এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে এখন দেখা যাক বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন শ্রমিকের মাসিক ন্যূনতম মজুরী কত হওয়া উচিত। ন্যূনতম মজুরী বোর্ড এ মাসের শেষের দিকে গার্মেন্টস সেক্টরের ন্যূনতম মজুরী ঘোষণা করবে। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরী ১৬৬২ টাকা, শ্রমিকদের দাবী এটাকে বর্তমান বাজার পরিস্থিতির বিবেচনায় বাড়িয়ে ন্যূনতম ৫,০০০ টাকা করতে হবে। এই ন্যূনতম মজুরী বাস্তবায়নের দাবীতে গত কয়েকদিন ধরে গার্মেন্ট শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম(মিডিয়ার কাছে যা কেবলই নৈরাজ্য কিংবা তান্ডব) প্রত্যক্ষ্য করছি। এই প্রেক্ষাপটেই গত ২৮ জুন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের মজুরি ন্যূনতম কত হওয়া উচিত তার একটি হিসেব মজুরী বোর্ড বরারর দাখিল করে। চলুন সেই হিসেবটি দেখা যাক।
সাধারণভাবে একজন মানুষের জন্য তাপশক্তি কত লাগে এটা হিসেব করতে হলে বিভিন্ন কাজে কত কিলোক্যালরি তাপলাগে তা জানা দরকার। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের একজন মানুষের তাপশক্তি প্রয়োজন হয় নিম্নরূপ :
একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের প্রতিদিন কত কিলোক্যালরি তাপ প্রয়োজন :
(নারী শ্রমিকদের ওজন ৫০ কেজি ধরলে এটা কিছুটা কম হবে)
সুষম খাদ্য দ্বারা এই ক্যালরির প্রয়োজন মেটালে শারীরিক সুস্থতা এবং কর্মশক্তি রক্ষা করা সম্ভব। মোট খাদ্যের ৫৭ শতাংশ কার্বহাইড্রেট যেমন চাল, আটা দ্বারা, ৩০ শতাংশ চর্বি জাতীয় খাবার যেমন তেল, ঘি, মাখন দ্বারা এবং ১৩ শতাংশ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ দ্বারা পূরণ করা দরকার। ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ খুবই প্রয়োজন রোগ প্রতিরোধ এবং শক্তি ব্যবহার করার জন্য। আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম শক্তি উৎপাদন করে না কিন্তু এগুলোর অভাব হলে শরীর কর্মক্ষম থাকতে পারে না। ভিটামিন ও খনিজ দ্রব্যের জন্য শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন।
বাজারে প্রাপ্ত সস্তা খাবার দ্বারা যদি একজন শ্রমিক তার শক্তি ও পুষ্টি রক্ষা করতে চায়, তাহলে নিম্নরূপ খরচ হবে :
(অসুস্থ হলে খরচ বাড়বে। শিশুদের ভাত কম লাগবে কিন্ত অন্যান্য খরচ বাড়বে। গড়ে ৬৪.৫০ প্রতিদিন খরচ ধরতে হবে)
১৪২৪০ টাকার কমে একটি পরিবার চলতে পারে না।
অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী ২ জনই চাকুরী করলে প্রত্যেকের কমপক্ষে ৭১২০ টাকা মজুরি দরকার। এখানে সন্তানের শিক্ষা, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় ধরা হয় নাই। বিনোদন ও অতিথি আপ্যায়নের হিসেবও ধরা হয় নাই।
এখন ৭১২০ টাকা তো দূরের কথা ন্যূনতম ৫০০০ টাকাই দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে মালিক পক্ষ। তাদের বক্তব্য এই মজুরি দিলে তাদের লোকসান হবে, তাদের পক্ষে প্রতিযোগীতা মূলক বাজারে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। মালিকগোষ্ঠীর এই দাবী সঠিক কি বেঠিক সেই তর্কে আমরা যাব না। আমরা শুধু প্র্রশ্ন তুলতে চাই, যখন পণ্য উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ যেমন: কাচামাল, জ্বালানী কিংবা যন্ত্রপাতির দাম বেড়ে যায়,তখন কি মালিক পক্ষ সেই পণ্যগুলোর বিক্রেতাকে বলতে পারে, আমরা এত দাম দেব না, এত দাম দিলে আমাদের লোকসান হবে, আমরা প্রতিযোগীতার বাজারে টিকে থাকতে পারব না। বাজার অর্থনীতির নিয়মেই তা পারেনা। প্রকৃতই যদি কাচামাল বা যন্ত্রাপাতির দাম বাড়ার জন্য মালিক লোকসানের মুখে পড়ার উপক্রম করে, তখন মালিক পক্ষ বাধ্য