রিকতা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফলাফলের নিকট অনুমান করতে অনেকটাই দুরুহ করে তোলে। এক্ষেত্রে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক সোসাইটি ‘ অক্সফোর্ড ইউনিয়ন’ এর ১৯৩৩ সালের বিতর্কের বিষয়টি সামনে আনা যেতে পারে। প্রথম ‍ুবিশ্বযুদ্ধে ২০ মিলিয়ন মানুষের জীবন হানির কথা ভেবে বিতার্কিক ছাত্রদের অধিকাংশই যুদ্ধবিরোধী সুপারিশ বা প্রস্তাবনা গ্রহণ করে। তারা রাজা বা দেশের জন্য পুনরায় কোন যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশ্য ইতোমধ্যে হিটলার গণতন্ত্র কে হত্যা করে চারিদিকে যুদ্ধের আতংক ছড়িয়ে দেয়। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যারা আর কখনো যুদ্ধের আশা করে নি তাদের বিশেষত যুদ্ধ বিমুখ ‘অক্সফোর্ড ইউনিয়ন’ এর যুদ্ধবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফল হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তাদের অনেকেই এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ও নিহত হয়। ১৯৭০ দশকের ‘হামবার্গার আর্গুমেন্ট’ আরেকটি উদাহরণ হতে পারে। এ সময় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খাদ্য ঘাটতি জনিত কারণে বিশ্বব্যাপী জনগণের মাঝে চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। তখন আমেরিকার কলেজ ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা খাবারে মাংসের তৈরি কিমা পরিহার করে তা দিয়ে ক্ষুধার্তদের খাবারের সংস্থান করবে। সে সময় এক পাউন্ড কিমার অর্থ দিয়ে ৮ পাউন্ড অন্যান্য খাদ্য কেনা সম্ভব ছিল। আমেরিকায় তখন খাদ্যশস্যের চরম ঘাটতি ছিল। তা রপ্তানিই ছিল প্রধান ভরসা। ফলে সঞ্চয়কৃত অর্থ দিয়ে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য এনে বাজারে ছাড়া হলো । এতে বাজারে উদ্বৃত্ত পণ্য জমতে থাকে। বাজার নিম্নমুখী হয়। কৃষকও উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ডলারের দাম কমে আসে। সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা ছিল মুদ্রা কেন্দ্রিক। খাদ্যশস্য কিনতে তাই এখানকার মানুষের দরকার ছিল কাঁচা মুদ্রার। বাজারে বা পাইকারের কাছে দ্রব্য থাকলেও মুদ্রার অভাবে তা কেনা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে পরবর্তীতে বাংলাদেশসহ অনেক জায়গায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ অঞ্চলের কৃষকদের সাহায্য করতে দরকার ছিল মুদ্রা, যার সাহায্যে তারা খাদ্যশস্য কিনতে পারে। মাংসের কিমা খাওয়া বা না খাওয়াই তাদের কোন যায় আসে না। মূলত কিমাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ও জাতীয় যতগুলো পরিবর্তন সাধিত হয় তা মুল কারণের বিস্তৃত প্রতিফলন বলা চলে। ঘ) শৃংখলা ও ন্যায়বিচার: শৃংখলা ও ন্যায়বিচার আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই বেশি প্রতিফলিত হয়। এ প্রসঙ্গে যোসেফ নায়ে বলেন-`.....there is the argument that the institutions of international society are particularly weak and that the disjunction between order and justice is greater in international than in domestic politics.’ আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থে শৃংখলা রক্ষায় সবাই কমবেশি সচেতন। তবে কোনো কোনো সময় দেশীয় ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রতিবাদকারীরা আইন শৃংখলা ভঙ্গের দিকে ধাবিত হয়। এটাও ঠিক যে শৃংখলা ভেঙে পড়লে ন্যায়বিচারও ব্যাহত হয়। যেমন- ১৯৮০ দশকের লেবানন এবং ১৯৯০ দশকের সোমালিয়ার গোলযোগকালীন অব্যাহত বোমা হামলা, অপহরণ এবং গণহত্যার বিষয়গুলো ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে শৃংখলা ও ন্যায়বিচার আরো সীমিত ও বিতর্কিত। মূলত আন্তর্জাতিকভাবে স্বতন্ত্র্য আইনবিভাগ, কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃপক্ষ ও শক্তিশালী বিচার বিভাগের অনুপস্থিতি বিশ্বব্যাপী বিশৃংখলাকে আরো উস্কে দিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারও আজ প্রশ্নবিদ্ধ।


০৬.
