somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্য-শরতের চাঁদ (অনুবাদ গল্প)

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হ্রদটি আলোকোজ্জ্বল, জীবন্ত। নৌকায় বাঁধা গোলাকার লণ্ঠনগুলোর সোনালি আভা যেন শত শত সূর্যকণিকার মত জ্বল জ্বল করছে। চাঁদটাও এতটাই অবিশ্বাস্য উঁচুতে উঠে আকাশ ছুঁয়েছে, যেন এর চেয়ে উঁচুতে ওঠা আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নৌকার হাল আঁকড়ে ধরে খোশমেজাজী শেয়ালগুলো মিটিমিটি হাসছে। যদিও তারা ভেতরের অসহিঞ্চুতা আর উন্মাদনাকে পুরোপুরি রোধ করতে পারছে না; তবুও তারা খুব ভালোভাবেই জানে কীভাবে অভিজাত পুরুষের মতো আচরণ করতে হয়। পুতুলগুলোও অনুরূপ সৌজন্যমূলক হাসি ফুটিয়ে তুলেছে তাদের চেহারায়, যা কিনা তারা প্রায়শই তাদের বালিকা মনিবদের মুখে দেখতে পেত।

আচমকা একটা নৌকার উপর নিজেদের উপস্থিতি টের পেয়ে পুতুলগুলো ভীষণ অবাক হয়েছে। তাদের একান্ত আশ্রয় থেকে এভাবে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হওয়া নিঃসন্দেহে ভীষণ বিস্ময়ের। তাদের একজন শুয়েছিল ফুলের তৈরি নরম বিছানায়, হঠাৎ একটা শেয়াল জানালা গলে এসে তাকে তার মনিবের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ফিতে লাগানো দোলনায় দুলছিল অন্য একজন। তারপর প্রচণ্ড বিস্ময়ের সাথে সে একসময় নিজেকে আবিষ্কার করে একটা শেয়ালের মুখের ভেতর।

নৌকায় এভাবে আচমকা পুতুলগুলোর একসাথে হওয়া একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা হলেও, তারা বিষণ্ন বা হতাশ নয়। কেননা সকল নারীই চায় একজন সুদর্শন অভিজাত পুরুষের দ্বারা অপহৃত হতে। তাই যদিও ফেলে আসা ক্ষুদ্র বালিকাদের কথা ভেবে পুতুলগুলোর কিছুটা দুঃখ হচ্ছে, তবু তারা ভেতরের আনন্দের অনুভূতিটিকেও উপেক্ষা করতে পারছে না।


একসময় হৃদের ঝলমলে রুপালী জলের মধ্যে কালো রেখার মতো আনন্দদ্বীপটি সবার চোখে পড়ল। শেয়ালগুলো উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠল, কিন্তু পুতুলগুলোর চোখে নেমে এল উদ্বিগ্নতা। একি ! দ্বীপের কোল ঘেষে তাদেরই মতো হাজার হাজার পুতুলের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গের মতো ওগুলো কি দেখা যাচ্ছে? দু একটা পুতুল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো। সাথে সাথেই বুদ্ধিমান শেয়ালেরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের বোঝাতে শুরু করল। বলল, হে সুন্দরী রমণীরা, তোমরা জলপথে অভ্যস্ত নও। তাই জাননা, এখানে কত অদ্ভুত রকমের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকে। তোমরা যা দেখে ভয় পেয়েছে সেগুলো আসলে গতসপ্তাহের ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া গাছের কচি ডালপালা ছাড়া আর কিছুই নয়।

নিজেদের মূর্খতার কথা ভেবে পুতুলগুলো ভীষণ লজ্জা পেল। তারপর নৌকাগুলো তীরে পৌঁছালে শেয়ালেরা খুব যত্নের সাথে সবাইকে নামিয়ে নিল।


এটা ছিলো মধ্য-শরতের চাঁদ উৎসব। এ এক মহিমান্বিত রাত। মানুষের হাসি উল্লাস আর সঙ্গীতের সুমধুর ধ্বনি বাতাসে ভেসে এসে আছড়ে পড়ছে হ্রদের টলমল রূপালী জলে। কিন্তু শেয়ালগুলোর আজকের উৎসবের কাছে মানুষের ওই ভোজ উৎসব কিছুই নয়।

