somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিভৃত সুরের ব্যঞ্জনায় 'ভেতরে উদগম ভেতরে বৃষ্টিপাত': কাব্যবিশ্লেষণ

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :






একবিংশ শতাব্দীর এক নিভৃতচারী কবি মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি মূলত কবি। শিশুদের যেমন পুতুল খেলার সাথে সখ্য, তেমনি কবিতার সাথেই কবি মোহাম্মদ হোসাইনের সখ্য। দিনমান কবিতার নান্দনিকতা নিয়েই পার করেন। কবিতার রাজ্যে হাঁটিহাঁটি পা পা করে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘপথ। চিল যেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে শিকার খোঁজে কবি মোহাম্মদ হোসাইনও তেমনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকৃতিকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে তথা মানবজীবনকে অবলোকন করেন। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই তাঁর কাব্যের পংক্তির ভাঁজে ভাঁজে। বিষয়-আশয়, বৈচিত্র্য-ভিন্নতা সবই আছে তার কবিতায়। তিনি বেদনাকে উচ্চারণ করেন প্রকৃতির অনুসঙ্গে, আনন্দকে উচ্চারণ করেন বিনয়ের উষ্ণতায়। কিন্তু চিন্তা চেতনায় স্বদেশ- আন্তর্জাতিকতায় বর্ণাঢ্য উজ্জ্বল এই কবি কাউকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য নয়, নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছেন এক কাব্য থেকে আরেক কাব্যে।

রংধনুতে সাতটি রঙের মধ্যেই যেমন আলাদা স্বাতন্ত্র্যতা রয়েছে তেমনি স্বাতন্ত্র্যতা রয়েছে কবি মোহাম্মদ হোসাইনের কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে। কবি মোহাম্মদ হোসাইনের পঞ্চম কাব্য ‘ভেতরে উদগম ভেতরে বৃষ্টিপাত’। এটি ২০০৬ সালে মহান একুশে বইমেলায় স্বরব্যঞ্জন কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। এতে মোট ৬০টি কবিতা আছে। উৎসর্গ করা হয়েছে সুহৃদ, কবিতাপ্রেমি ও কবিতার পৃষ্ঠপোষকদের।

কবি মোহাম্মদ হোসাইনের কবিতার মধ্যে রয়েছে নিজস্ব ঢং। তাঁর ‘ভেতরে উদগম ভেতরে বৃষ্টি’ কাব্যে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠেছে।

ক. প্রতীক ব্যঞ্জনা
খ. শিল্পবোধ
গ. প্রকৃতির সান্নিধ্য কামনা
ঘ. স্বপ্ন বুনন
ঙ. আত্মক্ষরণ
চ. দেশপ্রেম
ছ. কল্পনার উচ্ছ্বাস
জ. নীরবতার প্রচ্ছদপট
ঝ. দেশী শব্দের উপকরণ
ঞ. প্রকৃতি ধ্বংশের চিত্র
ট.শব্দ বৈচিত্র্য
ঠ. ভাবের গভীরতা
ড.শ্রেণি বৈষম্যে স্বরূপ
ঢ. পরমাত্মার সাহচর্য,
ণ. আত্ম নিবেদন
ত. সমকালীন চিত্র
থ.বিবিধ


কবি মোহাম্মদ হোসাইন প্রতীকী ব্যঞ্জনার মাধ্যমে বিষয়বস্তুর মূল নির্যাস স্পষ্ট ফুটিয়ে তোলতে সর্বদাই বিজ্ঞের পরিচয় দিতেন। মানুষ শিল্পবোধ সম্পন্ন প্রাণী। এই শিল্পবোধের জাগ্রত অনুভবের হাত ধরে আদি অনুন্নত আদিম সমাজ থেকে মানুষের বর্তমান আধুনিক রুপ। শিল্প অর্থ সুন্দর, সুন্দর করে সাজানো, আর যিনি সুন্দর করে কোন কিছু সাজান তিনি শিল্পী। অপার সুন্দরকে জানার, সুন্দরকে বুঝার ক্ষমতা যার যত বেশি তার শিল্প-সৌন্দর্যবোধ বা শিল্পবোধ তত বেশি । সেই প্রাচীন কাল থেকে মানুষ সৌন্দর্য চেতনায় নিজেদের আপ্রাণ নিয়োজিত রেখেছে, সুন্দর করে থাকতে চেয়েছে, বাচঁতে চেয়েছে ।

