সরকার, মালিক পক্ষ ও তাবেদার শ্রমিক সংগঠনগুলো গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৫০০০ টাকা ন্যূনমত মজুরীর দাবীতে চলমান আন্দোলন নিয়ে নয়া নাটক মঞ্চস্থ করেছে। মিডিয়ায় প্রচার করে দেয়া হয়েছে “মজুরি কাঠামো মেনে নিয়েছে পোশাক শ্রমিকরা”। বাস্তবে মালিক ও সরকার তাদের মামু সংগঠনগুলোকে নিয়ে চলমান আন্দোলনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য সাজানো সমঝোতার এই পুরোনো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। প্রচার করা হয়েছে “বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে মালিক প্রতিনিধি ও শ্রমিকদের ৪২টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। এতে মালিক ও শ্রমিক উপভয়পক্ষই ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানান মন্ত্রী। “(সূত্র: বিডি নিউজ)
গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বদাবীদার সংগঠনের সংখ্যা সর্বমোট ৫৪ টি। এরমধ্যে ১০/১২ টি সংগঠন প্রকৃত পক্ষে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করে অর্থাত এই ১০/১২ টি সংগঠন শ্রমিকদের প্রকৃত পরিস্থিতি জানে বোঝে, তাদের দাবী-দাওয়া সম্পর্কে অবগত এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিহীন ও ভীষণ অসংগঠিত শ্রমিকরা মোটামুটি ভাবে এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের সাথে পরিচিত। বলা হচ্ছে ৪২ টি সংগঠনের সাথে সরকার ও মালিক পক্ষের বৈঠক হয়েছে, বাস্তবে যে ১০/১২ টি সংহঠন প্রকৃত পক্ষে শ্রমিকদের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গায় আছে, সে সংগঠনগুলোর নেতৃত্ববৃন্দ কিন্তু ঐ সমঝোতা বৈঠকে অনুপস্থিত ছিল—কারণ ঐসব সংঠনের নেতৃত্বের ঘাড়ে মামলা দিয়ে দৌড়ের উপর রেখেছে। মন্টুঘোষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, মোশরেফা মিশু, বজলুর রশিদ ফিরোজ, মাহবুবুর রহমান ইসমাইল সহ অন্যান্য শ্রমিক নেতা সহ মোট ৬৫৬ জন শ্রমিকের নামে মামলা ঝুলছে।
আরেকটা বিষয় হলো, মজুরী বোর্ড ছয়মাস ধরে ১২ টি বৈঠক করেও যে সমঝোতায় পৌছতে পারলনা যার ফলশ্রুতিতে মজুরী কাঠামো ঘোষণার পর আন্দোলন থেমে যাওয়ার বদলে আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো, এমনকি আজকে সারাদিনও আশুলিয়া,গাজিপুর,নারায়নগঞ্জ এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিক্ষোভ করল('আশুলিয়ায় তিন শতাধিক কারখানায় ছুটি' ঘোষণা Click This Link 'আশুলিয়ায় থেমে থেমে সংঘাত চলছে' Click This Link 'গাজীপুরে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ' Click This Link 'নারায়ণগঞ্জে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষ, আহত ৫০' Click This Link)..... আর হুটকরে সন্ধ্যাবেলা কতগুলো সংঠন মিলে একটা মহান সমঝোতা বৈঠক করল—তাতেই শ্রমিকরা সুবোধ বালকের মতো তা মেনে নেবে এটা আমরা যেমন বিশ্বাস করি না এমনকি ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ যেসব দালাল সংঠন এই তথাকথিত সমঝোতা করেছে তারাও তা বিশ্বাস করে না, ফলে সেই ‘সমঝোতা’ বৈঠকে “ঢাকা, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ কমিটি প্রয়োজনে তিনটি উপ-কমিটি গঠন করবে।” (বিডি নিউজ) মালিকদের বক্তব্য অনুসারে, ঐসব তথাকথিত শ্রমিক নেতা, গার্মেন্টস মালিক ও স্থানীয় এই কমিটিগুলো ট্রাবল জোন গুলোতে কাউন্সেলিং এর চেষ্টা চালাবে অর্থাত পুলিশ লেলিয়ে, লাঠিপেটা করে যে কাজটি হয় নি, শ্রমিকনেতা নামের দালাল গুলোকে সাথে নিয়ে শ্রমিকদের মাথায় হাত বুলিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষ সেই কাজটি সম্পন্ন করে ফেলবে!!
এরা দালালি করতে থাকুক, চলুন আমরা একটু বাস্তবতার দিকে তাকাই, তাহলে বুঝতে পারবো এ সমঝোতা কতটা ফাপা ও অকার্যকর....
১) মালিক পক্ষ এবং সরকার প্রচার করছেন এবং অনেকে এই প্রচার বেশ খেয়েছেনও.. গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরী ১৬৬২ টাকা থেকে একলাফে ৮০% বাড়িয়ে ৩০০০ টাকা করা হলো.. শ্রমিকরা আর কত চায়?
অথচ ২০০৬ সালেই শ্রমিকরা ৩০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরী দাবি করেছিলেন, তখন তাদেরকে তাদের দাবীর অর্ধেক টাকা অর্থাত ১৬৬২ টাকা দেয়া হয়েছিল। এখন ৪ বছর পর সেই ২০০৬ সালের দাবীর সমপরিমাণ মজুরী দিয়ে বলা হচ্ছে শ্রমিকরা একবারে আর কত চায়!! অথচ ৪ বছরে জীবন যাপনের ব্যায় বেড়ে গিয়ে ৩০০০ টাকা তো আর ২০০৬ সালের ৩০০০ হাজার টাকার জায়গায় নেই... এখন ২০০৬ সালের দাবী মানতে গেলেও তো ন্যূনতম মজুরী কমপক্ষে ৬০০০ টাকা করা উচিত..
২) ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মূল্যসূচক ধরে হিসাব করলে ঢাকার একজন কয়েদিকে প্রতিদিন ৫২ টাকা ৩৯ পয়সার খাবার সরবরাহ করে সরকার। এতে মাসে ব্যয় হয় এক হাজার ৫৭১ টাকা ৭০ পয়সা। অথচ কারখানার নূ্যনতম মজুরি ৩০০০ টাকা বিবেচনা করলে ৪.৮ সদস্যের (পরিবারের সদস্যসংখ্যার জাতীয় গড়) একটি শ্রমিক পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের পাতে মাসে ৬০০ টাকার বেশি খাবার পরে না! মজুরীর পুরো টাকাটাই যদি শ্রমিকরা খাবরের পিছনে ব্যায় করে তাহলে শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা কয়েদীদের তুলনায় অর্ধেক খাবার খেতে বাধ্য হবে!!
৩) বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে হলে একজন মানুষের দৈনিক ২ ডলার আয় প্রয়োজন। ৪ জনের একটি পরিবার ধরলে পরিবারের আয় হওয়া উচিত ৪x৩০x২ = ২৪০ ডলার প্রতি মাসে। ১ ডলার সমান ৭০ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ২৪০x৭০ = ১৬৮০০ টাকা।
৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হিসাব করে দেখিয়েছে দৈনিক ১০ ঘন্টা কাজ করলে একজন পুরুষ গার্মেন্টস শ্রমিকের ৩৩৬৪ কিলোক্যালরি এবং নারী শ্রমিকের ২৪০৬ কিলোক্যালরি তাপ লাগে। গড়ে একজন শ্রমিকের ৩০০০ কিলোক্যালরি তাপ প্রয়োজন হিসেবে তার খাওয়ার খরচ দিনে সর্বনিম্ন ৬৪.৫০ টাকা। তাহলে মাসে লাগে ৬৪.৫০x৩০ = ১৯৩৫.০০ টাকা। ৪ সদস্যের পরিবার হলে মাসে খাওয়ার খরচ ১৯৩৫.০০x৪ = ৭৭৪০.০০ টাকা। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যাতায়ত, পোশাক, সন্তানের শিক্ষা খরচ যুক্ত করলে প্রয়োজন হয় ১৪২৪০ টাকা।
৫) দ্রব্যমূল্য, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিদের বেতন ভাতা বাড়ানো হয়েছে। সরকার সম্প্রতি পে স্কেল ঘোষণা করেছে। এতে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বেতনের বিশাল বৈষম্য। তা সত্ত্বেও একজন পিওন পদের কর্মচারী ৪১০০ টাকা স্কেলে বেতন পাবেন। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ও আনুসঙ্গিক ভাতাসহ সর্বনিম্ন বেতন দাঁড়ায় ৭০০০ টাকা। তাহলে যারা উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত আছে তাদের বেতন কত হওয়া উচিত?
৬) ১৯৬৯ সালে যখন আমরা পরাধীন ছিলাম তখন শ্রমিক নিম্নতম মজুরি পেত ১৫৫ টাকা। তা দিয়ে ৫ মণ চাল কিনেও ৫ টাকা উদ্বৃত্ত থাকতো। শ্রমিকরা সেদিন এ মজুরির বিরোধীতা করেছিল। আজ অন্তত ৫ মণ চালের দামের সমান মজুরি পেতে হলেও ৭০০০ টাকা দরকার।
তাই দেশের অর্থনীতির অবস্থা এবং মালিকদের সক্ষমতাসহ সামগ্রীক বিবেচনায় একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ৭০০০ টাকা। ৭০০০ টাকা তো দূররে কথা ৫০০০ টাকাও দিতে চাচ্ছে না মালিক পক্ষ, আর এর সাথে বোনাস হিসেবে যুক্ত হয়-
ক) সময়মতো বেতন এবং ওভারটাইম ভাতা না দেয়া, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি না থাকা।
খ) কর্মকর্তা কর্তৃক শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহার, অমানবিক ব্যবহার করা
গ) যে কোন অজুহাতে শ্রমিকদের ছাঁটাই, শোকজ ইত্যাদির মাধ্যমে হয়রানী করা।
ঘ) গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার না থাকা।
তারপরও শ্রমিকদেরকে স্রেফ ৫০০০ হাজার টাকা মজুরি দেয়ার দাবী না মানলে শ্রমিকরা ভাংচুর করবে না তো কি মোমবাতি হাতে মৌন মিছিল করবে?
ন্যূনতম মজুরী বিষয়ক আমাদের পূববর্তী লেখা
ন্যূনতম মজুরী : মালিকের লাভের প্রশ্ন বনাম শ্রমিকের টিকে থাকার লড়াই
Click This Link
তথ্যসূত্র:
১) বিডি নিউজ
Click This Link
২) কালের কন্ঠ ৪ঠা এপ্রিল
৩) সিপিবি, বাসদ, জাতীয় গণফ্রন্ট, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ওয়ার্কাস পার্টি(পুনর্গঠন), গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি(এম.এল), বাসদ(মাহবুব), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন কর্তৃক যৌথ ভাবে প্রচারিত লিফলেট
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১০ রাত ১:৩০