হয় বাড়তি খরচ পুষিয়ে নেয়ার জন্য হয় পণ্যের দাম বাড়াতে অথবা উৎপাদনের কৃতকৌশলের উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে কম খরচে বেশী পণ্য উৎপাদন করতে। যন্ত্রপাতি, কাচামাল বা অন্য যে কোন উপকরণ কেনার বেলায় কারখানার মালিক সুরসুর করে বাড়তি দাম প্রদান করলেও, টালবাহানা কেবল শ্রমিকের কাছ থেকে কেনা শ্রম-শক্তির দাম পরিশোধ করার বেলায়! লোকসান, ছাটাই কিংবা লে-অফের ভয় দেখিয়ে মালিক শ্রমিককে বাধ্য করে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে তার শ্রম-শক্তি বিক্রি করতে। নিয়মিত তেল-মবিল না দিলে ঝকঝকে মেশিনটিও যেমন কর্মক্ষমতা হারিয়ে ধীরে ধীরে জীর্ণ হয়ে যায়, নিয়মিত উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে শ্রম শক্তি বিক্রি করতে করতে শ্রমিকেরাও তেমনি হয়ে পড়ে জীণ, শীর্ণ। এরই মাঝে সময় সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকরা যখন জেগে উঠে, যখন তীব্র শ্রেণী-ঘৃণায় সবকিছু তছনছ করে দিতে চায়, তখন মালিক পক্ষ বলতে থাকে, এই দেখ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, তৃতীয়পক্ষের লেলিয়ে দেয়া মাস্তানরা কারখানা তছনছ করছে। তারা বিষ্ময় প্রকাশ করে, যে কারখানার মাধ্যমে শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করে, সে কারখানা কি কখনো সে তছনছ করতে পারে! এটা নিশ্চয়ই বহিরাগতদের কাজ। এভাবে বিষ্ময়ের মধ্যে দিয়ে তারা নির্মম শোষণের বাস্তবতাকে আড়াল করতে চায়। এই ছদ্ম বিষ্ময় প্রকাশকারীদেরকে আমরা কার্ল মার্কসের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কারখানা ও কাজের উপকরণের সাথে শ্রমিকের সম্পর্ক সম্পর্কে মার্কস বলছেন:
”শ্রমশক্তির ব্যবহার বা শ্রম হলো মজুরের নিজস্ব জৈবিক ক্রিয়া, তার স্বীয় জীবনের অভিব্যাক্তি। আর জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণাদি পাবার জন্য সে তার এই জৈবিক ক্রিয়া অন্যের নিকট বিক্রয় করে। কাজেই এই জৈবিক ক্রিয়াটা তার কাছে বেচে থাকার একটা উপায় মাত্র। বেচে থাকার জন্য সে কাজ করে। শ্রমটাকে মজুর নিজের জীবনের অঙ্গ বলে গণ করে না; বরং তার জীবনের জন্য তা আত্মত্যাগ। অন্যকে বেচে দেয়া একটি পণ্য তা। এই কারণে তার কর্মের ফলটা তার কর্মের লক্ষ্য নয়। যে রেশমী কাপড় সে বোনে, খনি থেকে যে সোনা সে তুলে আনে, যে প্রাসাদ সে বানায়, এসব সে নিজের জন্য উৎপাদন করে না। নিজের জন্য সে যা উৎপাদন করে তা হলো মজুরি, আর রেশমী কাপড়, সোনা প্রাসাদ- সবকিছু তার কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণের জীবনধারণের উপকরণে, হয়তো বা তুলোর জামা-কাপড়, তামার কিছু মুদ্রা আর ভূ-গর্ভের কুঠুরিতে মাথা গুজবার ঠাঁইয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায়। মজুর যে এই বারো ঘন্টা কাল ধরে বোনে, সুতা কাটে, তুরপুন চালায়, কোঁদে, ইট গাঁথে, কোদাল চালায়, পাথর ভাঙ্গে, বোঝা বয়, আরো কতো কি করে- সেই বারো ঘন্টা কালের বুনন, সুতো-কাটা, ফোঁড়া, কোঁদা, ইট গাঁথা, কোদাল চালানো, পাথর ভাঙ্গা প্রভৃতি কাজকে কি মজুরর নিজের জীবনের অভিব্যাক্তি বা জীবন বলে গণ্য করতে পারে? উল্টো এ কাজ থামার পরই তাদের জীবন শুরু: খাবারের টেবিলে, সুড়ি খানায়, বিছানায়।”(কার্ল মার্কস, মজুরী-শ্রম ও পুজি, ১৮৪৯)
কাজেই জীবন ধারণের ন্যূনতম উপকরণ যোগারের জন্য যে শ্রমিক নিজেকে, নিজের জীবনের অভিব্যাক্তিকে প্রতিদিন বিক্রি করে, সেই ন্যূনতম উপকরণই যদি সে না পায় তাহলে, কারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যদি তো বটেই, যে ব্যবস্থা তাকে বাধ্য করছে এভাবে নিজেকে বিক্রি করতে, সে গোটা ব্যাবস্থাকেই তছনছ করে দিতে পারে।