somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুন্দরবন এতদিন আমাদের বাচিয়েছে কিন্তু এখন সুন্দরবনকে কে বাচাবে?

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রিয় সুন্দরবন বিপদে পড়েছে। কঠিন বিপদ। গাছপালা-পশুপাখি-মানুষ সহ তার যে জগৎটাকে সে এতদিন আগলে রেখেছে, সেই গোটা জগৎটার অস্তিত্বই হুমকীর মুখোমুখি। এমনিতেই প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট নানা দুর্বিপাকে সুন্দরবন অস্তিত্ব বিপন্ন,তার উপর এখন মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিশাল এক কয়লা বিদুৎ প্রকল্প। সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে। ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির সাথে বিদুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তিও হয়ে গেছে। এর আগে জমি অধিগ্রহন করে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়ে গেছে। পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া যে শুধু সুন্দরবন কেন, কোন স্থানেই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো একটি রেড ক্যাটাগরির স্থাপনা নির্মাণের কথা ভাবাই যায় না, আইন ও সমর্থন করে না।



যে ভারতীয় কোম্পানি এই বিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা করবে, নিজ দেশ ভারতে হলে কিন্তু এইভাবে সুন্দরবনের এত কাছে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারতো না। ভারতের ওয়াল্ড লাইফ প্রটেকশান এক্ট অনুসারে কোন সংরক্ষতিত বনাঞ্চলের ১৫ কিমি এর মধ্যে কোন বিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা নিষেধ। ১ কিমি কিন্তু কম না, সুন্দরবন ধ্বংস করার জন্য এই ১ কিমিই যথেষ্ট। মালয়েশিয়ায় এই দূরত্ব ২০ কিমি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এইসবের কোন বালাই নাই। ভারতের মধ্য প্রদেশে এনটিপিসি কোম্পানিরই একই আকারের অর্থাৎ ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয় নাই ভারত সরকার কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আবাসিক এলাকার কাছে, দুই ফসলী জমির উপর অবস্থিত এবং যে নদীর পানি ব্যাবহার করবে সেই নদীতে পানির সংকট। অথচ বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে বিদুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে আপত্তি এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি সিরিয়াস। যেমন:

১) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাইঅক্সাইড(SO2) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড(NO2) নির্গত হবে যার ফলে পরিবেশ আইনে বেধে দেয়া পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার সীমার(প্রতি ঘনমিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম) তুলনায় এইসব বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা অনেক বেশি হবে(প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি) যার ফলে এসিড বৃষ্টি, শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি সহ গাছপালা জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে। অথচ জালিয়াতি করে সুন্দরবনকে পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার বদলে ‘আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা’ হিসেবে দেখিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ নিরাপদ মাত্রার মধ্যেই থাকবে বলে প্রতারণা করা হচ্ছে।

২) সাড়ে চার বছর ধরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কালে নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করার সময় বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নি:সরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নি:সরণ, ড্রেজিং ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

৩) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪ ৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূতি ছাই বা স্লারি ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে কারণ এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। এই দূষণকারী ছাই দিয়ে ১৪১৪ একর জমি ৬ মিটর উচু করা হবে। ফলে এই ছাই উড়ে, ছাই ধোয়া পানি চুইয়ে আশপাশের নদী খাল এবং আন্ডারগ্রউন্ড ওয়াটার টেবিল দূষিত করবে।

৪) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কয়লা উঠানো নামানো, পরিবহন ইত্যাদির কাজে ব্যাবহ্রত যন্ত্রপাতি ও যানবাহন থেকে ভয়াবহ শব্দ দূষণ হয়। বলা হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশে সবুজ বেষ্টনি তৈরী করে সুন্দরবনকে রক্ষা করা হবে। কিন্তু সবুজ বেষ্টনি বেড়ে উঠতে তো সময় লাগবে। ঐ কয় বছর শব্দ দুষণ প্রতিহত করা হবে কি ভাবে কিংবা সবুজ বেষ্টনির বাইরে যন্ত্রপাতি ওমালামাল পরিবহন, ড্রেজিং ইত্যাদি কাজের সময় যে শব্দ দূষণ হবে তার ক্ষতিকর প্রভাবে কিভাবে মোকাবিল করা হবে।

