somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিত্তির গেইট

৩০ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বদরুলের বাপের নিজেরও খিদে পেয়েছিল। আসলে এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে এসেছে, প্রায় কুড়ি মাইল। ময়মনসিংহের কৃস্টর বাজারের ইট বিছানো পথে চাকাটা থেমে থেমে যায়।
জং ধরে গেছে হাতলে, পাম কমে গেছে চাকায়। পাম কমে গেলে ঘোড়ায় চড়ার মত দুলুনি আসে। ছেলেটার ছাত্রসখা, একটা অঙ্কের বই, পেন্সিল কলম একটা কাপড়ের পুটুলির মত বাঁধা।
আব্বা, আর কত দুরাফি?
বদরুলের বাবা কতক্ষণ ধরে প্রশ্ন শুনছিল ছেলেটার। ঘেমে যাওয়া মানুষ সব কথার জবাব দেয় না। একটা গাছের ছায়ায় ব্রেক কষে দাঁড়ায়। জটাধারী বটগাছ। ঝুড়ি নেমে আসছে, গাছের গায়ে বাঁধা গোল একটা বাক্সে নজর পড়ে লোকটার।
মুক্তহস্তে দান করুন। হাফেজিয়া মাদ্রাসা। দোজাহানের অশেষ নেকি হাসেল করার আহ্বান। বাক্সটার চাবি খোদার কাছে থাকে না। কেউ জানে না এই অর্থ কি আসলেই কি খোদার কোন কাজে আসে কিনা।
বদরুলের বাপ জামার পকেটে হাত দিয়ে পাঁচটাকার নোট বের করলো। বদরুল দেখতে পায় জামার হাতা ধুয়ে ধুয়ে ফেঁসে গেছে।
লোকটা হাসে, উইঠ্যা ব, ঠ্যাঙ লাড়িস না যেন। আমরার অহনই মেলা দেওন লাগবো।
আব্বা, আব্বা
ছেলেটা বাপের কাছে একটার পর একটা কথা বলে।
বিত্তি পাইলে আম্মারে একটা শাড়ি দিবাব।
বদরুলের বাপ ছেলেকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, তোর মায়েরেই দিবে, আমারে দিতে না?
আপনেরেও দেয়াম একটা নতুন এককান শাট দেয়াম।
ইঁচড়ে পাকা কথা শুনে বদরুলকে খুশিতে ধরতে ইচ্ছে হয় লোকটার কিন্তু সাইকেল চলছিল।
লোকটা জানে তার ছেলে অন্যদের চাইতে মেধাবী। কোন দিন ক্লাসে দ্বিতীয় হয় নি। পড়ার খুব আগ্রহ। গত কয় রাত কেরোসিনের বাতিতে বহু রাত পর্যন্ত পড়া মুখস্থ করেছে। ইস্কুলের শিক্ষকেরা বলেছে ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে। এখন সব কিছুই আল্লাহ তালার ইচ্ছা।
হঠাৎ তার মনে হয় যদি আল্লাহ তার দিকে নাখোশ হয়ে থাকে।
বদরুলের বাপ অসৎ না। কোন কৃষকেরই দুর্নীতির সুযোগ থাকে না। তবে গত বার চেয়ারমেনের ইলেকশনের সময় বেশ কিছু টাকা চুরি করেছিল সে। সে একা না। গ্রামের একটা গ্রুপ যখন ঘড়ি মার্কা নিয়ে মিছিল করছিল, তখন তাদের পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল ক্যাশ, টাকাটা কাউকে না বলে বদি, মকবুল, সৈয়দালি, উসমান ভাগবন্ট করেছে। বদরুলের বাপ কখনো টাকা মারে নি। যদিও চেয়ারমেন নিজে এক দুর্নীতিবাজ মানুষ। তবুও পাপ পাপই
মিথ্যা বলার জন্য আল্লাপাক দুনিয়াতেই নানান শাস্তি প্রদান করে। এটা ভেবেই মনে হল তার এই চুরির পাপে তার সন্তান বৃত্তি বঞ্চিত হবে।
সে রওনা দেয়ার আগে পকেট থেকে পাঁচটাকা বিসমিল্লা বলে দান বাক্সে ফেলে।


যখন জিলা স্কুলের সামনে আসে মাথার উপর সূর্য। রাজহংসের পাখার মত চুনা রঙ করা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে গর্বে বুক ভরে ওঠে বদরুলের বাবার। এই স্কুল এই অঞ্চলে সবচেয়ে নামকরা।
শত শত মানুষ এসেছে। বড় মেলার মত। সেখানে তার ছেলে এত শত মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে। নৌকা বাইচের কথা মনে পড়ে বদির বাপের।
এক সময় একত্রিশটা নৌকা পিছনে ফেলে তার নৌকা প্রথম হয়েছিল ব্রহ্মপুত্রে
সে জানে দুনিয়াতে জিততে না পারলে কেউ দাম দেয় না। আর তার সন্তান কে পেট ভরে খেতে না দিলেও আল্লাহ মাথায় নূর দিয়েছে
জ্ঞান মানেই তো নূর। বড় হুজুর বলতেন।
গত রাতে জুম্মা মসজিদের হুজুরের দোয়া পড়া পানি এনে খাইয়েছে ..যদি বৃত্তি পায়।
তখনো পৌনে এক ঘণ্টা বাকি। ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়লো। ইস্কুলের সামনে পুলিশের ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে যাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে। গেটের বাইরে থেকে অভিভাবকেরা ঠেলে দিচ্ছে ভেতরে।

