somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাইবারপরিসরে, বিকল্প মাধ্যমের খোঁজে

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১০ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাংবাদিকতার ইতিহাস যেখান থেকে শুরু, বিকল্প মাধ্যমের ইতিহাসও সেখান থেকে শুরু। ইউরোপে যখন প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, তাতে শিপিং, ব্যাংকিং, যুদ্ধ-সংঘাত এবং উদীয়মান ব্যবসায়ী শ্রেণীর চলমান ভাবনাসম্পর্কিত খবরাখবর প্রকাশিত হতো। বড়োলোকশ্রেণীর এই পত্রপত্রিকার বিকল্প হিসেবে বরাবরই নানা ধরনের সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তবে মধ্য-ঊনবিংশ শতাব্দিতে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত শ্রমজীবী শ্রেণীর পত্রিকাকে বিকল্প মাধ্যমের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হিসেবে বিশ্লেষকরা হাজির করে থাকেন। এই সংবাদপত্রগুলো র‌্যাডিকাল প্রেস হিসেবে পরিচিত ছিল; এই প্রেস শ্রম, ধর্ম ও মানবাধিকার সম্পর্কে র‌্যাডিকাল ধারণা পোষণ করতো। এই প্রেস শ্রমজীবীদের স্বার্থে সংবাদ পরিবেশন করতো এবং শ্রমজীবী শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধও করে তুলেছিল। প্রকাশনা প্রযুক্তি তখন সস্তা ছিল, ফলে শ্রমজীবীদের মালিকানাতেই পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া সম্ভব ছিল। আর এই পত্রিকাগুলো তখন জনপ্রিয়ও ছিল। পুওর ম্যানস গার্ডিয়ান, ফ্রি ইনকোয়ারার, পিপলস পেপার ইত্যাদি র‌্যাডিকাল পত্রিকার সার্কুলেশন ছিল অনেক।

এদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্রিটিশ সরকার কাগজের ওপর করারোপ করে, লাইসেন্সপ্রথা চালু করে, প্রকাশকদের হেনস্থা করে। কিন্তু এইসব পীড়ন র‌্যাডিকাল প্রেসকে দমাতে পারেনি, উল্টো তাদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। কিন্তু সরকার সংবাদপত্রের ওপর কর শিথিল করলে ও সংশ্লিষ্ট আইনকে উদার করলে বড়োলোকশ্রেণী নতুন উদ্যমে বড়ো বিনিয়োগ নিয়ে মূলধারার পত্রিকা চালু করে। তারা প্রকাশনা শিল্পের নতুন প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়, যা উন্নত ছাপা নিশ্চিত করে। কিন্তু এইসব নতুন প্রযুক্তি ব্যবয়বহুল হওয়ায়, র‌্যাডিকাল প্রেস তাদের ছাপাকে উন্নত করতে সমর্থ হয়নি। নতুন প্রযুক্তিতে ছাপা পত্রিকার পাশে সেসব পত্রিকাকে নি®প্রভ দেখায়। বিজ্ঞাপন ও বাজার ব্যবস্থা র‌্যাডিকাল প্রেস বিলুপ্ত হয়ে যাবার পেছনে আরেকটি কারণ। র‌্যাডিকাল প্রেস ছিল সার্কুলেশননির্ভর, কিন্তু মূলধারার পত্রিকা ছিল বিজ্ঞাপননির্ভর। র‌্যাডিকাল প্রেসের পাঠকরা পণ্যক্রেতা ছিলনা। তাই অনেক সার্কুলেশন থাকার পরও এসব পত্রিকা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। আর কম সার্কুলেশন নিয়েও মূলধারার পত্রিকাগুলো বহাল তবিয়তে টিকে থাকে। ১৮৫৬ সালে একজন বিজ্ঞাপন কর্মকর্তা বলেন, কিছু পত্রিকা মাধ্যম হিসেবে খুবই দুর্বল কারণ তাদের পাঠকরা পণ্যক্রেতা নয়, তাদের ওপর অর্থব্যয় করা আর তা জলে ফেলে দেয়া একই কথা (হারম্যান ও চমস্কি উদ্ধৃত, ২০০২: ৯৩)। জেমস কারান ও জাঁ সেটান দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ যা পারেনি বাজার সফলভাবেই সেই লক্ষ্য অর্জন করেছে (হারম্যান ও চমস্কি, ২০০২: ৮০)।

বিকল্প মাধ্যম হিসেবে বিশ্লেষকরা ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিদৃষ্ট নিও জার্নালিজমের পত্রিকাগুলোর কথাও বলেন। তবে নিও জার্নালিজম যতটা না আধেয়তে, তার চাইতে বেশি সংবাদ উপস্থাপনে বিকল্প ছিল। সচরাচর ‘ষড়-ক’নির্ভর সংবাদ তারা পরিবেশন করতো না। বরং সংবাদ পরিবেশনে এক ধরনের নাটকীয়তা ছিল। কখনও গল্প আকারে, কখনও সংলাপ দিয়ে এক ধরনের পরিবেশনা তখন লক্ষ করা যেত। ভিলেজ ভয়েস পত্রিকা এধরনের সাংবাদিকতার মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠে। পরে অবশ্য মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক পত্রিকাটিকে কিনে নেন।

