somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুরণন

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বৃদ্ধাটি আমার মাতামহী। শুনেছি অসহায়দের প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। তার কাৎ করা পিঠে কচি আঙুলে জামবাকের মালিশ সামান্য উপশম দেয়ায় তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে প্রার্থনা করেছিলেন। হয়তো এজন্যই পুরস্কৃত হয়েছি এই বেলায়। বর্ধিত সে আঙুলের গিঁটে এখন ফরমায়েশী কলম চলে, শিশু দোলে, বিড়াল খাবার খায়, বাথরুমের কলের চাবি প্যাচ খেয়ে নিমেষেই বালতি ভরে।

অন্ধকারের একাকীত্বে সেই আশির্বাদটির অসারত্ব বুঝতে চাই। এমন মমতাময়ী স্পর্শ জীবনে আর কখনো পাওয়া হবে না। তার প্রতিদান দিতে জানবো না, তবে দু দণ্ডের কষ্ট লাঘবের বিনিয়মে আজীবন আশির্বাদগ্রস্ত হয়ে রব কেন?

মানুষটি ছিলেন মৃদুকণ্ঠস্বরের অধিকারিনী । গুন গুন করে কোরান পড়তেন । পরী ও চাঁদের রূপকথায় তার আগ্রহ ছিল। আমাদের বলতেন, থামতেন চলতেন, তার চোখ ছল ছল করতো । আমরা ভাইবোন বালিশে শুয়ে মুগ্ধ হয়ে সে গল্প শুনতাম। কাহিনীগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে কিন্তু মনে লেগে আছে এখনো। দীর্ঘদিনে তাকে বিস্মৃত হই। কালে ভদ্রে গ্রামের পরিত্যক্ত বাড়িটি চোখে ভাসে। ভারী পালঙ্কটিতে তিনি শুয়ে আছেন। ঝুলে পড়া চোখ, শিথিল চামড়া, জামবাকের কড়া গন্ধ ভেসে আসে। কল্পনাতেও যেন সম্মোহিত হয়ে থাকি। ঘটনাগুলো সাধারণত: ঘটে খুব ভোরে। ভোরের আজানে মানুষ জেগে ওঠে - অতীতগুলোও জেগে উঠতে চায় তার সঙ্গে।

একদিন চোখ খুলে দেখলাম বিস্ময়কর এক দৃশ্য। পাশের দালানের বারান্দায় একজন বৃদ্ধা বসে আছেন। মনে হলো তিনিই হবেন। খুব আগ্রহ নিয়ে উদাস ভাবে চেয়ে রইলাম । কিছুক্ষন পর তাকে আর পেলাম না। নির্মাণাধীন বাড়ির কঙ্কালে শূণ্য বাঁশের চোঙায় একটা দোয়েল জমানো পানি খাচ্ছিল। আমি তাকাতেই পাখিটা ভয়ে ডানা মেলে উড়ে গিয়েছে ।


আমার মাতামহীর পৃথিবী ঘোরার সুযোগ ছিল না। তার বিশ্ব মানে ছনের বসতবাড়ি, পানির কলস, গাভীন গরু আর স্নানের লাজুক পুকুর। সন্তানদের জন্য ভালবাসার বিস্তার ছাড়া এমন কোন সঙ্গীতও তিনি জানতেন না। ইংরেজী বা ফার্সীর দখল ছিল না, লোকমুখে শোনা কাহিনী ছাড়া কোন বিদ্যাও ছিল না। পাখি দেখলে বলতেন পক্ষী। চাঁদকে জানতেন আলোকময় বাতি। গ্রহ বা নক্ষত্রের শ্রেণীবিন্যাস তো এযুগের বিষয়।

তারপরও মানুষটিকে ঘিরে শৈশবের কত আশ্চর্য সময় কেটেছে। তখনই টের টেয়েছিলাম পাপী হলেই শাস্তি পায় আর নির্দোষেরা পুরস্কৃত হয়, এই তত্ত্বটা সঠিক নয়। তিনি স্বামীর সংসারে এলেন পিতার ইচ্ছায়, উটপাখির মতো মুখ গুঁজে জীবন কাটালেন, সাওতালদের যাত্রা দেখতে যাননি, ঢাকের শব্দ শোনেননি, পরপুরুষের চোখেও তাকাননি, তারপরও বিছানায় পড়ে থাকতে হলো বছরের পর বছর।

শুনেছি বুলেটে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেয়ে রোগশয্যা অধিক কষ্টকর। জেলের শিকে বন্দীত্ব অধিকতর সহনযোগ্য। দিন দিন তার কুঁচকানো চামড়ায় প্রদাহ বাড়ছিল। বক্ষে যন্ত্রণা বাড়ছিল। এভাবে কারো করুণা নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢেঁকিতে চাল কাড়তে ব্যস্ত হয়ে যেতেন পিঠা করে খাওয়াবেন বলে, তুষের আগুন ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালতেন অথবা মাচা থেকে নিজেই কুমড়ো পেড়ে চিংড়ি মাছের তরকারী বসাতেন।

পৃথিবীর এক কোনায় বল্গাহরিণ খেলে বেড়ায়, বৈকাল হ্রদে সমুদ্রের চেয়ে গভীরতা বেশী - এসব তার ভাবনার অতীত। প্লেনের ডানায় মানুষ পাখির চেয়ে নিশ্চিন্তে উড়ে যায় বহুদুর। উপত্যকার ভাঁজে কত মানুষ পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এসব কিছুই তিনি জানেন নি। ভাবছিলাম একদিন যদি দেখতেন কুড়েঘরের সামনে সাদা তুষারপাত হচ্ছে তবে তার কেমন লাগতো? আল্পস বা ফুজিয়ামার বরফচূড়া দেখলে তিনি কি বলতেন? অথবা যদি দেখতেন ল্যুভ মিউজিয়ামের পাশে নদী এবং পতিত রঙিন ম্যাপলপাতা! হয়তো ব্যস্ত শহরে ছেড়ে দিলে বিস্মিত হয়ে কাচের দালান দেখে নজর ফেলতে পারতেন না। কী এমন ক্ষতি হলো এসব না দেখাতে। সরল বিশ্বাসগুলো নিয়ে পৃথিবীর নিয়মে তিনি চলে গেছেন বহু বছর হয়।

এখন কোথাও গেলে আমার মাতামহীর অপূর্ণ বাসনাগুলো মনে হয়। ভাবি যদি তাকে চাবাগানের কুলিদের গান শোনাতে পারতাম - এমন প্রশান্তিময় সঙ্গীত তিনি কখনোই শোনেন নি। পহেলা বৈশাখের শহুরে মিছিল দেখাতে ইচ্ছে হয়েছিল, বেলুনমুখোস নিয়ে যখন শত শত মানুষের ফিরে আসে - আনন্দের বিশাল সমারোহ তার দেখা হয়নি। প্রতিদিন নবঘুরালেই টিভিতে শত দেশের দৃশ্য দেখি, দৈনিকে বিশ্বটাকে হাতের মুঠোয় রাখি তেমনটা তিনি ভাবতেই পারতেন না। যদি খেতে যেতাম, চীনাদের সুতলী পাকানো খাবার আর ইটালিয়ানদের পনির মাখানো আটার চটা খেতে তার আগ্রহও হতো না। নারী হলেও খুব আদিম যুগের এক অশিক্ষিত রমনী তিনি। সবচেয়ে দামী অভিনেত্রীরা যে পোষাকে নেচে যাচ্ছে, মহিলা সাঁতারুরা যেভাবে অলিম্পিকে ডাইভ দিচ্ছে তারাও তার মতো নারী। পোষাকটুকু বদলে ফেললে প্রায় মানুষকে আলাদা করা মুশকিল। বেঁচে ছিলেন নিয়ম করে আশায়, জানতেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনে অসীম সুখের আশ্রয়।

এক সময় পরিবারের সবার ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রাখার পরিকল্পনা হয়েছিল। একটা ঘর আলাদা করে শুধু পূর্বপুরুষের ছবিগুলো ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হয়নি। ছবিগুলো খাতা পড়েই থাকলো, দৃশ্যগুলো কখনই আর আঁকা হলো না।

ঘুম ভাঙলে ইদানিং নানাবিধ সমস্যায় মাথা চিন চিন করে। জলের রসায়নে ঘুমহীন চোখ অনিচ্ছায় খুলে যায়, বাসের ঝুলন্ত হাতে বিবর্ধিত হয় হাতের দৈর্ঘ, অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলোয় জানালায় চেয়ে দেখি স্কুল ব্যাগের ছাত্ররা হৈ রৈ করে পথ চলছে। কখনো বসে যেতে ঝিম ভাঙে, কর্কশ কন্ডাকটর টাকা চায়। বের করি। বয়ে চলছি নানা আকারের থলে। কোনটা অর্থের কোনটা স্বার্থের। বয়ে চলাই যেন জীবনের নিয়ম, নিছক চলতে থাকাই যেন জন্মান্ধ অভ্যেস
---
ড্রাফট ১.০
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪৭
১২টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×