৫) প্ল্যান্ট পরিচালনার জন্য পশুর নদী থেকে ঘন্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে এবং পরিশোধন করার পর পানি পশুর নদীতে ঘন্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার হারে নির্গমন করা হবে। পরিশোধন করার কথা বলা হলেও বাস্তবে পরিশোধনের পরও পানিতে নানান রাসায়নিক ও অন্যন্যা দূষিত উপাদান থেকে যাওয়ার ঝুকি থাকেই। তাছাড়া নদী থেকে এই হারে পানি প্রত্যাহার, তারপর বিপুল বেগে পানি আবার নদীতে নির্গমন, নির্গমনকৃত পানির তাপমাত্রা ইত্যাদি নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ, পানির প্লবতা, পলি বহন ক্ষমতা, মৎস ও অন্যান্য প্রানী ও উদ্ভিদের জীবন চক্র ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বেই যা নদী নালা খাল বিলের মাধ্যমে গোটা সুন্দরবনের জলজ বাস্তুসংস্থানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

৬) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনী থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস যা চারপাশের পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

৭) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আমদানী করা কয়লা সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই পরিবহন করা হবে। এ জন্য বছরে ৫৯ দিন কয়লা বড় জাহাজ এবং ২৩৬ দিন লাইটারেজ জাহাজ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লার মতো দূষণ কারি কার্গো নিয়ে চলাচল করবে। ফলে কয়লা পরিবহন, উঠানো –নামানো, জাহাজের ঢেউ, নাব্যতা রক্ষার জন্য ড্রেজিং, জাহাজ থেকে নির্গত তরল কঠিন বিষাক্ত বর্জ্য, জাহাজ নি:সৃত তেল, দিন রাত জাহাজ চলাচলের শব্দ, জাহাজের সার্চ লাইট ইত্যাদি সুন্দরবনের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ও জীব বৈচিত্র বিনাশ করবে।

এগুলো আমাদের নিজেদের বানানো কথা না, প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিয়ে তারপর প্রকল্প জায়েজ করার জন্য যে পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআএ করা হয়েছে, শত জালিয়াতি করেও এইরকম ভয়ংকর ফলাফলগুলোকে ঢেকে রাখা যায় নি। অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ না করেই চুক্তি করা হয়েছে। ইআইএ সমীক্ষাতে প্রাথমিক ভাবে যে দামের কথা বলা হয়েছে তা প্রায় ৯ টাকা প্রতি ইউনিট যা অনেক কুইক রেন্টালের চেয়ে বেশি। তাছাড়া ৫০:৫০ জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি বলা হলেও ৭০ ভাগ পুজি আসবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে, বাকি ৩০ ভাগ এনটিপিসি ও পিডিবি সমান দুই ভাগ করে দেবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাও এনটিপিসি করবে। এমনকি মুনাফার উপর থেকে করও মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিবেচনাতেও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রটি সুফল বয়ে আনবে না।

যে সুন্দরবন আমাদেরকে আইলা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছে, কাঠ দিয়ে মাছ দিয়ে খাদ্য দিয়ে আমাদের বাচিয়ে রেখেছে, সে সুন্দরবন যে নিজেই এখন বিপন্ন, সেটা স্পষ্ট। সুন্দরবনকে ভালোবেসে অষ্টমাশ্চার্য বানানোর জন্য আমরা লাখ লাখ ভোট দিয়েছি, রাস্তায় নেমে ক্যাম্পেইন করেছি। আজ যখন আমাদের প্রিয় সেই সুন্দরবনের অস্তিত্বটাই বিপন্ন তখন কি আমরা সুন্দরবন বাচানোর জন্য প্রতিবাদ করব না? সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, ইরাবতি ডলফিন থেকে শুরু করে সুন্দরী বৃক্ষদের মিছিল সমাবেশ করার ক্ষমতা থাকলে এতদিনে তারা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসত, সব কিছু অচল করে দিত। এদের হয়ে সুন্দরবন রক্ষার দ্বায়িত্ব এখন আমাদেরই বন্ধুগণ, চুক্তি কিন্তু হয়ে গেছে, সরকার কিন্তু কাজ শুরু করে দিয়েছে:

'বাগানের চারা গাছ রে, ডেকে ডেকে বলি, ডেকে ডেকে বলি, রাস্তায় নেমে আয়।'

***রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন:

সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব নিরুপন বা ইআইএ বিশ্লেষণ-১

সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব নিরুপন বা ইআইএ বিশ্লেষণ-২
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৩৮
৮১টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×