১)আল-মাহমুদের দৃষ্টিভঙ্গি মডার্নিস্ট। অর্থ্যাৎ , তিনি মডার্নিস্টদের মতোই ‘শরীর’কে জ্ঞানের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ চিন্তায় শরীর ও মনকে আলাদা করে দেখানো হয় এবং খুব জটিলভাবে শরীরকে মনের তুলনায় উপরে স্থান দেয়া হয়। অথবা এমনভাবে মনের অস্তিত্বকে প্রমাণ করা হয় ( দেকার্ত যেমন ) যেখানে মাইক্রোস্কোপিক বা আনুবীক্ষণিক পরীক্ষার পদ্ধতি ( যা কিনা আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি ) অনুসরণ করে যুক্তি সাজানো হয়। এর ফলে দেকার্ত যে পদ্ধতিতে মনের অস্তিত্ব খুঁজে পান, তা আমাদের কাছে আপাত দৃষ্টিতে শরীরনির্ভর মনে না হলেও , একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে যে, দেকার্তের চিন্তাপদ্ধতি হলো আধুনিক বিজ্ঞানের মাইক্রোস্কোপের ‘Gaze’ এর মতোই। এই গেজ বা দেখা পুরোমাত্রাতেই সাবজেক্ট ও অবজেক্টের বিভাজন ( যা কিনা আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান ভিত্তি ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত । আধুনিক নৃবিজ্ঞান দেহ বা শরীর বা আকার ও প্রকারগত ব্যাপারসমূহের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এসব চিন্তার পথ ধরেই। ফলে , দেহ সবসময়ই আধুনিক ইতিহাস , রাজনীতি , বিজ্ঞান , অর্থনীতি , চারুকলা ইত্যাদি ইত্যাদির প্রধান ফোকাস হয়ে আছে । বলা বাহুল্য , এই দেহ আধুনিক জমানার ‘দেহের ধারণা’ যেখানে দেহকে ব্যবহার বা এক্সপ্লোয়েট এবং কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় । ইংরেজিতে বলা যাক , যেখানে Docile body বা জ্ঞানদ্বারা নিয়ন্ত্রিত ( মেডিক্যাল , মনোবিজ্ঞান, সাহিত্য ,রাজনীতিবিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি ) দেহ উৎপাদন করা যায় ।
২) নৃবিজ্ঞান এর ফলে আধুনিক ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার তাত্ত্বিক ক্ষেত্র তৈরির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার সহায়ক জ্ঞানতত্ত্ব হিসেবে নৃতত্ত্ব এবং সাহিত্য ও অপরাপর জ্ঞানের সোর্সসমূহ উদ্ভূত হয়েছে ।
৩) সেদিক থেকে আল মাহমুদের সোনালী কাবিন মডার্নিস্ট প্যারাডাইম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । তিনি বাঙ্গালীর এক কন্টিনিউয়াস নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের বর্ণনা প্রদান করেন এতে। ফলে, মনে হয় যে, এ ভূখন্ডের একজন ব্যক্তি ইতিহাসে নানাসময় অনার্য, হিন্দু , বৌদ্ধ , মুসলমান ও খ্রিস্টান হয়েছে । এখানে ‘বডি’কে ইতিহাস দ্বারা সুরক্ষা দেয়া হয়েছে এবং মানসিক পরিবর্তন বা ওয়ার্ল্ড আউটলুককে ( হিন্দু বা মুসলমানের জগত সম্পর্কে আলাদা আউটলুক, তাদের জগতের সাথে সম্পর্ক , কসমিক দৃষ্টিভঙ্গি বা পলিটিক্স ) কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এটা পরিষ্কারভাবে মডার্ণ ‘সাবজেক্ট’কে সুরক্ষা দেয়ার পলিটিক্যাল প্রচেষ্টা। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে চরমভাবে প্রোটেকশন দেয়া হয়েছে এ প্রকল্পে ।
৪) অথচ ইতিহাস ( ফুঁকোর মতে ) ডিসকন্টিনিউয়াস। একজন ‘সাবজেক্ট’ রবীন্দ্রনাথের নৌকার মতো ইতিহাসের স্রোতে সেখানে ইন্ট্যাক্ট অবস্থায় ভেসে বেড়ায় নি। একেক সময়ে এখানে একেক ধরণের সাবজেক্টের উৎপত্তি হয়েছে যারা পূর্ববর্তীদের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা ও ভিন্ন । স্থূল উদাহরণ দেয়া যেতে পারে ব্যাপারটি পরিষ্কারের জন্য । এটি রসায়নের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মতো ব্যাপার যেখানে পানির উৎপত্তি হয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে ; এবং পানি তৈরি হয়ে গেলে তার বৈশিষ্ট্যে তা হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে পড়ে। আমি যে উদাহরণ দিলাম তাও মডার্নিস্ট প্যারাডাইম দ্বারা প্রভাবিত। তারপরও উপযুক্ত উদাহরণের অভাবে এর দ্বারস্থ হতে হলো । তো , যা বলছিলাম, মডার্নিস্ট এপ্রোচ দেহকে যেরকম জ্ঞানের প্রাইমারী সোর্স হিসেবে গণ্য করেছে আমরা যদি সেরকম মনে না করি তাহলে দেখা যাবে , ডিসকন্টিনিউয়াস ইতিহাসের আলাদা আলাদা সময়ে যে ধরণের সাবজেক্ট ফরমেশন বা ব্যক্তিসমূহ উদ্ভুত হয়েছে তারা নতুন ধর্ম , সংস্কৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি উপাদানের কারণে আলাদা আলাদা সত্ত্বা । ফলে, কেউ যদি আমাকে দেখে মনে করে যে, আমি ভারতীয় , ফলে ভারতের নিখাদ সনাতন ইতিহাসের উত্তরসূরী আমি – একথা পুরোপুরি ঠিক নয়। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণের কারণে আমি একইসাথে আরবের সাংস্কৃতিক প্যারাডাইমের উত্তরসূরীও বটে, আবার পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনায় পাশ্চাত্য মডার্ণিস্ট ঘড়ানার জ্ঞানতত্ত্বের উত্তরসূরীও আমি । একসাথে আমি আবার সনাতন সংস্কৃতি ধারাও গঠিত। এ অর্থে আমরা সকলেই ‘হাইব্রিড’ঃ কোন একক কন্টিনিউয়াস ইতিহাসের সত্ত্বা নই। এ কথা দুনিয়ার সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রেও খাটে। আমাদের দেশের উপজাতি বা আদিবাসীদের নামকরণের , তাই, আমি ঘোরতর বিরোধী। উনারা উপজাতি বা আদিবাসী কিছুই নয়। তারা চাকমা, মারমা , তঞ্চংগ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা কোন কন্টিনিউয়াস ইতিহাসের আদিম বা আদি সাবজেক্ট নয়। উনারাও শ্রেণীবিভক্ত, পাশ্চাত্য ও খ্রিস্টান জ্ঞানতত্ত্ব উনাদের ভেতরেও প্রবেশ করেছে, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের ছোঁয়া আছে এদের মাঝে;সর্বোপরি , এরা বিশ্বপুঁজিব্যবস্থার অধীন সাবজেক্ট । ফলে, তারাও ‘হাইব্রিডিটির বৈশিষ্ট্য দ্বারা গঠিত’।