somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি সাহিত্য সংকলনের আত্মপ্রকাশ

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯। পুরোনো ঢাকার বনেদী আবাসিক এলাকা ওয়ারীর ৩ নং নবাব স্ট্রিটের 'দি অগ্রনী প্রিন্টার্স' নামের একটি মুদ্রন প্রতিষ্ঠান থেকে মুদ্রিত হল একটি সাহিত্য সংকলন।
মুদ্রনে বেশ অনাড়ম্বড় ভাব পরিলক্ষিত হলেও সংকলনটির বিষয়সূচিতে মনোমুগ্ধকর আড়ম্বড়তা বিদ্যমান। খ্যাতিমান রচয়িতাদের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধে দারুণ সমৃদ্ধ সাহিত্য সংকলনটির সূচনা সংখ্যাটি।
শহীদুল্লাহ কায়সারের আমার লজ্জা, আল মাহমুদের সোনালী কাবিন, আহমদ রফিকের মায়া হরিণ, কামরুল হাসানের আমাদের সংস্কৃতি ও আমরাসহ মোট ২১জন রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিত্বের সাহিত্যকর্মের যুথবদ্ধ উপস্থিতি গড়ে দিয়েছে সংকলনটির ব্যতিক্রমী চরিত্রের ভিত। বাংলা লোকশিল্পের সরল ভাবধারা অনুসরণে সংকলনটির প্রচ্ছদ করেছেন হাশেম খান।
কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে, দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন তমসাচ্ছন্ন, তখন এমন একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশের দুঃসাহস কে দেখায়? কে দেখায় পরিবর্তনের প্রাণরসে উজ্জীবিত রচয়িতাদের সাহিত্যকর্ম সম্পাদনার স্পর্ধা?
এই দুঃসাহসী প্রকাশক, চেতনার শিখরস্পর্শী স্পর্ধায় অনুপ্রাণিত সম্পাদক শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন। তাঁর অনন্য প্রয়াস শিলালিপি নামের এই সাহিত্য সংকলনটি সূচনালগ্ন থেকেই ধারণ করেছিল বাঙালির মুক্তি আকাঙ্ক্ষাকে, বহুপ্রার্থিত স্বাধীনতার সুপ্ত চেতনাকে।



১৯৬৯ থেকে ১৯৭০- অনিয়মিতভাবে হলেও শিলালিপি প্রকাশের কষ্টসাধ্য চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন সেলিনা পারভীন।
১৯৭১। বাঙালি জাতিস্বত্ত্বার সাথে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরোধ চূড়ান্তে পৌঁছল। সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হল মার্চের শেষপাদে। স্বাভাবিকভাবেই কালো তালিকাভুক্ত হল শিলালিপি। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ তলব করল সেলিনা পারভীনকে। পাকিস্তানি ভাবধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রচনায় সাজিয়ে নব আঙ্গিকে শিলালিপি প্রকাশের পরামর্শ দিলো কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেলিনা পারভীন সেই পরামর্শ অগ্রাহ্য করলেন। স্বাধীনতার অম্লান চেতনাকে সমুন্নত রেখেই পরিকল্পনা করলেন শিলালিপি প্রকাশের। বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন স্বপ্নভূমির পতাকা এবং একটি শিশুর ছবি দিয়ে তৈরী হল শিলালিপির আগস্ট সংখ্যার প্রচ্ছদ। সেলিনা পারভীনের এই ধৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হল পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে। বিপুল সংখ্যক বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশায় তারা যুক্ত করল সেলিনা পারভীনের নামও।

