মধ্যবয়সী ডাক্তার সাহেব হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন - " কেমন আছেন? "
অতি স্বাভাবিক এ প্রশ্নে আমি একটু থমকে যাই । ডাক্তাররা সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা চেহারায় জিজ্ঞাস করেন - " কি সমস্যা? "... অনেকে আবার পারলে তাও করেন না, রোগী মুখ খুলে নিজ থেকে কিছু বলতে গেলে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলেন, দুই - তিন বাক্যে কথা শেষ করে খসখস করে পনের দিনের ঔষধ আর দুই - তিনটা টেস্টের নাম লিখে হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে ফি এর টাকাটা রেখে বিদায় করে দেন ।
ডেস্কের ওপাশের মানুষটাকে আমার হুট করে খুব আপন লেগে যায় । আন্তরিক কন্ঠে বলি - " আলহামদুলিল্লাহ্, বেশ ভালো আছি । আপনি কেমন আছেন? "
- এই তো আছি ভালোই .... তারপর বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে?
ফিক করে একটু হাসি চলে আসে । হাসতে হাসতেই বলি - " চোখের অবস্থা খারাপ । ঠিক করে দিতে পারেন । "
হুমায়ুন আহমেদের শুভ্র চরিত্রটা কলেজ জীবনে বেশ টানতো । শুভ্র পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষ এবং চশমা ছাড়া যে প্রায় অন্ধ । এক সময় গিয়ে শুদ্ধতম মানুষের পুরো ধারণাটাই যে হাস্যকর এবং বিরক্তিকর কনসেপ্ট তা বোঝার পর শুভ্র আমার কাছে শতভাগ আবেদন হারিয়ে ফেলে । তবে একটা দিকে তার সাথে আত্নীয়তা এখনও দিনদিন মজবুত হয়েই চলেছে - চোখ । আমার চোখও ভয়াবহ খারাপ, চশমা ছাড়া দশ - পনের হাত দূরের কিছুও দেখতে পাই না ।
মেশিনে রঙিন প্যারাশুটের ছবি দেখিয়ে চোখ পরীক্ষা হলো । তারপর চশমা টাইপ এক স্টিলের ফ্রেম নাকে চাপিয়ে দেয়ালে টানানো বোর্ডে বড় থেকে ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসা ইংরেজি বর্নমালা পড়ে শোনালাম । এমবিএ তে পড়ুয়া ছেলে এক পর্যায়ে দেখা গেলো A কে পড়ছে O, D কে পড়ছে W. বেশ লজ্জাজনক ব্যাপার ।
ডাক্তার সাহেবের সম্ভবত হাসির বাতিক আছে । পরীক্ষা শেষে হেসে বললেন - " চোখ তো খেয়ে ফেলেছেন প্রায় । অন্ধ হয়ে যাবেন কিছুদিন পর । "
আমি আতঙ্কিত হয়ে চুপ করে বসে রইলাম । ডাক্তার সাহেবই আবার মুখ খুললেন - " ফেসবুক চালান নাকি অনেক? "
ভয়ংকর প্রশ্ন । একটু আমতা আমতা করে বলি - " জ্বি ... এই মানে মোটামুটি আর কি ( ডাহা মিথ্যা কথা ) " ।
- আমার ছোট মেয়েটাকে দেখি সারাদিনই মোবাইলে ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে । মোবাইলে চালাতে চালাতে বোরড হলে গিয়ে বসে ল্যাপটপে । তারপর আবার মোবাইলে । আপনাদের কি কোন ধারণা আছে একটানা এসব ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখের উপর কতখানি প্রেশার ফেলে?
অবশ্যই জানা আছে । তবুও মুখে একটা অনুসন্ধিৎসু ভাব ফুটিয়ে তুলি ।
- এখন বুঝছেন না আপনারা । দ্রুতই বুঝবেন । পুরো ইয়াং জেনারেশনের চোখে চশমা উঠে যাবে সামনের দশ বছরে ..... দুনিয়ার সব কিছু বাদ দিয়ে একটা ওয়েবসাইটে মানুষ সারাদিন কেন পরে থাকবে?
জবাবটা আমি জানি । বলতে একটু ইতস্তত হয়, কারণ এ ধরনের সুরে কথা বলা আমাদের মধ্যে প্রচলিত না ।
- কারণ মানুষ ঈশ্বরের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে এখন ।
- ঈশ্বর নিঃসঙ্গ নাকি?
- অবশ্যই নিঃসঙ্গ । সেজন্যেই তো তিনি ফেরেশতা বানিয়েছেন, মানুষ বানিয়েছেন । আর আমরা মানুষেরা নিঃসঙ্গ বলে বানিয়েছি ফেসবুক, ইন্টারনেট ।
জবাবটা ডাক্তার সাহেবের ভালো লাগলো । হাসতে হাসতে প্রসেক্রিপশন লিখলেন ; হায়রোগ্লিফস না - হাতের লেখা পড়া যায় ।
বের হয়ে আসছি, পেছন থেকে ডাক ।
- " ঈশ্বর নিঃসঙ্গ হতে পারেন, কিন্তু আপনাদের নিঃসঙ্গ হওয়ার কথা না । আপনাদের পরিবার আছে, আত্নীয়স্বজন আছে, বন্ধু - বান্ধব আছে । অপরিচিত মানুষদের সাথে অর্থহীন জীবন না কাটিয়ে কাছের মানুষগুলোকে সময় দিন । ভালো থাকবেন । "
ডাক্তার সাহেবের চেম্বারের বাইরে বের হয়ে রাম্তায় দাড়ালাম। খেয়াল হলো ফেসবুকের বহু মানুষের প্রেম, ভালোবাসা, হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনার খবর আমি জানি, অথচ অনেকদিন নিজের কাছের মানুষগুলোর সাথে ভালো মতো কথাই বলা হয় নি, আড্ডা দেয়া হয় নি, মারামারি - গালাগালি করা হয় নি, রাস্তায় অপরিচিত মানুষের সাথে পাণ্ডিত্যপূর্ণ গলায় দেশ, রাজনীতি, যানজট, আবহাওয়া নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয় নি । জীবন যাপিত হচ্ছর শতভাগ ফ্যান্টাসির নীল এক জগতে ।
খুঁজে পেতে এক রিকশায় চেপে বসি । চাকা ঘুরতে থাকে । কিছু সময় কেটে যায় । তারপর আমি হঠাৎ হাতের মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে সামনের রিকশা চালককে খুব কোমল গলায় প্রশ্ন করি - " ভাই, কেমন আছেন? "
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৩৭