কবি মাত্রেই শিল্পের পূজারি, সুন্দরের পূজারি। কবি মোহাম্মদ হোসাইন এ থেকে মোটেও ব্যতিক্রম নন। তিনিও কবিতার পংক্তির ভাঁজে ভাঁজে শিল্পের বুনন করে চলেন নিষ্ঠাবান কৃষকের মতো। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, "শিল্প হচ্ছে তাই যা নিছক প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি তাগিদ থেকে মানুষকে চালনা করে, শিল্প সৃষ্টিতে নিযুক্ত করে"।

শিল্প শব্দটি প্রায় মানব সভ্যতার মতোই সুপ্রাচীন। আরেকটু সুনির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়। যেদিন থেকে মানুষ শিক্ষিত হল, শিল্পচর্চা শুরু করলো তবে থেকেই আমরা মানুষের সভ্যতার ইতিহাসকে গণনা করে থাকি।


শিল্পের ধারণাও বিশাল একটি বিষয়। শিল্প হতে পারে ধ্যান, যেমন ক্রোচে মনে করতেন, শিল্প হতে পারে কল্পনার প্রকাশ যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “শিল্প হতে পারে বিস্ময়ের প্রকাশ যেমন বৈদিক ঋষিরা তাদের সূর্যমন্ত্রে বর্ণনা করেছেন, “শিল্প হতে পারে ব্যক্তিত্বের লুপ্তি এবং আবেগের প্রস্থান” যেমন এলিয়ট মনে করেছেন— "poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion (tradition and the individual talent)".

কবি মোহাম্মদ হোসাইনের কবিতাগুলো কেবল নিছক কবিতা নয়, তা যেন সত্যিকার অর্থেই এক একটি শিল্প! তাঁর কবিতা পাঠককে যেমন বিস্ময়ের ঘোরে ফেলেন, তেমনি স্বাতন্ত্র্য স্বাদ আস্বাদনেও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাঁর প্রথম কবিতাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কাব্যিক শিল্পবোধ।

প্রতীকী ব্যঞ্জনার সাহায্যে জালের ভেতর দিয়ে মূলত সাহিত্যে ভাণ্ডারকেই বোঝাতে চেয়েছেন। তাঁর পুরো কবিতার শরীর জুড়ে যেন নিভৃত শিল্পের হাতছানি, চিত্রকল্প নির্মাণেও তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত।

জাল ফেলি নদীতে
মাছ নয় শব্দের নুড়ি, ছিন্নপাতা
ওঠে আসে।
----------------------------
জাল ফেলি নদীতে
মাছ নয় জলগুলো হাঁস,
হাঁসগুলো চিত্রকল্প
পঙক্তি মোড়ানো কবিতারস।

উৎস: জাল

প্রকৃত কবি সর্বদাই তাঁর কাব্যে কল্পনার সাহচর্যে শিল্পের অনুভব করে থাকেন। মূলত একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে খেয়াল করলে স্পষ্ট দেখতে পাবো যে, শিল্পের বিকাশ ঘটছে প্রতিনিয়ত। একটি গাছের তুলনা দিয়ে বলা যায়, গাছের গুড়ি থেকে সমগ্র গাছটির প্রকৃত রূপ চেনা যায় না। ডব্লিউ. বি. ইয়েটস (W.B. Yeats)-এর কবিতায় পাই: O chest-nut tree, great rooted blossomer, Are you the leaf, or the blossom or the bole? O body swayed to music, O brightening glance, How can we know the dancer from the dance? (Among School Children).

