somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কত দূর- ফুকুশিমা থেকে রূপপুর ?

২৪ শে মার্চ, ২০১১ রাত ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই লেখাটি লিখতে শুরু করেছি যখন তখনও ফুকুশিমার দাইচি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এবং এই মূহুর্তে জাপান খুব সম্ভবত ‘চেরনোবিল সমাধান’ এর দিকে যাচ্ছে অর্থাৎ জাপান ঐ নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে মাটি এবং কংক্রিট চাপা দিতে যাচ্ছে ঠিক যেমনটি ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলে বিস্ফোরণের পর তেজস্ক্রিয়তা নির্গমন রোধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছিল। শুক্রবার টেপকোর এক কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কংক্রিট দিয়ে পরমাণু চুল্লিগুলো ঢেকে ফেলা অসম্ভব নয়। তবে এখন আমরা সেগুলো ঠাণ্ডা করার দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি।” বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বরাতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) আমাদের জানিয়েছে, নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া মানুষের দেহে আয়োডিন দেওয়ার সুপারিশ অনুমোদন করেছে জাপান কর্তৃপক্ষ। গত ১৬ মার্চ সংস্থাটি জাপানের পরমাণু নিরাপত্তা কমিশনের কাছে মানবদেহে তেজস্ক্রিয়তার কারণে ক্যান্সার প্রতিরোধে আয়োডিন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলো। জাপানে ১১ মার্চের ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প ও তার প্রভাবে সৃষ্ট সুনামিতে ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরমাণু চুল্লীর শীতলীকরণ প্রকোষ্ঠে পানি দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। মঙ্গলবার সকালে ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২ নম্বর চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটে। বিকেলে বিস্ফোরণ ঘটে ৪ নম্বর চুল্লিতে। ১ নম্বর চুল্লিতে শনিবার ও ৩ নম্বর চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটে সোমবার। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে ৩ নম্বর চুল্লি। এতে উঁচু মাত্রার বিষাক্ত প্লুটোনিয়াম রয়েছে। তবে ব্যপকমাত্রায় পানি ছিটানোর পর এটি বিপর্যয়ের মুখ থেকে ফিরে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বশেষ সংবাদে জানা গেল ডিজেল গ্যাস জেনারেটর ব্যবহার করে কম ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ ও ছয় নম্বর চুল্লিতে শীতলীকরণ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে ১ ও ২ নম্বর চুল্লিতে বিদ্যুৎবাহী তার সংযোগ করা সম্ভব হয়েছে। এই অবস্থায় জাপানের পারমাণবিক নিরাপত্তা সংস্থার উপ-পরিচালক হিদেহিকো নিশিয়ামা বলেন, “আমরা এগুচ্ছি ... কিন্তু খুব বেশি আশা করা ঠিক হবে না।”

