১
যদিও জানি, আজকে মর্নিং ওয়াকের সময় কি হবে। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার সময়। তারপরও বের হলাম। আসলে হতে বাধ্য হলাম। না বেরোলেই যে ভবিতব্য পাল্টাতে পারবো এমন তো আর না। হয়তো অন্য প্ল্যানটা আরও বিচ্ছিরী হবে। তাছাড়া কথা দেয়া ছিল। অন্য দিন যেমন নির্ভার চিত্তে বেরোতাম, আজ শুধু তেমনটা হল না। এই ছোট্ট পরিবর্তনটি ছাড়া আর তেমন কোন পার্থক্য নেই। ধীরে সুস্থেই হাঁটছি। আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। অপেক্ষা করে আছি।
তথ্যটা আগে জানতে পেরে, একটা সুবিধা হয়েছে। এই দুইদিনে সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছি। গাড়ীটা ছিল ব্যাংকের লোণের টাকায় কেনা। বেশ কিছু টাকা শোধ দেয়া বাকী ছিল। সেগুলো কালকে শোধ করে দিলাম। গাড়ী কেনার পুরোটা হয়তো নিজেই দিতে পারতাম, তারপরও দিই নি। লোন না নিলে আবার ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলায় পড়তাম। কাল থেকে যেহেতু আর ইনকাম ট্যাক্স দেয়ার ব্যাপার থাকবে না তাই এই ঝামেলা রাখারও কোন মানে হয় না। নিজের নামে যা কিছু ছিল সবই এক ছেলে আর এক মেয়ের নামে ট্র্যান্সফার করে ফেলেছি।
মেয়েটা বড়। এবার ইন্টারমিডিয়েট দিবে। ছেলেটা ছোট। ওর জন্যই একটু খারাপ লাগছে। আসবার আগে ওকে শুধু একটু আদর করে এসেছিলাম। বাসায় কাউকে কিছু বলিনি। বলে লাভ ও নেই। বরং কান্নাকাটি করে সে এক অবস্থা করবে। জমিটা বিক্রি করি নি। করলে হয়তো দেখা যাবে এরপরে পুরো পরিবারের ওপর আঘাত আসবে।
এদিক ওদিক তাকালেও বেশী তাকাচ্ছিলাম সামনের দিকে। আসলে ভেবেছিলাম বোধহয় সামনে থেকে আসবে। তাই সামনের দিকে কিছু দেখতে না একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। মোটর সাইকেলের আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে তাকালাম। দুইজন ছেলে মোটর সাইকেলে করে আসছে। আমার দিকেই। আশে পাশে যদিও অনেকজন আছে। তারপরও মনে হচ্ছে আমিই টার্গেট। দুজনের মুখই হেলমেটে ঢাকা। এরাই বোধহয়।
২
জমিজমা নিয়ে ঝামেলা অনেক দিন থেকেই চলছিল। মামলা মোকদ্দমা পর্যন্তই ছিল। উকিলের পেছনে খরচ আমাদের দুইজনেরই নেহাত কম হচ্ছিল না। প্রথম প্রথম কষ্ট হত, পড়ে অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। অনেকে সেটেলমেন্ট ও করিয়ে দিতে চেয়েছে। কেউই আমরা রাজী হই নি। মনে মনে তৈরিই ছিলাম, এ নিয়ে আরও অনেকদিন লড়তে হবে। যুদ্ধটা আসলে হচ্ছিল নার্ভের। কে আগে ভাঙে। মনে হয় আমিই রণে ভঙ্গ দিতাম। কারণ, আমি একটু দুর্বল অবস্থানে আছি। জমিটার দখল আমার কাছে নেই। তবে জায়গাটা ঢাকার প্রাইম লোকেশানে। আর দলিল ও আমার নামে, আসলটা।
শক্তিশালী পার্টি না হলে কেউ কিনবে বলে মনে হয় না। অপেক্ষায়ও ছিলাম খুব শক্তিশালী একজন পার্টির। আর একটু ভালো দামের। সেটা পাওয়ার পরেই প্রায় স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। জায়গাটা বিক্রি করে দিব। কথা বার্তাও শুরু হয়েছে। তবে তেমন রাখঢাকের চেষ্টা করিনি। কথাবার্তা প্রায় ফাইনালই। যেকোনো দিন হয়তো জমি রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে।
ফোনটা এমন সময়ই পেলাম। ঐ পক্ষের গোপন খবর জানার জন্য একজন লোক সেট করা ছিল। সেই জানালো। আমাকে শেষ করার জন্য লোক ভাড়া করা হয়ে গেছে। কবে আর কখন মারবে সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। হাতে সময় কতটুকু আছে? দিন না মাস? সময়টা কখনও? যখন আমি সকালে মর্নিং ওয়াকে বের হব তখন? নাকি বাসায় এসে সবার সামনে?
