somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নিষ্প্রভ বর্তমানে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালের বেশির ভাগ ঘটনার বর্ণোজ্জ্বল বুননকে গল্পই তো বলব আমরা! বাস্তবের নির্ধারিত বিস্তারকে হার মানিয়ে গড়ে ওঠা অসংখ্য গল্প নিয়েই রচিত হয়েছে আমাদের মহাকাব্যিক সময়। সেই মহাকাব্যিক সময়ের কিছু কিছু অধ্যায়ের কথা সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে আনতে ইচ্ছে হয় আমাদের। ইচ্ছে হয় পূর্বপুরুষের বিশেষ কীর্তিগুলোর কিয়দংশ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ভাবতে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর থেকে ২৭ মার্চ সন্ধ্যার ভেতর বেতার মাধ্যমে বেশ কয়েক দফায় স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার মধ্য দিয়ে বাঙালির আনুষ্ঠানিক প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলো। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সব যুদ্ধ-প্রয়াসই ছিল বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন, সমন্বয়হীন এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবিবর্জিত। বিঘোষিত স্বাধীনতা বাস্তবায়নে প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ রাজনৈতিক পরিকল্পনার অভাবে সব সমরক্ষেত্র ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। এই দ্বিধাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে ঢাকা ত্যাগ করলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা তাজউদ্দীন আহমদ। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর পৌঁছালেন তিনি। ২৯ মার্চ রাতে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সহযোগিতায় সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম। তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করলেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মহাপরিদর্শক (আইজি) গোলোক মজুমদার। গোলোক মজুমদারের কাছে সংবাদ পেয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান কে এফ রুস্তামজি পথশ্রমে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তারপর দ্রুত তাঁদের দিল্লি পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন তিনি।

দিল্লি পৌঁছানোর পর ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা হলো তাজউদ্দীন আহমদের। আলোচনা হলো ইতিমধ্যেই ভারতে আসা দলীয় নেতাদের সঙ্গে। ৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ হলো তাঁর। পরিকল্পনামাফিক বৈঠকে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বৈঠকের সূচনাতেই তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে জানালেন, বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রদানে অনিচ্ছুক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেনা আক্রমণ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়েছে এবং গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড হিসেবে পরিচিত প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাচিত প্রবীণ সদস্যরাই মন্ত্রিসভার সদস্য। বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতার লড়াইয়ে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদের এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী দেশটিকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক শেষে ভারতে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা সভায় মিলিত হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১০ এপ্রিল শিলিগুড়ির অনিয়মিত এক বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে দেওয়া বেতার ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করলেন। পরদিন ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণীতে এই বেতার ভাষণ একাধিকবার প্রচারিত হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি (তিনি পরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন), তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান।

১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সেদিন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের সীমান্তসংলগ্ন গ্রাম বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে আয়োজিত হলো মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সকাল নয়টা থেকেই সেখানে শুরু হলো আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন। দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিকও উপস্থিত হলেন অনুষ্ঠানে। বেলা ১১টায় শুরু হলো অনুষ্ঠান। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হলো শুরুতেই। তারপর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে মাগুরার মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা মাহাবুব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একদল ইপিআর, পুলিশ ও আনসার গার্ড অব অনার প্রদান করল।



ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর তিন সহকর্মীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সর্বসমক্ষে। অনুষ্ঠিত হলো শপথ গ্রহণ। নতুন রাষ্ট্রের প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নাম ঘোষণা করা হলো। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। এরপর বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করলেন। অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিসমাপ্ত হলো বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানস্থল বৈদ্যনাথতলার নাম মুজিবনগরে পরিবর্তিত হলো সেদিন থেকেই। সম্পন্ন হলো একটি প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ রাজনৈতিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন।


ছবি: সংগৃহীত



সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:১৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×