আমাদের বিজ্ঞান এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান কিন্তু বেশ আশাবাদী। জাপানের এই বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকলেও রূপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প সহ্য করার মতো করে তৈরি করা হবে।” তিনি হয়তো বলতে পারতেন যে বাংলাদেশে যেন ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ১০ ছাড়িয়ে না যায় সেজন্য বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে কিংবা বলতে পারতেন ভূমিকম্প রিখটার স্কেলে যদি ১০ ছাড়িয়েই যায় তবে তাতে করে পরমাণু চুল্লিগুলো যেন অক্ষত থাকে এবং তা থেকে যেন কোনভাবেই তেজস্ক্রিয়তা না ছড়ায় সে লক্ষ্যে আমাদের সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাবে। এখানে পাঠকদের এটা জানানো যেতে পারে যে জাপানের বিপর্যয়ের পর জার্মানি তাদের পুরনো সাতটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে এবং শুধু জার্মানিই নয় বেশ কয়েকটি দেশ যেখানে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ নিয়ে শঙ্কিত সেখানে আমাদের প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠ শুনতে ভালোই লাগে। ভালো না লেগে উপায় কি বলুন, জার্মানি যেখানে নিজস্ব সক্ষমতা এবং দক্ষ লোকবল থাকা সত্ত্বেও এরকম একটি ঘোষণা দিতে পারল না সেখানে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের এই ধরনের আত্মবিশ্বাস সামনের দিনগুলোতে আমাদের যে অনুপ্রেরণা যোগাবে এতে আপনারা সন্দিহান হলেও হতে পারেন, আমরা কিন্তু নি:সন্দেহ। তারপরও আমরা একটু দোলাচলে ছিলাম এই ভেবে যে এত বড় বিপর্যয়ের পর আত্মবিশ্বাসে খানিকটা চিড়ও কি ধরবে না!!! মন্ত্রী মহোদয়ের পরবর্তী ঘোষণাতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল- “এত কম খরচে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ আমরা পাবো না,তাই এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হবেই।” সুরটা চেনা চেনা লাগছে না? অনেকটা মধ্যবিত্ত পরিবারে স্কুল পড়ুয়া মেয়ের জন্য হঠাৎ প্রবাসী পাত্র পাওয়া সুর। অগ্র পশ্চাৎ বিচার বিবেচনা করার সময় নেই, যেভাবেই হোক একে হস্তগত করতেই হবে। পাত্র কানা না খোঁড়া, কালা না বধির এসব খোঁজখবর নিতে গিয়ে শেষকালে যাদ পাত্রটাই হাতছ্ড়া হয়ে যায়!!! তাই হয়তো তিনি দেরী করতে চান না। কিন্তু আমরা দেরী করতে চাই। আমরা এই প্রযুক্তির সমূহ জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখে নিতে চাই। কারণ এর উপর শুধু আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তাই নির্ভর করছে না, নির্ভর করছে আমাদের অস্তিত্বও। অস্তিত্ব? হ্যাঁ পাঠক অস্তিত্ব। এই ধরনের একটি পারমাণবিক বিপর্যয় আমাদেরকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমা হামলায় আক্রান্তদের চিকিৎসা করেছেন এমন এক জাপানি বিজ্ঞানী নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন,“তেজস্ক্রিয়তা মানুষের শরীরের কোষের ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)-এর গঠনে পরিবর্তন ঘটায়। তাতে দেহকোষের অসম বিভাজন ও বৃদ্ধি ঘটে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। পরিণতদের চেয়ে গর্ভজাত ও বাড়ন্ত শিশুদের দেহকোষের বিভাজন অনেক বেশি হারে হয় বলে তেজস্ক্রিয়তায় তাদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। শিশুরা দুধ বেশি খায় বলে তাদের শরীরে তেজস্ক্রিয়তা প্রবেশের ঝুঁকিও বেশি।” হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল প্যাথলজিস্ট লাম চিং-ওয়ান বলেন,“এ বিস্ফেরণের ফলে মানুষ দীর্ঘ মেয়াদে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবের মুখে পড়তে পারে। আর তাতে মানুষের থাইরয়েড ও বোন ক্যান্সার এবং লিউকেমিয়ার ঝুঁকি বাড়বে। গর্ভজাত ও শিশুরাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকবে।” কিছু মানুষের ক্ষেত্রে খুবই স্বল্প পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তায় ক্যান্সারের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়- এ কথা জানিয়ে লাম বলেন, তেজস্ক্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয় পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে। আবার বৃষ্টির সঙ্গে সাগরের পানিতে ও মাটিতে নেমে খাদ্যশস্য,পানি ও সামুদ্রিক প্রাণীতে চলে যায়। সেগুলো গ্রহণ করলে মানুষের শরীরে তেজস্ক্রিয় উপাদান প্রবেশ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,তেজস্ক্রিয় থাকা ঘাস খেয়েছে এমন গরুর দুধের মাধ্যমেও তেজস্ক্রিয়তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। অধ্যাপক লি জানান, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয় পদার্থ এক সময় পানিতে যাবে এবং সমুদ্রের পানি ও জীবজগতে তা মিশে যাবে। আর বৃষ্টি হলে সুপেয় পানিতেও তেজস্ক্রিয়তা মিশে যেতে পারে।