চেষ্টনাট গাছের পাতা, ফুল বা কাণ্ড কোনোটাই যে গাছের সম্পূর্ণ প্রকাশ নয়, সমগ্র গাছটাই চেষ্টনাট বৃক্ষ। তেমনি শিল্পীকে তার শিল্প থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। নৃত্যশিল্পীকে নৃত্য থেকে আলাদা করা মূঢ়তা। শিল্প ও শিল্পী, বিষয় ও বিষয়ীর সমীকরণে হয় শিল্প। আর এ কারণেই কবি ও কবিতা হচ্ছে অবিচ্ছেদ্য, সূর্যের সাথে যেমন আলোর সম্পর্ক তেমনি কবিতার সাথেও কবির। আর কবিতা মানেই প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ নিয়ে নিটোল শিল্প সৃষ্টি। এককথায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে কবির কবিতা হয়ে উঠে বর্ণময়, গন্ধময়, আলোকময়।
শিল্পের অঙ্কনে কবির তুলিতে নারী প্রকৃতিও বাদ যায়নি। বরং তা আরও নিঁখুতভাবে ফুটে উঠেছে। কবির কবিতার ভাষায়-

“নারীর বুকে বুক রাখি
উষ্ণতা, ঢেলে দিই ঠোঁটে, নেমে যাই গভীরে গহনে
তখন ভেতরে বৃষ্টিপাত
তখন ভেতরে অঙ্কুরোদগম
এই বৃষ্টিপাত এই উদগম কবিতা”।


মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত মিটাতে হয় জীবন চাহিদা, করতে হয় নিরন্তর সংগ্রাম। আর তাতে করে মানুষকে সহসাই ব্যর্থতা ও সফলতার মুখোমুখি হতে হয়। ফলে সে অনেকটা বাধ্য হয়ে জীবন থেকে শিক্ষা নেয়, শিক্ষা নেয় প্রকৃতি থেকে। হৃদয়ের উৎকর্ষের সাথে সাথে পাল্লা করে বাড়ে মানুষের প্রত্যাশা, যদিও প্রত্যাশার জয়ভেরি সর্বদা গুঞ্জন তোলে না। প্রাপ্তির অপ্রতুল্যতাও জীবনকে নতুন রূপ দেয়, নতুন করে ভাবতে শিখায়, জীবনের স্বরূপ অন্বেষণে আরও চিন্তাশীল করে তোলে। কবির কাব্যের শৈল্পিক উপমায় সে রকমই যেন চিত্র স্পষ্ট দেখতে পাই-

“নির্মল ঘাসের দেশে ওঠে মরুঝড়
অতিথি পখির চোখ আটকে থাকে
অন্ধকার আঁধারের তূণে
ধোঁয়াটে দৃষ্টির ফাঁকে রোদ যেন হলুদ ঘষা কাঁচ
কিশোরীর উঠান জুড়ে থইথই মেঘ
ভেজা নিঃশ্বাস”।

উৎস: শ্রাবণ সন্ধ্যা,


“ঘুমের ভেতরে নদী কবিতায় স্বপ্ন, প্রকৃতির জৌলুস্য, রোদ কুড়ানোর চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। কবির কবিতায় উপমার ব্যবহারগুলোও কিন্তু সত্যিই চোখে পড়ার মতো। নিচের কবিতাত্রয়ই তার প্রমাণ রাখে-

“টিলার ওপর রাত নামে
টিলাগুলো মানুষের মতো একা
খণ্ড খণ্ড ছবি, দৃশ্যান্তর নিয়ে
জীবনে কত কী ভেবে রেখেছি, তলপাইনে”।

উৎস: জারুল গাছ, রোদ ও রাতের কাব্য

“তখনই সন্ধ্যা নামে
প্যারাসুটের মত আস্তে আস্তে নামে রাত্রির অস্ফুট অন্ধকার”।

উৎস: খুঁজে ফিরি সুবর্ণগ্রাম

“ওতোপ্রোত অন্ধকার নিয়ে বসে আছি
অন্ধকার আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে
-------------------------------
আমি চিরদিন রাত্রির গায়ে
রাত্রি হয়ে থাকি
আমি চরিদিন আকাশের গায়ে
আকাশ হয়ে থাকি”।

উৎস: রাত্রি


মৃত্তিকা সন্ধ্যানী কবি মোহাম্মদ হোসাইনের কবিতায় একদিকে যেমন প্রকৃতি প্রেমের সুঘ্রাণ মেলে তেমনি দেশপ্রেমেরও নিদর্শন মেলে। কবির ব্যক্তিজীবনের নীরবতার প্রভাব পড়েছে কাব্যেও। দেশীয় কাদা মাটির রূপ রস গন্ধ নিয়ে কবি নিজেকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছেন পূর্ব সত্ত্বায়।