সুক্ষ্ম কাজ করা একটা গালিচা বিছিয়ে দেয়া হলো ঘাসের উপর। পাশেই অসংখ্য চন্দ্রমল্লিকা মৃদু বাতাসে এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে। পুতুলেরা গালিচার উপর খুব সাবধানে - রেশমি কাপড়ে গোড়ালি ঢেকে - বসে পড়েছে। তাদের বুকের ভেতরটা হামিংবার্ডের পাখার মতো দুরু দুরু কাঁপছে। শেয়ালগুলো এরপর কী করবে তাদের সাথে? – সে ভাবনাতেই পুতুলেরা উদ্বিগ্ন।

মুহুর্তমাত্র ব্যবধানে শেয়ালেরা গালিচার উপর একটুকরো রেশমি কাপড় বিছিয়ে দিল। এবং তার উপর পিকনিক-হ্যাম্পারগুলো রাখল। এর মধ্যে পুতুলগুলোর জন্য এক অপার বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সুস্বাদু তরমুজ আর বিচিত্র সব পিঠায় সেগুলো ছিল পরিপূর্ণ। পুতুলদের ছোট ছোট হাতের সাথে একদম মানানসই মূল্যবান পাথরের কাপে তাদেরকে পরিবেশন করা হল শিশিরের মতো মিষ্টি মদ। প্লেটে রাজহাঁসের লাল মাংস আর ভাজা কাঁকড়া সাজানো হল। আজীবন একটা টি-পার্টির স্বপ্ন দেখে কাটানো পুতুলগুলো আচমকা এতো সুস্বাদু খাবার একসঙ্গে দেখে, বিস্ময়ে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তাই একটা পুতুলের জন্য যতটুকু মদ খাওয়া ভদ্রতা, তারা খেয়ে ফেলল তার চেয়ে অনেকটা বেশী ।

মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে শেয়ালগুলো একদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। কেননা তারা প্রত্যেকেই জানে যে এই পুতুলগুলোর হৃদয়নির্যাস ধ্বংস করতে পারলেই তারা সন্ধান পাবে অমরত্বের। যদিও পুতুলের হৃদয়নির্যাস যে আসলে কি – সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে স্বচ্ছ কোনো ধারণ নেই। তবু আজ এই মধ্য-শরতের চাঁদনি রাতে শেয়ালেরা সিদ্ধান্তে এসেছে যে, মুক্তা খাওয়ানোর মাধ্যমে পুতুলদের ভেতরে হৃদয়নির্যাস তৈরি করা সম্ভব। কেননা এর আগে তারা পুতুলকে সোনা ও অর্কিড খাইয়ে পরীক্ষা করেছিল।

এবার শেয়ালেরা পুতুলগুলোকে পোনামাছের সাথে নাইটিংগেল পাখির ডানা পরিবেশন করল। যা সুন্দরভাবে মুক্তার দানা দিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো করে সাজানো হয়েছে। পুতুলেরা বিস্ময়ে এবং আনন্দে অভিভূত হয়ে গেল, এবং অত্যন্ত আগ্রহের সাথে সব খাবার - এমনকি শেষ মুক্তাদানাটি পর্যন্ত- নিঃশেষ করে ফেলল।


অতঃপর এল সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। শেয়ালগুলো তাদের সামনের পা পুতুলগুলোর কাঁধে আলতো করে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ দ্যাখো, চাঁদের মধ্যে একটা রূপালী বুড়ি। আর ঐ যে দ্যাখো, একটা চরকা কাটা তারা। হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার তাকাও ওই রাখালের দিকে।

পুতুলেরা তাদের ছোট্ট মাথাগুলোকে আকাশের দিকে মেলে ধরল। এবং সেই সুযোগে শেয়ালগুলো পরম তৃপ্তি নিয়ে পুতুলদের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলল। কিন্তু এবার কি তারা সফল হল?