দাইচি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩০ কিলোমিটার দূরের একটি ডেইরি ফার্মের দুধে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি বাগানের সব্জিতে তেজস্ক্রিয়তা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে। জাপানের মন্ত্রিপরিষদের মুখ্যসচিব ইউকিও এদানো শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা জানান। এমনকি জাপান থেকে দুইশ কিলোমিটার দূরবর্তী টোকিও শহরের পানিতেও তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়েছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) শনিবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেছে, ফুকুশিমা এলাকার সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেয়ার কথা ভাবছে জাপানি কর্তৃপক্ষ। এর আগে আইএইএ'র আরেকটি বিবৃতিতে বলা হয়,স্বাস্থ্য,শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় ফুকুশিমা এলাকার সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। এই অবস্থায় জাপানের পুরো খাদ্য রপ্তানি ব্যবস্থাই ধ্বংসের সম্মুখীন। এছাড়াও বড় বড় সব কোম্পানিগুলো তাদের কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। বিভিন্ন গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ইলেকট্রনিক সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও তেল শোধনাগারগুলো তাদের প্রধান প্রধান বেশ কিছু কারখানা বন্ধ রেখেছে। সনি,নিশান মটর,টয়োটা মটর,প্যানাসনিক ছাড়াও বহু প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা বন্ধ রেখেছে। অনেক কারখানা সম্পূর্ণ অক্ষত থাকলেও নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিপর্যয়ের ফলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং কাঁচামাল পরিবহন ও সরবরাহ করতে না পারাই এর মূল কারণ। অনেকেরই ধারণা, এ দুর্যোগের কারণে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে ১০ থেকে ১৬ ট্রিলিয়ন ইয়েন (১২৫-২০০ বিলিয়ন ডলার)।এর মধ্যে জাপানে মৃতের সংখ্যা নতুন করে বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।এই ভূমিকম্প এবং সুনামিতে কেবলমাত্র মিয়াগি এলাকাতেই ১৫ হাজার মানুষ মারা গিয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ। জাপানে ভয়াবহ ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৮ হাজার ১৩৩ জনে দাঁড়ানোর পর পুলিশ এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ।১২ হাজার ২শ ৭২ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছে। এ থেকে পরিস্কার যে, ফুকুশিমা দুর্যোগে অবশেষে নিহতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে জাপান যে এখন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পতিত এটা বুঝতে হলে আণবিক শক্তি বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। আর সেখানে আমাদের মন্ত্রীরা কতটা বেপরোয়া হলে এমন মন্তব্য করতে পারেন সেটা বিচারের ভার পাঠক আপনাদের হাতেই রইল। প্রসঙ্গত এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পাবনার রূপপুরে দুটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এর প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১ হাজার মেগাওয়াট। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই রূপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করে। আমরা প্রায় তখন থেকেই ব্লগ,পত্র-পত্রিকা,সেমিনার বিভিন্ন মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোন দিক থেকেই বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান হতে পারে না। এটা অনেকটাই ইঁদুর এর উৎপাত থেকে বাঁচতে ঘরে গোখরো সাপ ছেড়ে দেয়ার মতো দাঁড়াবে। এই ব্লগেই দুই কিস্তির একটি লেখায় আমরা আমাদের বক্তব্য হাজির করেছিলাম। সংক্ষেপে রুপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আমাদের যুক্তিগুলো এরকম :

১) নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি এখনও পর্যন্ত শতভাগ নিরাপদ কোন প্রযুক্তি নয়। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকা একটি দেশে আমদানি করে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার মানে হলো নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির স্বাভাবিক ঝুঁকির উপর বাড়তি ঝুঁকি বাংলাদেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া। চেরোনবিল, থ্রি মাইল আইল্যান্ড (কিংবা সাম্প্রতিক ফুকুশিমা)এর মত বড় বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে প্রযুক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোতে,যারা নিজস্ব দক্ষতাকে কেন্দ্র করে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। আর আমাদের মত দেশে যেখানে গ্যাস-কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো দু’দিন পর পর বিকল হয়ে যায় এবং মেরামতের অভাবে পড়ে থাকে দিনের পর দিন সেখানে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মত একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রযুক্তি সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বেশ ভালোভাবে চলবে এটা ভাবতে একটু কষ্টকল্পনা করতে হয়।

২) নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎএর জ্বালানি ইউরেনিয়ামের উৎস এবং সেই ইউরেনিয়াম কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের খায়েশ জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইউরেনিয়াম খোলাবাজারে সের দরে পাওয়া যায় না যে প্রয়োজন হলো আর আমদানী করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করলাম; এর জন্য বিভিন্ন বৃহৎ রাষ্ট্রের সাথে নানান অধীনতামূলক চুক্তি সই করতে হয়। আবার দুনিয়ার চারিধারে ইউরেনিয়াম প্রচুর পরিমাণে ছড়িযে ছিটিয়ে আছে এমনও নয়। হাই গ্রেড ইউরেনিয়ামের মজুদ আছে বর্তমানে প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন টন। বর্তমানে প্রতি বছর ইউরেনিয়াম ব্যবহ্রত হচ্ছে প্রায় ৬৭,০০০ টন। অতএব এই হারে ব্যবহ্রত হতে থাকলে বর্তমান মজুদ দিয়ে চলবে আরো বছর পঞ্চাশ। আর যদি দুনিয়ার বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় সবটাই যোগাতে হত নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকে তবে তা দিয়ে চলত আর মাত্র নয় বছর! হাই গ্রেড-লো গ্রেড মিলিয়ে এই মূহুর্তে ইউরেনিয়ামের মোট মজুদ প্রায় ১৪.৪ মিলিয়ন টন যার বেশিরভাগ থেকেই ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। অনেকগুলোকে খনি আবার ইতোমধ্যে পরিত্যক্তও হয়ে গেছে।

৩) বাংলাদেশের মতো একটি ইতোমধ্যেই বৈদেশিক ঋণ এবং তার সাথে যুক্ত শর্তের জালে আবদ্ধ দেশের জন্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাড়তি একটি বিপদ হলো এর আর্থিক দায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় এককালীন বিনিয়োগের পরিমাণ বিপুল। আবার শুরুতে যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয় তাও ঠিক থাকে না,দিন যত যায় ততই বিনিয়োগের অর্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। দুনিয়ার যে দেশেই সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট কিংবা নানান ব্যাংক ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণের মাধ্যমে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, সেখানেই ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণী ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়েছে আর বিপরীতে জনগণ হয়েছে আরও বেশী ঋণগ্রস্থ। উদাহরণস্বরূপ ব্রাজিলের আঙরা, ফিলিপিনের বাতান, ফিনল্যান্ডের অলিকিলিওতো ইত্যাদি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কথা বলা যায় যেগুলোর কোনটাই নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খরচ না করে এবং নির্মাণের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৫/১০ বছর না পার করে শেষ হয়নি।

৪) স্বাভাবিক অবস্থাতেই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রতি বছর বায়ুমন্ডলে ও পানিতে প্রায় মিলিয়ন কুরি (তেজস্ক্রিয়তার একক) তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ছড়ায়। এগুলোর নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় না কেননা উদ্যোক্তারা মনে করেন এরা পরিবেশ ও প্রাণসম্পদের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়! এইসকল আইসোটোপের তালিকায় আছে ক্রিপ্টন, জেনন, আর্গনের মত নিস্ক্রিয় গ্যাসসমূহ যেগুলো চর্বিতে দ্রবণীয় এবং রিঅ্যাক্টরের আশেপাশে বসবাসকারী কোন লোক তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে তা তার ফুসফুসের মাধ্যমে প্রজনন অঙ্গসহ তার দেহের চর্বিযুক্ত টিস্যুতে স্থানান্তরিত হতে পারে। তদুপরি তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি হতে নিঃসরিত গামা রশ্মি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সূচনা করতে পারে বংশানুসৃত রোগের। ট্রিটিয়াম নামক হাইড্রোজেনের একটি আইসোটোপও আমরা নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পেয়ে থাকি যা অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া মারফত তেজস্ক্রিয় পানি উৎপন্ন করে। এই পানি ত্বক, ফুসফুস এবং পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে লোকজনের দেহে প্রবেশ করে তার ডি.এন.এ মলিকিউলে ঢুকে যেতে পারে যার পরিণাম বড় ধরনের বিপর্যয়।