“আমি যেন প্রাচীন কৃষক
আমাকে আকঁড়ে ধরে দু’ধাল শীষ,
স্নেহের জাতক!
চোখে জল আসে, আকাশ প্রলুব্ধ চাতক,
সবুজ পাতার ভেতরে মুগ্ধ বিস্ময়
সতীর্থের টানে আচমকা উড়ে যায়
হেমন্তের বাতাস
শৃঙ্খলা ফিরে আসে ঘরে”।

উৎস: কচি ধান কচি মেয়ে আমার


মৃত্য উপত্যকা ও একটি উট পাখির গল্প কবিতায় নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংশ, বুর্জোয়াদের স্বৈরাচারীতা, হতাশার অঙ্ক অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

কবি কবিতায় শব্দচয়নে যেমন দক্ষতার, বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি প্রতিটি কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রেও তিনি অনেকটাই সফল।

“বোধের গভীরে চিত্রকল্প আঁকি
চিনে নেই মূল সুর প্রকৃতিপাঠে
প্রাচীন ঐতিহ্যে খুঁজি ঘ্রাণ শিকড়ের সৌকর্যের
পথ হাঁটি, নুড়িজল বুকে ধরে রাখি
নিভাঁজ অন্ধকারে ভেজাই শরীর
ছড়ানো বীজে দেই তা
হাতে উঠে আসে উদগম আলোর

অবশেষে দেখি শব্দেরা বৃক্ষ হয়ে যায়… ”।


সময় নদীর মতোই বহমান। সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই খুব দ্রুত ম্লান হয়ে যায় মহাকালের স্রোতে। সত্য ও সুন্দরের ক্ষুধায় ব্যয় হওয়া স্মৃতিময় দিনগুলো ক্রমেই যেন হারিয়ে যায় জীবনের পরিক্রমা থেকে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্রতীকী ব্যঞ্জনায় এমনই চিত্রকল্প কবি ফুটিয়ে তোলেছেন তাঁর কবিতায়।

“আকাশের ছায়া পড়েছে আমার চোখে ও মুখে
পার্কের বেঞ্চিতে ঝিমুচ্ছে বিগতদিন
বেমক্কা ড়ৌড়ুচ্ছে রোদ
ওড়নায় ঝলকাচ্ছে শেষ বিকেলের স্মৃতি
পাখিদের ঠোঁটে রতিবিলাসের গন্ধ
হৃদয়ে আচমন বর্ষা অরুন্ধতী”।


‘প্রকৃতি পাঠ’ কবিতায় প্রকৃতির অন্তরঙ্গ অনুভব, নিবিড় ছোঁয়ার দিকটিই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর কয়েকটি কবিতায় তিনি ‘কখনো কখনো’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করেছেন; যদিও শব্দদ্বয় ওভাবে ব্যবহার না করে করে কখনো সখনো দিলে আরও বেশি উপযুক্ত বা মানানসই হতে পারতো।

“চা শেষ হয়ে গেলে
আড্ডার রং ফিকে হয়ে যায়
-------------------------------
কখনো কখনো আড্ডা
রোদের মাখন বিলি করে
রেকাবিতে কবিতার পাপড়ি গুঁজে রাখে
শব্দের পাখনায় ভর করে মোহন সারস”।


‘পাতা জীবন ধুলো জীবন ‘কবিতায় কবি মূলত বাহারি শব্দের চাষ করতে চেয়েছেন। কবিতার বিষয় বস্তুর সাথে মিল রেখে তাঁর নামকরণগুলো সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। প্রতিটি নামকরণই যেন হয়ে উঠেছে শৈল্পিক। শিল্পের ছোঁয়া থাকলেই যে কোন কিছু শৈল্পিক হয় এ তো সকলেরই জানা।

শিল্প বিষয়টি মানব-সভ্যতার উন্মেষের সমানুপাতেই রূপ লাভ করেছে। অর্থাৎ যতদিন মানুষের সভ্যতার প্রকৃত বিকাশ ঘটেনি ততদিন সে নিষ্ঠুর প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে শুধু মাত্র জীবন ধারণের জন্য ব্যাপৃত ছিল। যবে থেকে মানুষ তাঁর জীবন ধারনের সমস্যা কিছুটা দূর করতে পারল, তখন থেকেই জীবন এবং জগতের সৌন্দর্যের বন্ধ কামরার জানালাগুলো খোলতে শুরু করলো। সময় সচেতন কবি নিজের ইচ্ছে মতো শব্দ নিয়ে খেলেছেন। আর এ কারণেই তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে এত শব্দ শিল্পের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।

“ফাঁদ পেতে রেখেছে চাঁদ
আমি পা হড়কে পড়ে যাই
বাতাসে ফ্রয়েডিক নুন, উষ্ণ অভ্যর্থনা
আমার শরীর কাঁপছে, দূরে চটকাচ্ছে কামার্তমেঘ
কেউ জেগে নেই, কালঘুমে অবিন্যস্ত শহর”।


মর্ম, কৃহক, প্রকৃত কবিতাগুলো কলেবরে ছোট হলেও বেশ অর্থপূর্ণ। বিস্তর বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে। জীবন নিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসাও কম নয়; রোমান্টিক সত্ত্বাই কবিকে ভেতরে ও বাইরে নিরন্তর ভাবুক ও চিন্তাশীল করে তোলেছে। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিও তাঁর যেমন টান রয়েছে তেমনি টান রয়েছে শিল্পীদের প্রতিও। কবির কবিতার ভাষায়-

“রাত্রির ভাষা নিরর্থক নয়
অহেতুক, কেন তুমি রাত্রিকে কাঁদাও।
-----------------------------------
জলের রহস্য কোনদিন খোঁজে না কেউ
জীবন রহস্য খোঁজে ফেরে লালন
অনন্তকাল”।

উৎস: গুচ্ছ কবিতা

মাঝে মাঝে সমস্ত বিশ্বভ্রমাণ্ডকেই বড় অচেনা মনে হয়, অদ্ভুত আর অপরিচিত মনে হয় নিজেকে। স্বীয় সত্ত্বাকে চিনাই বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। জাগতিক অপ্রয়োজনীয় ও লোভনীয় কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রেখে হৃদয়কে কলুষ করে তুলি। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হল প্রত্যেক মানুষেরই একবার না একবার বোধোদয় ঘটে। তখন সে মহাশক্তির কাছে নিজেকে নিবেদন করে। যাকে বলে আত্মনিবেদন। আকুন্ঠচিত্তে সমর্পণ করে। কবির ভাষায়-


“এই নাও আমাকে
গেঁথে ফেলো
বহু পাপ করেছি এ জীবনে
বহু কলঙ্ক
একমাত্র আমিই কালো কালিতে ভরে দিয়েছি পৃথিবীর সমস্ত এ বনবাদাড়
যেটুকু বিষ
যেটুকু গড়ল
এ আমারই প্রশ্বাস”।

কবিতার মধ্যে কবির আত্মক্ষরণের চিত্রও অপ্রত্যাশিত নয়। স্বর্ণ পুড়েই যেমন মৌলকিতা লাভ করে তেমনি কবিও বাস্তবতার যুপকাষ্ঠে জর্জরিত হয়ে সিদ্ধি লাভ করে। তবুও বলা যায়, ক্ষুধা মেটাবার খাদ্য কবিতা তো নয়। তাহলে প্রশ্ন, কবিতার দায় কোন প্রয়োজন মেটানো এবং সেটা কে ঠিক করে দেবে? পাঠকের সঙ্গে কবির বোঝাপড়াটাই-বা কেমন হবে?
জগৎ বিখ্যাত ফাউস্ট-এর প্রস্তাবনায় গ্যাটে এমন একটা টেনশন ও টানাপড়েন হাজির করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার’। এ আনন্দ সৃষ্টির, এ বেদনা প্রকাশের–এর বাইরে কোনো দায় নেই কবির।

“প্রতিদিন যে রাত নামে পৃথিবীতে
এ আমারই দুঃখের দীর্ঘ পরিণাম
তারা জ্বলে জ্বলে ক্ষয় হয়
তারা কী জ্বলে কখনো
এতো কবির হৃদয়রেই লুকানো প্রজ্জলন”!