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নীতিবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গী সংক্রান্ত তিনটি মতবাদ গড়ে উঠেছে, যথা- নৈরাশ্যবাদ বা সংশয়বাদ (স্কেপটিসিজম), রাষ্ট্রীয় নৈতিকতাবাদ (স্টেট মোরালিজম) ও সার্বজনীনতাবাদ (কসমোপলিটিয়ানিজম)। ক. নৈরাজ্যবাদ/সংশয়বাদ: সংশয়বাদীরা মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নৈতিক কাঠামোর কোনো অস্তিস্ত নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে দেখা যায়। একজন ফরাসী কূটনীতিক বলেছিলেন-` What is moral is whatever is good for France.’ আবার অনেকেই বলে থাকেন-`I had no choice.’ ফলে জাতীয় রাজনীতির এসব বিপরীতমুখী উপকরণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বোতভাবে বিশৃংখলা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করে। বিশ্ব পরিমন্ডলে স্বতন্ত্র কোনো আইন শৃংখলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান নেই। নেই কোনো গোত্রীয় উপলব্ধি। কোনো নৈতিক অধিকার এককভাবে জনগণ ভোগ করতে পারে না। ফলে বিশ্ব জনগণের আলাদা ভাবে কোনো নৈতিক দায়িত্বও নেই। নৈরাজ্যবাদীরা বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার প্রয়োগই বেশি প্রত্যক্ষ করেন। কেননা বলা হয়ে থাকে-` The strong do what they have the power to do and the weak accept what they have to accept.’ আসলে ক্ষমতাই অধিকারকে সৃষ্টি করে। এ মতের অনুসারীরা মনে করেন যে, নৈতিকতা অনেকগুলো চয়েসের দাবি করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতার ভারসাম্য, আন্তর্জাতিক আইন ও সংগঠন- এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ চয়েস ধরে অনেকটা স্থিতিশীল নৈতিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব। সমাজবিজ্ঞানী থমাস হবস নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে রাষ্ট্রের আচরণ ব্যাখা করে বলেন- ` The state of nature, where anyone might kill anyone else, individuals give up their freedom to a leviathan, or government, for protection because life in the state of nature is nasty, brutish and short.’ হবসের এ বক্তব্য থেকে ‘সুপার লেভিয়াথান’ কিম্বা ‘ওয়ার্ল্ড গভার্নমেন্ট’ এর একটা ধারণা পাওয়া যায়, যা বাস্তবে হয়নি। এর কারণ হিসেবে নিরাপত্তাহীনতাকে তিনি দায়ী করেছেন। তার মতে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিরাপত্তাহীনতা অনেক বেশি। তবে সকলের সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে দিনকে দিন ঈপ্সিত লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব। হবস বিশ্বাস করতেন যে, শক্তিসাম্যের মধ্যে অবস্থিত রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যিক অবস্থাকে প্রশমিত করবে এবং কিছুটা হলেও শৃংখলা ফিরিয়ে আনবে। যেমন-স্নায়ু যুদ্ধকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার শীতল লড়াই বিশ্বকে একটা ভারসাম্যের জায়গায় কিছুটা হলেও নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। অবশ্য উদারবাদীরা আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথার উপস্থিতি কে এক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনেন, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন-আন্তর্জাতিক আইনে অপর রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ হলেও ১৯৯০ সালে ইরাক তা লংঘন করে কুয়েত দখল করে নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক, লিবিয়া,আফগানিস্তান ও সিরিয়া আক্রমণ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা নৈরাশ্যবাদীদের বক্তব্যকে তাদের প্রকৃত কার্যক্রমের মাধ্যমে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেত পারে মর্মে প্রফেসর নায়ে বলেন-`International institutions,...provide a degree of order by facilitating and encouraging communication,.....international politics is not always, as the skeptics claim, kill or be killed.’ সংশয়বাদ প্রসঙ্গে যুদ্ধ প্রশ্নে ‘দ্য জাস্ট ওয়ার ডকট্রিন’ ও ‘প্যাসিফিজম’ মতবাদ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম মতবাদ অনুযায়ী যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হলেও এবং যুদ্ধকালীন যুদ্ধের অনুমতি থাকলেও নির্দোষ ও নিরপরাধ নাগরিক হত্যা করা নিষিদ্ধ। তাহলে সঙ্গতভাবে প্রশ্ন ওঠে যে, এ যাবত যুদ্ধের সময় কৃত হত্যাকান্ডগুলো কতটুকু যৌক্তিক? এ্যাবসুলিউট প্যাসিফিস্টরা বলে থাকেন যে, কোনো হত্যাকান্ডই গ্রহণযোগ্য নয় এবং কোনো ব্যক্তিই হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কান্টের মতবাদের সাথে এর মিল পাওয়া যায়। নৈরাশ্যবাদীদের কেউ কেউ যু্ক্তি দেন যে, `one man’s terrorist is just another man’s freedom fighter.’ কিন্তু ‘জাস্ট ওয়ার ডকট্রিন’ এ বলা হয় যে, তুমি স্বাধীনতার জন্য লড়তে পার , তবে নির্দোষ ও নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যা বা ক্ষতি করে কিছু করতে পারবে না। অবশ্য বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ত্ব চোখে পড়ে না। মোটামুটিভাবে নৈরাশ্যবাদ চলমান আন্তর্জাতিক রাজনূীতিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। কেননা বিশ্ব রাজনীতিতে এর আবেদন সর্বোতভাবে নেতিবাচক ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে-` Humans may not live wholly by the word, but neither do they live solely by the sword.’ অনেক বাস্তববাদী বিশ্ব রাজনীতির মানের ব্যাপারে নৈরাজ্যবাদী। তাদের মতে, বিশ্ব রাজনীতিতে প্রাথমিকভাবে শৃংখলা স্থাপনের মাধ্যমে নৈতিক আবেদন অস্তিত্ত্বশীল করা যায়। এ সকল নব্য বাস্তববাদী মনে করেন-` International order is important, but it is a mater of degrees, and there are trade-offs between justice and order.’


খ. রাষ্ট্রীয় নৈতিকতাবাদ: আন্তর্জাতিক রাজনীতি হলো রাষ্ট্রসমূহের একটি সমাজ। বলা হয় যে, `....international politics rests on a society of states with certain rules, although those rule are not always perfectly obeyed.’ সর্বোত্তম শাসন হলো সার্বভৌম রাষ্ট্রের শাসন। যেখানে এক দেশ অন্য দেশের সীমানা অতিক্রম করার আইন লংঘন করতে পারবে না। রাজনীতি বিজ্ঞানী মাইকেল ওয়ালজার যুক্তি দেখান যে, জাতীয় সীমান্তের একটি নৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। রাষ্ট্র সার্বজনীন ব্যক্তি অধিকারের ইশতেহার পেশ করে। আর রাষ্ট্রের জন সাধারণ একত্রে একটি সাধারণ জীবন ধারনের জন্য মিলিত হয়। অর্থ্যাৎ বলা যায় যে, ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ মানেই তার দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি যত্নবান হওয়া। আর এটিই হলো শৃংখলা রক্ষার একটি বড় উপায়। কথায় আছে-`Good ferces make good neighbors.’ বাস্তবিকভাবে গত কয়েক দশক থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এ নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। যেমন- ভিয়েতনাম, চীন, তানজানিয়া, ইসরাইল, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরাক, ন্যাটো প্রভৃতি দেশ ও প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, উগান্ডা, লেবানন, আফগানিস্তান, গ্রানাডা-পানামা, ইরান-কুয়েত ও সার্বিয়ার উপর সরাসরি আগ্রাসন চালায়। অবশ্য ইতিহাসের পরতে পরতে অন্য রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপের নজির পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে একজন বিশ্লেষক বলেন-`Those words are Thucydides’s Melian dialogue with the words `China’ added and `Central Asia’ substituted for sea and border state for islands. Intervention is not a new problem.’ পারস্পারিক বোঝাপড়া, সমঝোতা, শ্রদ্ধাবোধ, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রভৃতি ছাড়া এ ধরনের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া দু:সাধ্য।