৫) নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উপজাত হিসেবে যে বর্জ্য তৈরী হয় সেগুলো তেজস্ক্রিয় এবং এর তেজস্ক্রিয়তা কমে সহনীয় পর্যায়ে আসতে কমপক্ষে ১০,০০০ বছর(!) লাগবে। তার মানে নিউক্লিয়ার বর্জ্যকে সরিয়ে আমাদের এমন কোথাও রাখতে হবে যা ঝুঁকিহীন থাকবে টানা দশ হাজার বছর। অতএব এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝুঁকিটা কেবল আমাদেরই থাকছে না, ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে আমাদেও পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যও। নৈতিকভাবেই এটা তাই আমাদের কাছে অসমর্থনযোগ্য যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমন্ধে একটা কার্যকর স্থায়ী সমাধানে যেতে না পারছি।

এগুলো ছাড়াও আমরা বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে দেখিয়েছিলাম কেন নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কোন টেকসই সমাধান নয়। এরপর যখন ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটলো, ভেবেছিলাম এখন বোধহয় রূপপুর প্রজেক্টের কথা সরকারগুলো মুখে আনতেই সাহস করবে না অথচ হা হতোষ্মি !!! উঁনারা কি বলছে শুনুন- “বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে তৃতীয় প্রজন্মের। এতে দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।” জাপান তার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল দিয়ে যেটা পারেনি আমরা সেটা পারব আমদানি করা প্রযুক্তি ও ভাড়া করা বিদেশী বিশেষজ্ঞ দিয়ে!!! পাঠকদেরকে অনুরোধ এসব শুনে হাসবেন না বরং একটু ভাবুন ক্ষমতায় গিয়ে এরা আসলে কাদের স্বার্থ বাস্তবায়ন করতে উন্মুখ হয়, কাদের উন্নয়ন এরা আসলে সত্যিকার অর্থে বিবেচনা করে, এদের উন্নয়ন দর্শনটাই বা কি। এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। নতুবা এই সরকারগুলো আমাদেরকে এক সংকট থেকে উদ্ধারের নামে আরেক সংকটে নিয়ে ফেলবে, সেখান থেকে উদ্ধারের নামে ফের আবার নতুন কোন সংকটে...এবাবেই চলতে থাকবে যদি আমরা চলতে দেই। ভয় হয় রূপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ফুকুশিমা জাতীয় কোন ধরনের বিপর্যয় হয়তো এই সরকারগুলোকে এই সংকট-সংকট খেলা থেকে তাদের বঞ্চিত করবে কারণ যাদের নিয়ে এই মধুর খেলা খেলা যায় সেই আমরা আম জনতাই যে নিশ্চিহ্ন হয়ে না গেলেও ধ্বংস তো হবই সুনিশ্চয়।
তাই পাঠককূলের নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ রইল রূপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার। মিছিল,সমাবেশ,ফেসবুক,পোস্টারিং,লিফলেট যেভাবে পারা যায় সেভাবেই যেন আমরা আরো বেশি মানুষকে যুক্ত করি,সচেতন করে তুলি। আমাদের হাতেই তুলে নিতে হবে আমাদের নির্ভরতার চাবি- আমরা যে ক্ষুধিরাম,সূর্যসেনের সন্তান।
২১টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×