উৎস: সোনালি ঈগলের ডিম

“অকস্মাৎ মুকুলিত ভোর খোলস বাঙ্গে
ফুটফুটে ছানার মত দৌড়ে যায় লালবর্ণ সূর্যশাবক
গোলাকার বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে দিনের রাখাল”

উৎস: সূর্য শাবক


‘অভিমান’ কবিতাটিতে রোমান্টিকতা ফোটে উঠেছে। ভাষার বুনন সত্যিই পাঠকে মুগ্ধ করে। মানব জীবনের সূক্ষ্ম রুচিবোধও তাঁর কবিতায় লনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ফোটে উঠেছে।

বিশ্বাস শব্দটি বড়ই প্রাচীন এবং অদ্ভুত। এই পৃথিবীতে কম বেশি সাত বিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। মানুষের ভিতর দুটো সত্ত্বা সার্বক্ষণিকভাবে কার্যকর থাকে। পানির সংগে চিনি মেশালে নতুন যে তরলের উদ্ভব হয় তার নাম ভিন্ন কিন্তু ঐ তরলের মধ্যেই পানি এবং চিনি রয়েছে। মানব জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগের জন্যই মানবের মধ্যে জীবাত্মা রয়েছে এবং পরমাত্মাও রয়েছে এবং এই দুয়ে মিলেই মানুষ নিজেকে মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করে। প্রকৃত পক্ষে পানি এবং চিনির মতোই দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী সত্তার সহবস্থানের ফলশ্রুতিই মানব।
এই দুই সত্তার যে কোন একটির অবর্তমানে মানব আর মানব নামে চিহ্নিত হবে না। আমি বলতে একমাত্র মানবই সক্ষম। মানব ব্যতীত অন্য কোন প্রাণিসত্ত্বা আমি বলতে সক্ষম নয়। জীবজগৎ মুখ থেকে শব্দ উৎপন্ন করতে পারে কিন্তু আমি বলতে ওরা অক্ষম। কবির কবিতাতে এমনই দার্শনিক তত্ত্ব উঠে এসেছে।

“জীবতত্ত্বে বিশ্বাস করি।
মাটির দেহ মাটিতে মিশে যাবে এ কথা ধ্রুব সত্য;
অথচ আমি থেকে যাবো এ পৃথিবীর প্রতিটি কণায়
অণুতে অণুতে পরম বিস্ময়ে”।

উৎস: জীবতত্ত্ব


কবির কবিতা যেমন দেশ কালের উর্ধ্বে তেমনি কবিও কেবল যে দেশে জন্মেছে সে দেশের নয়। কবি সার্বজনীন মানুষের, কবি সকল দেশের, সকল কালের। এ সম্পর্ক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উক্তি স্মরণীয়- “ আমি এই দেশে জন্মেছি বলে কেবল এই দেশের নই, আমি সকল যুগের, সকল মানুষের…। কবি মোহাম্মাদ হোসাইনের কবিতাদ্বয়ের মধ্যেও এমনি সুরের প্রতিধ্বনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।


“একদিন পবিত্র মাটিতে ফিরে যাবো
হয়ে যাবো ধূলিকণা স্বদেশের
----------------------------
আমার শরীরের কোষে কোষে হবে অদ্ভুত প্রত্ন ফসিল”।

উৎস: প্রতিভূ

কবির কোন প্রকৃত স্বদেশ নেই
সারা পৃথিবীই তার প্রিয় জন্মভূমি
মৃন্ময় স্বদেশ।
তবু সন্ধ্যে ফিকে চায়ের মত হলে
মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়াই, আকাশের গায়ে
হেলান দেই।

উৎস: কবির স্বদেশ

নিভৃতের দুয়ার ভেঙ্গে মোহাম্মদ হোসাইন কলম চালিয়েছেন নিজের মতো করে। আত্মবিশ্বাসী কবি শব্দ নিয়ে খেলেছেন। নিজের মতো করে বুনন করেছেন কবিতার কলাবাগানে। তাঁর কাব্য পাঠে শব্দচয়নের ঝংকার হৃদয়ে আঁচর কাটে। কবিতা পাঠ শেষ হয় তবুও যেন তার রেশ রয়ে যায় সৃজনশীল পাঠকের মনে মননে মনীষায়।


----------------------
মুনশি আলিম
২2-০৮-২০১৫__২৩-০৮-২০১৫
ইমেইল: [email protected],
শিবগঞ্জ, সিলেট

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:২৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×