গ. সার্বজনীনতাবাদ: চার্লস বেটজ্ এ প্রসঙ্গে বলেন-`International politics not just as a society of states, but as siciety of individuals.’ ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সার্বজনীনতাবাদীরা ব্যক্তি ন্যায়বিচারের উপর জোর দিয়ে থাকেন। বাস্তববাদীরা যেখানে যুদ্ধ ও শান্তির উপর জোর দিয়ে থাকেন এ মতের অনুসারীরা সেখানে বিশ্ব অর্থনৈতিক আন্ত:নির্ভরশীলতা বা বিতরণমূলক ন্যায়বিচারের (ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস) উপর জোর দেন। এখানে জাতীয় সীমানার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। দেশ –সীমানার অসমতা দূর করতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ‘ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস’ প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ সম্পদের পুনর্বন্টন করে বিশ্বব্যাপী সমতা প্রতিষ্ঠা করা। অনেকেই আবার এ মতকে অধিক বিশৃংখলার কারণ হিসেবে দেখছেন। বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ সহজে তাদের সম্পদ বিত্তহীন বা গরিব মানুষের অনুকুলে ত্যাগ বা প্রদান করতে সম্মত হবে না । ফলে সম্পদ পুনর্বন্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিশৃংখলা ও সংঘর্ষের আশংকা রয়েছে। যেমন- ধনী শ্রেনীর মার্কিনীদের যদি গরিব ক্ষুধার্ত সুদানিজ শিশু বা কসোভোর শরণার্থী বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থের ভাগ দিতে বলা হয়, তবে সেখানে বিপর্যয় ও সংঘর্ষ এড়ানো কঠিন হয়ে উঠবে। এর উত্তরে সার্বজনীন মতবাদের অনুসারীরা বলে থাকেন: `Policies can be designed to assist basic human needs and basic human rights without destroying order.’
পরস্পরবিরোধী এ সকল মতামতের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য? সংশয়বাদীরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শৃংখলার প্রয়োজনীয়তা খুঁজেছেন। কিন্তু শৃংখলা ও ন্যায়বিচারের মধ্যে পারস্পারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে তারা এড়িয়ে গেছেন। রাষ্ট্রীয় নৈতিকতাবাদীরা বিশ্ব রাজনীতি কে রাষ্ট্রের একটি সোসাইটি হিসেবে দেখেছেন, যেখানে মুল বক্তব্য হলো: এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তবে কোন হস্তক্ষেপ সুবিদিত হবে তার পরিস্কার রুপরেখা এখানে অনুপস্থিত। তাছাড়া সার্বজনীনবাদীরা আন্তর্জাতিক নৈতিকতাকে ‘ আ সোসাইটি অব ইনডিভিজুয়াল’ বলেছেন, যেখানে সাধারণ মানবতার প্রতি পারস্পারিক সুগভীর শ্রদ্ধাবোধ ও অর্থনৈতিক সাম্যবস্থা বিরাজমান থাকবে। এখানেও চরম অরাজকতা ও বিশৃংখলার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। পরস্পরবিরোধী ও বহুধা বিভক্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির চলক তাই নৈতিকতার সীমানা ছাড়িয়ে আপন মহিমায় ভাস্বর । সেখানে রাষ্ট্রসমূহ সুবিধামত নীতি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন ঘটায়। আর নৈতিকতা-শৃংখলা-ন্যায়বিচার যেখানে নিরবে নিভৃতে কাঁদে। অবশ্যে একজন বিশ্লেষক এক শংকর নৈতিকতাকে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে প্রত্যক্ষ করেছেন-`Most people develop a hybrid position, labels are less important than the central point that there are trade-off among these approaches.’ কিভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমরা নৈতিকতার প্রয়াগ ঘটাতে পারি? সবকিছু নৈতিকতার মানদন্ডে বিচার করে এর উত্তর খোঁজা রীতিমত দু:সাধ্য ব্যাপার। নৈতিকতার প্রয়োগ বিশৃংলা-হানাহানি সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন চলককে ঝুঁকির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে দেয়। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সংগত কারণেই আমরা নৈতিকতাকে উপেক্ষা করতে পারি না। কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কোনো ঘটনাকে পর্যবেক্ষণপুর্বক তার বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে নৈতিকতার চর্চা অনেকাংশে সে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের উপর বর্তায় । এ প্রসঙ্গে বলা যায়-`The enduring logic of international conflicts does not remove the responsibility for moral choices, although it does require an understanding of the special setting that makes those choices difficult.’ তবে সর্বোতভাবে ব্যক্তিগত নৈতিকতা খুবই জরুরী।


০৭.
পরিশেষে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নৈতিকতার অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মূলত প্রাচীন গ্রীক নগর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার পিলোপনেশীয় যুদ্ধের সময় এথেনীয়-স্পার্টান- মেলোনীয়দের বিশেষ নৈতিক প্রশ্নাবলী এবং সংকটসমূহ মোটামুটি বিশ্বজনীন বা ইউনিক। অর্থ্যাৎ সে সময় থেকে অদ্যাবধি প্রায় সমমানের রাজনৈতিক কলা-কৌশল ও সমর নীতি পরিচালিত হতে দেখা যায়। তবে এ সময়ের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন তত্ত্ব-মতবাদ-বিতর্ক। বিতর্কের এ গন্ডীতে বাস্তববাদ বনাম উদারবাদ, নৈরাশ্যবাদ বনাম সার্বজনীনতাবাদ, রাষ্ট্রসমূহের নৈরাজ্যিক পদ্ধতি বনাম আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ প্রভৃতির নিরন্তর অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। একথা সত্য যে, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির কিছু চলক থুকিডাইডিসের সময় বিদ্যমান ছিল না। যথা- পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্র, জাতিসংঘ, ইন্টারনেট, বিশ্বায়ন, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, অবাধ তথ্য প্রবাহ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বহুজাতিক কর্পোরেশন, কার্টেল প্রভৃতি। এসব এজেন্ডা বা সংগঠনের সাহায্যে সনাতন অনেক আন্তর্জাতিক নীতি-পদ্ধতির অভিনব সংস্করণ ঘটেছে। তবে থুকিডাইডিসের পিলোপনেশীয় যুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে হাল আমলের বিশ্বের শক্তিধর দেশ কর্তৃক সিরিয়ায় আগ্রাসন পরিচালনা পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতির অধ্যয়নে রাষ্ট্রসমূহের চরিত্রের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায় না। বরং সহজে বলা চলে যে, থুকিডাইডিসের সময় হতে নৈতিকতার যে সকল প্রশ্ন বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল, তা বিভিন্ন আঙ্গিকে-বিভিন্ন ঢঙে আজও বর্তমান। শক্তিমানের খবরদারি ও দুর্বলের আহাজারি- বিশ্ব রাজনীতির চিরায়ত সত্য হিসেবে মেনে নিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে নৈতিকতার পর্যালোচনায় ইতিহাস ও তত্ত্ব কে পাশাপাশি রাখলে সুবিধা হয়। তাহলেই অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধনে গৃহীত সিদ্ধান্ত-নীতিমালার মধ্যে জ্বলজ্বল করে ওঠে অনাগত ভবিষ্যৎ। সুতরাং বলাই যায়: `The study of international conflict is an inexact science combining history and theory. I weaving our way through theories and examples, we try to keep in mind both what has changed and what has remained constant so that we may better understand our past and our present and better navigate the unknown shoals of the future.’ আর প্রাক্কলিত এ নীতিমালার মাধ্যমেই রাজনীতিতে নৈতিকতার অধিকতর যু্ক্তিযুক্ত মানদন্ড নির্ধারণ করা সহজ হয়।


Source:
01. Naye, Joseph S, Understanding International Conflicts.
02. Huthching, K, International Political Theory: Rethinking Ethics in a Global Era.
03. Jachson, Introduction to International relations.
04. Ethics in International Relation- a Constitutive Theory.
05. Thilly, F, History of Western Philosophy.
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:৫২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×