বদির বাপ তার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু খিদেটা যায় নি। কলা আর বনরুটি খেয়েছিল ইস্টিশন থেকে। কিন্তু পরিমাণ যথেষ্ট হয় নি।
আব্বা আপনের খিদা লাগে না? রইদ উঠতাছে।
বাপের হঠাৎ কষ্ট হয়, বলে তুই কি খাইবার চাস ক, তরে দেই। আমরার কি খাওনের পইসা নাই। আমরা না খায়া থাহি? ক আমারে তোরে যা মন লয় খাওয়াম। টাইম ডা কম
ছেলেটা বোকার মত বলে ওঠে, আব্বা আমি মণ্ডা খায়াম।

মণ্ডা অত্র এলাকার প্রসিদ্ধ ছানার মিষ্টি। ছেলেটা এই অসময়ে মণ্ডা খেতে চাবে আর খেতে দিতে পারবে না এটা বাবা হয়ে লোকটির ভাল লাগে না।
মণ্ডার দাম তেমন বেশি না। এখনো যে সময় আছে দ্রুত মণ্ডা দিয়ে দেয়া যায়। চাইলে পোটলায় ভরে দিলে ভিতরে গিয়ে খেতে পারবে।
সে বলল, আয়, আমার লগে, বাপ। তোরে মণ্ডাই দেয়াম। বলে সে হন হন করে ছুটতে থাকে দোকানে। চাষা হলেও কৃষকের হাতে একটা ঘড়ি পরা। এটা দিয়েছিল শহর থেকে আসা জনৈক আত্মীয়।
সে কাঁটার দিকে চেয়ে দেকে দশ মিনিটেরও কম সময়। এরপর গেট বন্ধ হয়ে যাবে স্কুলের।

অযৌক্তিক ইচ্ছেগুলো বাবার কাছে জরুরী মনে হল। সে মোসলেম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে গিয়ে জলদি একটা ব্যাগে মণ্ডা কিনে নেয়।
তারপর ফিরে আসতে থাকে। ঠিক তক্ষুনি একটা গাড়ি এসে রিক্সাকে ধাক্কা দেয় দোকানের উল্টো পাশে। বেশ একটা জটলা তৈরি হয়। আর সে জটলা এড়িয়ে সন্তানকে নিয়ে স্কুলের সামনে আসে। ঢোকার শেষ ঘণ্টা বাজে।
পুলিশ সবাইকে সরিয়ে হাইস্কুলের গেট বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। অভিভাবকেরা সরে যেতে থাকে।

আব্বা চালায়া যাওন লাগবো..
গেটের সামনে এসে ছেলেটা তড়িঘড়ি করে

ঢুকে পড়ে ..বদরুলের বাবা শেষ বারের মত ছেলেটাকে কপালে মাথা ছুঁয়ে সুরা পড়ে দেয়।
ছেলেটা তখন গেটের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়।
বড় স্কুলের মাঠ বাইরে থেকে দেখতে পায় গার্জেন দের ভিড়ে বদরুলের বাবার মনে হয় তার সন্তান বৃত্তি পাবেই।ট্যালেন্ট-পুলেই পাবে। স্কুল থেকে মাইকে করে কৃতি ছাত্রের মালা দিয়ে গ্রাম ঘোরানো হবে।

বদরুল ছোট পা ফেলে দূরে চলে যায়। হঠাৎ লোকটা টের পায় সাদা পলি-ব্যাগটা তার হাতেই রয়ে গেছে। সদ্য কেনা কয় টুকরো মণ্ডা। বদিকে সে ডাকতে চায়, আব্বা জান প্যাকেট টা লয়া যা। ভিত্তে গেয়া খাইস।

ছেলেটার পেটে জানি কত খিদে। খিদেতে বৃত্তির আগে কয় পিস মিষ্টি খেতে চেয়েছিল। বাবা হয়ে তার বুকটা কেমন যেন লাগে। কেন সে মনে করে প্যাকেটটা দিয়ে দিল না।

..বদি মাঠ পেরিয়ে স্কুলের বারান্দায় উঠে গেল। গেট চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর বদির বাবা পুলিশের নির্দেশ উপেক্ষা করে চেয়ে দেখছে । হাতে সাধা ধপধপে মণ্ডার প্যাকেট।

--
ড্রাফট ১.০ / ১০ মিনিটের টাইপ করা গল্প
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:০৩
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×