এমন সময়ও আসে মাঝেমধ্যে, ঠায় বসে থাকতে মন্দ লাগেনা। ডানে তাকালে ভালো লাগে। আবার বামে তাকাতেও ভালো লাগে। চারপাশের লোকজনকে মর্ত্যের মানুষ বলে ভাবতে ইচ্ছে করেনা, ভাবতে ইচ্ছে হয় সবার আত্মা বিশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ঠিক এমুহুর্তে আমার ক্ষণজুড়ে কি ওই মাঝেমধ্যে আসা ব্যাপারটা ঘটছে? চারপাশের একটা বর্ণনা দেওয়া যাক।
প্রথম কথা আকাশ জোড়া বিশাল একটা চাঁদ। যে চাঁদটাকে গত কয়েকদিন ধিরে ধিরে বড় হতে দেখেছি, সেটা আজ তার সমস্ত আলো নিয়ে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ছে। আমার বাম পাশে পদ্মা। দূরে তাকালে দেখতে পাচ্ছি, তীরবর্তি ঘন হয়ে উঠতে থাকা প্রাচীন অরণ্য। অরণ্যের অন্তরালে জনপদ আছে, এই গভীর নিশুতিতে যে জনপদ ঘুমিয়ে আছে নিথর শ্রান্তিতে। সেসব ঘুমন্ত মানুষদেরও গল্প আছে, পথচলা আছে, তাদের হৃদয়ে পদ্মার মতো বিশালতা আছে কিনা জানিনা, হয়তো পদ্মা তাদের চোখে ভরা বর্ষাগুলোতে দুঃস্বপ্নই এনে দিয়ে থাকে।
এই রাত্রির মাঝ প্রহরেও এলাকাটা জনশুন্য নয়। চায়ের দোকান খোলা, খাবারের ক্যান্টিনও। এখান থেকে মাইল খানেক হেঁটে ডান দিকে গেলেই উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত নিশিপল্লী (কুক্ষাত কেন বলবো? নিখাদ শ্রম আর খাটুন্তে অর্থের বিনিময়েই এখানে লেনদেন হয়। দুর্নিতির মজ্জা নগর সভ্যতার গহীন ভিতরে। এখানে নয়।) যেখানে রাত্রি গভীর হলেই অন্যরকম সূর্য্য ওঠে। কোন একদিন এই আঁধারের রাজ্যে মানবতাকে দেখতে যাব আমি। একবিংশ শতকের মহান সভ্যতা আমাদের কতোটা আলোকিত করে তুলেছে, দেখা দরকার না? তবে আজ অন্যদিন। আজ নয়।
আমি বরং দেখি এক বিমুগ্ধ প্রান্তর। মাইলের পর মাইল বয়ে যাওয়া যে প্রান্তরে চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে জ্যোছনা। মনে করি কোন এক অজ্ঞাত মহাপুরুষের বাণী- হৃদয় বিষন্ন হলেই তা বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। চেনা বিষন্নতা নয়, জীবনের গভীর বোধের দিকে আমাদের টেনে নিয়ে যায়, এমন বিষন্নতা।
তোমার কথাও কি আমি মনে করবো? আমাকে পড়তে পড়তে দেখবে একদিন নারী থেকে মানবী হয়ে উঠেছো। সুতরাং তোমাকে বারবার মনে পড়বে। তোমার কথা আমাকে লিখে যেতে হবে। এমন নরম জোছনা নামলেই ইচ্ছে করবে হাত রাখতে হাতের পর। ভুলে কিভাবে যাবো, যাবে? এ পথ তোমার কাছে ফেরার পথ ছিলো। বিগত দিন ছিলো। রাত্রি ছিলো। এমন নরম জোছনা ছিলো। আমরা একটা নদীর এপার, ওপারে বসে বাতাসে এক প্রতিজ্ঞা ভাসিয়ে দিলাম। প্রান্তরে বিছানা পাতা এই জোছনার প্লাবন আমরা একসাথে দেখবো একদিন, পাশাপাশি। মানবী, প্রান্তর ভেঙে আজন্ম জোছনা নামে আজও, নামবে। কবে তোমার সময় হবে আকাশ দেখার?
আমি এখন কোথায় আছি বলবার কি প্রয়োজন? অনেকেই হয়তো বুঝে গিয়েছে, জেনে গিয়েছে। ফেরির অপেক্ষায় এক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আমার বাস। চারপাশের সবাই ঘুমন্ত। সামনের সিটে আমার খুব পরিচিত এক শিশু তার জননীকে বুঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে, বাস থেকে বাইরের হাওয়ায় যাবার তার প্রবল ইচ্ছা। জানালার পাশে বসে আমার কেনো কিছু করতে ইচ্ছে করেনা? হাঁসতে ইচ্ছে করেনা, কাঁদতেও না। অদুরে দাঁড়ানো শিরীশ গাছটার মৌনতা দেখে ভাবি, আমিও একদিন ওই গাছটার মতো হয়ে যাবো। ওকি? গাছের ডালে ডানা ঝাপ্টায় কোন অচেনা পাখি?
চাঁদ ডুবে গেলে কি ধুপ করে আঁধার নামবে? আন্দালুসিয়ান একটা প্রবাদ আছে। রাত্রির সবচেয়ে অন্ধকার সময় আসে সুর্য ওঠার আগের ঘন্টায়। জোছনা রাতের শেষে আঁধার ঠিক কখন নামে? নাকি নামেনা? এতসব ভেবে লাভ কি? বাতাসে মুখ বাড়িয়ে দিলেই আরাম। বাতাসেই তো জীবনের গল্প মিশে থাকে, লেপ্টে থাকে প্রিয় ঘ্রাণ, চেনা ইতিহাস। এখন বরং কবিতা পড়া যাক। জীবনানন্দের গভীর বিষাদিয়া লাইন।
আকাশে ঘুঘুর ডাক, বাতাসে ঘুঘুর ডাক এমন ঘুঘুর ডাক আজ
উঠোনে চাঁদের আলো, নরম চাঁদের আলো, এমন চাঁদের আলো আজ
তুমি যে রয়েছো কাছে,
তোমার হাতের ছায়া, তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৩