অমরত্বের চিহ্ন দেখার জন্য তারা একে অন্যের দিকে তাকাল। যদিও পুতুলের হৃদয়নির্যাসের চেয়ে অমরত্বের ধারণাটা তাদের কাছে আরো বেশী ঘোলাটে। তারা জানে না অমরত্ব দেখতে কেমন? বাতাসে নিশ্চয়ই আজ একটা নতুন ঔজ্জ্বল্য থাকার কথা, একটা সম্পূর্ণ নতুন দীপ্তি। অমরত্বের খোঁজে তারা পুতুলগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তবু কিছুতেই তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, মধ্য-শরতের অন্যান্য চাঁদনি রাতের মতো তাদের আজকের রাতটিও নিছক ব্যর্থতায় নিঃশেষিত হয়েছে।


অবশেষে তারা ব্যর্থতা পিঠে করে নৌকায় ফিরে এল এবং সৈকতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। তাদের লণ্ঠনগুলো অনেক আগেই নিভে গেছে। অদূরে থেমে গেছে মানুষের আনন্দোৎসবের হর্ষধ্বনি। ঘন মেঘের আড়ালে চাঁদটাও নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। এখন সমস্ত রাত্রি নিশ্চুপ এবং অন্ধকার। একটা হিমশীতল বাতাস নৌকার উপরে বসে থাকা শেয়ালগুলোর শরীরকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। এবং যখন তারা সৈকতে নিজেদের গুহায় পৌছালো; তখন শীতের হাত থেকে বাঁচতে লেজ দিয়ে চোখ ঢেকে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল।



শীতের আগমনে আনন্দদ্বীপটি তুষারে ঢাকা পড়ে গেল। গাছের কালো কালো শাখায় দু’একটা মৃত পাতার নড়াচড়া ছাড়া দ্বীপটিতে আর সবকিছুই একেবারে স্থির অচঞ্চল পড়ে রইল। পুতুলগুলো অধীর হয়ে ভাবছিল তাদের ফেলে আসা বাড়ি এবং ক্ষুদ্র বালিকাদের কথা; যারা তাদেরকে ভীষণ ভালবাসত। কিন্তু হায়! সে সব এখন কেবলই মুছে যাওয়া অতীত। তাদের রক্তের মতো লাল আর বসন্তের মত নীল রেশমী পোশাকগুলো এখন গাছের নিচে তুষারে ঢাকা পড়েছে।

সময়ের আবর্তনে তুষার গলে গেলে তাদের পোশাক চারপাশের কাদার সাথে মিশে মলিন হয়ে গেল। বসন্তের আগমনে পুতুলগুলোর চোখে ফাঙ্গাস জমে সেগুলো উজ্জ্বল বাদামী থেকে রুক্ষ সবুযে বদলে গেল । তারপর গ্রীষ্মের প্রখর সূর্যতাপে তাদের হাত আর পা-গুলো ঝলসে একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেল।


অবশেষে আজ আবার ফিরে এসেছে শরতের সেই মহিমান্বিত রাত। রাতের বাতাস ঢোলের বাদ্যধ্বনিতে মুখরিত। সুন্দর সুসজ্জিত নৌকায় বসে আছে শেয়ালগুলো। তাদের লাল পোশাকে নৌকার লণ্ঠনের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। একসময় তারা আনন্দদ্বীপে পৌঁছালে নৌকার যাত্রীরা বেলাভূমিতে অসংখ্য ছিন্নবিচ্ছিন্ন পুতুল দেখে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। এবং বরাবরের মতোই তাদেরকে আশ্বস্ত করা হলো।

খুব শীঘ্রই একটা আনন্দোৎসব হতে যাচ্ছে। এবং কেনইবা আমরা তা উপভোগ করব না? সম্ভবত এটাই সেই চাঁদ যা নিশ্চিত করবে অমরত্ব। সম্ভবত, এই চাঁদটিই আজ সকল তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে নিয়ে আসবে সত্যিকারের ভালবাসা। এবং সম্ভবত, এটাই সেই মধ্য-শরতের আকাঙ্ক্ষিত চাঁদ, যার জন্য আমরা সবাই অধীর অপেক্ষা করে আছি।

______


মূল গল্পের লিংকঃ Mid-Autumn Moon - Lani Carroll
[ মধ্য-শরতের চাঁদ
মূলঃ ল্যানি ক্যারোল
অনুবাদঃ এস এম মামুনুর রহমান (ডি মুন) ]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৩
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×