কে খুন করবে সেসব খবর ও পেলাম। গ্রুপটা নাকি বেশ ক্ষমতা রাখে। এখন পর্যন্ত কোন টার্গেট মিস হয় নি। ঠিক দিনে, ঠিক সময়েই ওরা কাজ সারে। ফলে মিস হওয়ার কোন উপায় নেই। বেশী টাকা দিয়ে কাজটা বন্ধ করাবারও উপায় নেই। আরেকজনের কাছে বেশী টাকা খেয়ে ডিড ক্যান্সেল এরা করে না। সেই লাইনে ট্রাই করে লাভ নেই।
আমার ওপর মনে হয় নজরও রাখা হচ্ছে। যদি পালাবার চেষ্টা করি সে জায়গা পর্যন্তও ওরা পৌঁছে যাবে। কিংবা দারোগা-পুলিশ করতে যাই তবে ওরাই হয়তো ঠিকানা বলে দেবে। সব জায়গায় ওদের ইনফর্মার থাকে। নেগোশিয়েশান এর চেষ্টা করেও নাকি কোন লাভ নেই। এদের যা নিয়ম, কন্ট্রাক্ট একবার দিয়ে ফেললে আর উইথড্র করা যায় না। আমার ইনফর্মার শুধু একটা ঠিকানা দিল। উনার কাছে গেলে একটা বিশেষ ধরনের সাহায্য পাওয়া সম্ভব।
৩
ঠিকানা টা যখন পেয়েছিলাম, বিশ্বাস হয়নি। এধরনের লোক যে পাওয়া যায় তা জানতাম। তবে এভাবে সর্ব সমক্ষে? রীতিমত অফিস খুলে? আমার নেহাত নিরুপায় অবস্থা। তাই ভয়ে ভয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম। এখানে এসে শুধু হতবাক হয়েছি বললে ভুল হবে। রীতিমত স্তম্ভিত।
যিনি আমাকে এই ঠিকানা দিয়েছেন তিনি অবশ্য বলেই দিয়েছিলেন, এখানে অনেক দালাল আছে। সবাই চাইবে নিজের অফিসে নিয়ে যেতে। ওরা কমিশন পায়। তবে ওদের নিজস্ব একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। স্পেসিফিক কারো কাছে ক্ল্যায়েন্ট এলে এরা ঝামেলা করে না। ওখানে যেয়েন না, আমাদের সার্ভিস ভালো, এমন কিছু বলে নিজেদের দিকে টানে না। সুন্দর ভাবে তাঁর অফিসে পৌঁছে দেয়।
পৌঁছোবার সাথে সাথেই অনেকে নিজেদের লিফলেট নিয়ে এগিয়ে এলো। কার কত রেট। কত অল্প সময়ে কাজ সেরে দেয়। এর মাঝে একজন খুব ভদ্রভাবেই জানতে চাইলো, স্যার কি কারো রেফারেন্স এ এসেছেন?
--জ্বী।
এই বলে কাগজটা এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোকের নাম লেখা আছে। নামটা দেখেই পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেল। ‘আসেন স্যার’ বলে একজন সঙ্গে করে নিয়ে গেল। নীচে, আন্ডার গ্রাউন্ডে বিশাল সব অফিস। আমি যার কাছে যাচ্ছি তার অফিসও বেশ সুন্দর। তার সেক্রেটারির কাছে পৌঁছে দিয়ে ছেলেটা আমাকে বসতে বসে চলে গেল।
--আপনার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
--জ্বী না।
--কে পাঠিয়েছেন?
আমার ইনফর্মারের নাম বললাম। মেয়েটা আমার নাম আর সেই ইনফর্মারের নাম লিখে ভিতরে পাঠাল। কিছুক্ষণ পরে ডাক পেলাম। ভেতরে ঢুকে বললাম,
--স্লামালেকুম।
মাথা ঝুকিয়ে সালাম গ্রহণ করলেন। বেশ সুদর্শন দেখতে ভদ্রলোক। এখানে তাঁর কাজ কি তাও জানি না। তবে এসব কিলিং মিশনের লোক বলে মনে হচ্ছে না। মনে কেন যেন আশা জাগছে, বোধহয় এই লোক কিছু সাহায্য করতে পারবেন। খুব করুন করে নিজের পরিস্থিতিটা বোঝাতে হবে।
--বলুন।
--আমার অবস্থাটা একটু জানতে এসেছিলাম।
তিনি বেশ কিছুক্ষণ হাতের কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এরপরে বললেন,
--শর্ত জানেন তো?
--কি শর্ত?
--শর্ত হচ্ছে তথ্যটা জানবার পরে আপনি কোন রকম চেষ্টা করবেন না। না পালাবার, না নিজের স্বভাব পালটাবার।
--বেশ।
--ঠিক আছে।
এরপর ভদ্রলোক কম্পিউটারে কিছু কাজ করলেন। সম্ভবতঃ ডাটা সার্চ করলেন। আমার তথ্য খুঁজে পেয়ে এবার আমার দিকে তাকালেন।
--আপনার টাইম হচ্ছে...মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা।