কুতুবুদ্দি বাড়ি ফেরার পর শুনতে পেল তার আশ্রিত ছেলেটা পালিয়েছে। অভ্যেসমত দুপুর পৌনে একটায় গিন্নির পাকানো মসুরির ডাল আর মাড় না গালানো মোটা চালের ভাত খাওয়ার জন্য সে বের হয়। হাজার সমস্যাতেও নিজের বাড়ির খানায় অন্য রকম শান্তি। বিশ্বস্ত একটা কর্মচারীকে ক্যাশে বসিয়ে বলে যায় দেরী হলে ফোন দিতে। মায়ের দোয়া তৈলভাণ্ডারে আজ যা ঘটেছে তা দু:খজনক। মহাজনের সঙ্গে কথা হয় নি, তার কানে গেলে এলাহী কাণ্ড হতো। জমিজমার গেঞ্জাম মিটাতে বিক্রমপুর গেছে। নিশ্চয়ই মাথা গরম আছে। বহুবার চেষ্টা করেও সিগনাল পায় নি। আর ঘটনাগুলো এমন কেন, এগুলো ঘটে যখন কুতুবুদ্দির হাতে দোকান থাকে।
কুতুবুদ্দি দায়িত্ববান মানুষ। সাড়ে নয়টায় উদাম ঝিনুকের মতো দোকানের ঝাপ খুলে রাখে। কাস্টমার না পেয়ে যখন ক্যাশবাক্সের উপর মাছি তাড়াচ্ছিল ঠিক তখনই ভেজাল বিরোধী পুলিশ নেউলের মতো হানা দেয়। কাঠের তাকে থরে থরে প্লাস্টিকের বোতল সাজানো। এক পাশে চার খান বড় ড্রাম। খুচরা বিক্রির জন্য নানান আকারের মাপনী চোঙ। লম্বা লিক লিকে নুতন ম্যাজিস্ট্রেট অনুমতি তোয়াক্কা না করে এসব ধরে দেখে। ভিতর থেকে তেলের একটা বোতল বের করে আনে। ঝাঁকায়, যন্ত্রপাতি ফিট করে। তারপর ডেকে বলে গতবারের মত সোয়াবিন তেলে খারাপ কেমিক্যাল পাওয়া গেছে।
কুতুবুদ্দি অনেক ভাবে বুঝিয়েছে যে সে কর্মচারী। কারখানায় কি ঘটে একমাত্র মহাজনই জানে। তবে তার ভয় হয় না। গতবছর এই দিনে তার ঘাড়ে দোকান ছিল। ভয়ে তার কলিজা উড়ে যায় যায়। কিন্তু সেই বার দারোগাসাহেব জিগার কা দোস্তের মতো বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী ঘষে পরিচিত ইঙ্গিত দিয়েছিল ।গতকাল বিক্রিবাট্টা না থাকায় ক্যাশের অবস্থা খারাপ। সে ছুটে প্রতিবেশী হাওলাদারের হার্ডওয়্যারের দোকানে যায়। দোকানগুলো বন্ধ। আর বাকি দোকানেও কেউ বাকি দিতে রাজি হয় না। ম্যাজিস্ট্রেট লোকটা চরম খাটাস। আটশ পয়ত্রিশটাকা গুজে দিলে দারোগা অনিচ্ছায় কাগজগুলো থুতু দিয়ে গুনে নেয়। জরিমানা কিছুটা কমেছে তাতে কিন্তু অব্যাহতি পায় নি। সাংবাদিকদের একজন ছবি তুলতে গেলে সামলানো যায় নি।এখন সমস্যা হবে খবরের কাগজে দোকানের নাম উঠবে। তার উপর হাজিরার তারিখ সামনের ২৩ তারিখ।
কুতুবুদ্দি আধা ঘন্টা মোবাইলের বোতাম টিপাটিপি করেও মহাজনকে ধরতে পারে নি । যা হবার তাই হবে। সে জানে এসবের জন্য মহাজন তাকেই দুষবে। পয়সা কম দিবে বেতনে। লোকটার এমনিতেই ভাবে কুতুবুদ্দি প্যাচগোছ কম বোঝে। তার বয়সও হয়েছে, হয়তো বিকল্প লোক দরকার।
পায়ে হেটে বাড়ি আসার বদলে বিষন্ন কুতুবুদ্দি একটা চওড়া রিক্সা খুঁজছিল। রিক্সায় ঘুরলে যদি মাথা ঠান্ডা হয়। এখানেও তার এক আজব বাতিক আছে । যে সে রিক্সায় সে ওঠেনা। কুমিল্লার রিক্সা তার অপছন্দ। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে অগত্যা কুমিল্লার রিক্সাই পেল। রিক্সাটার চিপা বডি, সীট ছোট। তবু উঠে পড়ল । আর পা ছড়িয়ে বসতে গিয়ে সীটের দেয়ালের রেক্সিনে কচি চারাগাছের মতো একটা তারকাটা তাকে বিদ্ধ করলো। রিক্সাওয়ালাকে দাঁত খিঁচিয়ে গালি দেয়া দরকাম। এসব দিয়ে কী লাভ? সেও তো তার মতই গরিব মানুষ। গ্যারাজে ভোর বেলায় যেটা খালি তাই নিয়ে বউনি করে। রিক্সার বডি সীট মাথার হুড এসব ইনস্পেকশনের সুযোগ কি তার থাকে?
ব্যথায় কাতর হয়ে নিতম্বে হাত বুলাতে বুলাতে রক্তের ফোটা টের পায়। মাছের আঁশের মতো প্যাণ্টের কাপড় ছিঁড়ে উঠে এসেছে। থুতু লেপে রক্তটা মেরামত করতেই বুঝতে পেল রিকশাওয়ালাটা ঘুরে ভিন্ন গলিতে ঢুকেছে। কুতুবুদ্দি এবারও কিছু জিজ্ঞেস করতে গেল না। এই সময়ে জ্যাম থাকে, রিক্সাওয়ালা হয়তো ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। বিকল্প পথটা নির্মানাধীন। ইঁটের ঝাঁকি অসহ্য লাগছিল। জণ্ডিস আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে কুতুবুদ্দির বমির স্বভাব। মজুরেরা ধরা ধরি করে পিচ ঢাকছে । কাল চটচটে, ঝোলাগুড়ের মতো, গন্ধটা গলা উটকে দেয়। পথের পাশে সুরকি মেশানোর কলটা ভক ভক শব্দ করে ঘুরছে। আলকাতরা পোড়া ধোঁয়ায় স্নান সমাপ্ত করে কুতুবুদ্দির চশমাটা ঘুরে গেল সবুজ সিএনজির দিকে ।
যা দেখল তাতে সে নড়ে চড়ে উঠল। অল্প বয়সী একটা মেয়ে বসে আছে সিএনজির লোহার খাঁচায়। তার পাশে তারই সদ্য কলেজপড়ুয়া সন্তান রুকনদ্দি। প্রথমে সন্দেহ হয়, পরে চুলের কাটিং দেখে নিশ্চিত হয়ে যায়। বুঝতে পারে রুকনদ্দি কাল রাতে কেন পয়সা চেয়েছিল। কোচিং সেন্টারের বেতন চেয়ে কান্দা কাটিও হয়েছে। একদিন ছেলেটার হাতে একটা মোবাইল দেখে ঝাড়ছিল। তার স্ত্রী ছেলের নিজস্ব উকিলের মতো উল্টো তাকে অভিযুক্ত করেছে। সন্তানের পড়ালেখায় অবনতির জন্য বরাবরই কুতুবুদ্দিকেই দায়ী করা হয়। এক দৃষ্টে সিএনজির চলে যাওয়া দেখে অবশেষে রিক্সা থেকে নেমে আসে সে।
সে হাটতে থাকে। মনে হয় পথ শেষ হয় না।
(ক্রমশ:...)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১১ সকাল ৭:০০