১৩ ডিসেম্বর। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানিরা। বেতারযন্ত্রে কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনীকে বাস্তবতা মেনে নেবার আহবান জানানো হচ্ছে বারবার। আত্মসর্মপণের নির্দেশ লেখা লিফলেট প্লেন থেকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে ঢাকায়। ১১৫, নিউ সার্কুলার রোডের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এদৃশ্য দেখলেন সেলিনা পারভীন। কান পেতে শুনলেন কোন আওয়াজ! হ্যাঁ, বিস্ফোরনের আওয়াজই হবে এটা! শোনা যাচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক বাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ঢাকাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
স্বাধীনতার কথা ভাবতেই ভীষণ খুশিতে ভরে উঠল সেলিনা পারভীনের মন। অনাবিল এক সুখের দোলা লাগল হৃদয়ে। শীতের সকাল। ঘড়ির কাঁটা ১০টা অতিক্রম করেছে সবেমাত্র। এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে ছাদের সমতলক্ষেত্রটিতে। সোনামাখা সেই রোদ শরীরে মেখে খেলছে সেলিনা পারভীনের একমাত্র শিশুপুত্র সুমন জাহিদ। কাছে এগিয়ে শিশুপুত্রকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিলেন সেলিনা পারভীন। ছাদ থেকে নামলেন নিচে। স্বাধীন স্বপ্নভূমির কথা ভাবতে ভাবতে স্নান করালেন পুত্রকে। তারপর এক অভূতপূর্ব আচ্ছন্নতা নিয়ে প্রবৃত্ত হলেন রান্নার আয়োজনে।
দুপুর আনুমানিক ১টার দিকে ই.পি.আর.টি.সির ছোট একটি গাড়ি এসে থামলো সেলিনা পারভীনের বাসার সামনে। রুমালে মুখ ঢাকা কিছু লোক গাড়ি থেকে নেমে অস্থির ভঙ্গীতে হেঁটে এসে দাঁড়াল সেলিনা পারভীনের দরজায়। তারপর কড়া নাড়ল।
কড়া নাড়ার রুক্ষ শব্দে শংকিত হলেন সেলিনা পারভীন। সাদা শাড়ি পরনে ছিল তাঁর। অসম্ভব শীতকাতুরে তিনি। তাই পা-জোড়াও মোড়ানো ছিল সাদা মোজায়। পরিধেয় বস্ত্রের শুভ্রতা যাতে তেল-নুন-হলুদ মাখা হাতের স্পর্শে নষ্ট না হয়, তাই তিনি একটা গামছা রেখেছিলেন রান্নাঘরে। সেই গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুললেন সেলিনা পারভীন।
মুখ ঢাকা লোকগুলোর নিষ্ঠুর চোখ। দরজা খোলার সাথে সাথেই নাম জানতে চাইল তারা। দুশ্চিন্তায় ভ্রু-পল্লব কুঞ্চিত করে নাম জানালেন সেলিনা পারভীন। এরপর আর দেরী করল না লোকগুলো। শিশুপুত্র সুমন জাহিদ, ভাতৃসম ওয়াজিরুল ইসলামের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনেই তারা ঘিরে ধরল সেলিনা পারভীনকে। হাতে থাকা গামছাটা কেড়ে নিয়ে চোখ বাঁধল তাঁর। তারপর গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল অজানা গন্তব্যে।

১৪ ডিসেম্বর। চোখ বাঁধা অবস্থায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হল সেলিনা পারভীনকে। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক সেই বধ্যভূমিতে হাজির করা হল তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের একটি বিরাট অংশকেও। পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর আলশামসদের সশস্ত্র সহযোগিতায় সবাইকে দাঁড় করানো হল সারিবদ্ধভাবে। তারপর উপস্থিত হল সেই ভয়াবহ লগ্নটি। অকম্পিত হাতে গুলি চালাল ঘাতকরা। সেই গুলিতে সেলিনা পারভীনসহ আমাদের প্রাণের মানুষগুলোর জাগতিক উপস্থিতির বিলোপ ঘটলেও তাঁদের চেতনার দীপশিখায় ভাস্বর বাঙালি অর্জন করল একটি নতুন মানচিত্র, একটি নতুন পতাকা, স্বাধীন-সার্বভৌম-চিরসবুজ একটি দেশ।

ছবি: সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৫৩
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন পারাবার: শঠতা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪০


অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাশ করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।

স্কুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×