র‌্যাডিকাল প্রেস বা নিও জার্নালিজম চর্চাকারী পত্রিকাগুলো ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে নানান ধরনের বিকল্প মাধ্যমের আবির্ভাব ঘটেছে। লক্ষ করার বিষয় হলো বিকল্প মাধ্যমের ইতিহাস হলো টিকে না থাকার ইতিহাস। কিন্তু বিকল্প মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা বরাবরই অনুভূত হয়ে এসেছে। এর কারণ মূলধারার মাধ্যমগুলো জনস্বার্থের চাইতে বরাবরই মালিকস্বার্থ বা বাজারস্বার্থকে বড়ো করে দেখেছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদী মতাদর্শই মূলধারার নিউজরুমগুলোতে গ্রথিত হয়ে রয়েছে। তাই ইস্যু হিসেবে, শ্রমিকদের নিম্নআয়ের চাইতে কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধিবিষয়ক কোনো সংবাদ সম্মেলন মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে বরাবরই বেশি গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। সা¤প্রতিককালের কর্পোরেট মালিকানা ও একচেটিয়া প্রবণতা গণমাধ্যমগুলোকে আরও বেশি জনবিমুখ করে তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রেডিও স্টেশন অপারেটর ক্লিয়ার চ্যানেল কমিউনিকেশনস ইনকর্পোরেটের সিইও বলেছিলেন, আমরা সংবাদ ও তথ্য পরিবেশনের ব্যবসা করতে আসিনি। আমরা সুনির্বাচিত সঙ্গীত পরিবেশনের ব্যবসা করতেও আসিনি। আমরা আমাদের ভোক্তাদের কাছে পণ্য বিক্রির ব্যবসা করতে এসেছি (Waltz, 2005: 8)। কর্পোরেট মিডিয়ার এহেন মানসিকতার বিপরীতে বিকল্প মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

কিন্তু বিকল্প মাধ্যমকে আজ আমরা কীভাবে চিনবো? আমাদের কি নতুন করে বিকল্প মাধ্যম দাঁড় করাতে হবে না এর নিদর্শন ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি? আমাদের দেশে এর খুব বেশি নিদর্শন দেখা না গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে, যেখানে মূলধারার মাধ্যমগুলো অনেক শক্তিশালী, নানা ধরনের বিকল্প মিডিয়ার অস্তিত্ব আছে। ধরা যাক ষাটের দশকের হিপিদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সংবাদপত্রগুলো। কিংবা একালে স্বল্প বাজেটের সাহিত্য পত্রিকা, র‌্যাডিকাল রাজনৈতিক মতাদর্শের পত্রিকা অথবা পরিবেশবাদীদের কিংবা নারীবাদীদের কমিউনিটি রেডিও। প্রতিদিনের মূলধারার পত্রিকা যা কাভার করেনা, তা তুলে ধরে যে মাধ্যম, সেটাই বিকল্প মাধ্যম। টিম ও’সুলিভান বলেছেন, বিকল্প মাধ্যম অবশ্যই বিপ্লবী পন্থায় সমাজ পরিবর্তনের ওকালতি করবে (O’Sulivan, 1994, ১৯৯৪, উদ্ধৃত Waltz, 2005)। তবে আজকের সময়ে বিকল্প মাধ্যম সবচেয়ে বেশি পরিদৃষ্ট হচ্ছে সাইবারপরিসরে।

ইন্টারনেটভিত্তিক বিকল্প মাধ্যম জিনেট-এর প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল অ্যালবার্ট (Albert, 1997) মনে করেন, মূলধারার মিডিয়া প্রতিষ্ঠান (সরকারী বা বেসরকারী) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রধান লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন এবং আয়ের উৎস হিসেবে এলিট অডিয়েন্সকে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করা। কিন্তু বিকল্প মিডিয়া প্রতিষ্ঠান মুনাফামুখী নয়, প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞাপনদাতার কাছে অডিয়েন্সকে বিক্রি করতে চায়না (তাই বৃহত্তর ও নন-এলিট অডিয়েন্সই তার উদ্দিষ্ট) এবং সমাজকর্তৃক সংজ্ঞায়িত স্তরভিত্তিক সামাজিক সম্পর্কের ধারণাকে অতিক্রম করতে চায়। অ্যালবার্ট মনে করেন একটি বিকল্প মাধ্যমের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে: ১. বিকল্প মাধ্যমের কর্মচারীরা পদবী ব্যতিরেকেই সমান পরিমাণ কাজ করবে এবং সমান বেতন পাবেন ২. সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সংগঠনের সবার অংশগ্রহণ থাকবে এবং সংগঠনটি স্তরভিত্তিক হবার চাইতে গণতান্ত্রিক হবে ৩. কষ্টসাধ্য হলেও লিঙ্গ ও বর্ণনির্বিশেষে শ্রমবিভাজনের বিভেদরেখা উঠিয়ে দেয়া হবে ৪. বিকল্প মিডিয়া প্রতিষ্ঠান যখন অডিয়েন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, তা মিডিয়া পণ্য দিয়ে হোক বা ব্যবসাসূত্রে হোক, মিথস্ক্রিয়াটি উপরোক্ত অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধভিত্তিক হবে ৫. কেবল বিজ্ঞাপনদাতাদের কল্পিত এলিট-ক্রেতাদের কাছে নয়, বিকল্প মাধ্যম প্রতিষ্ঠান বৃহত্তর ও সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছাতে চাইবে ৬. বিকল্প মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পরকে নানাভাবে সাহায্য করবে।

মাইকেল আলবার্ট বিকল্প মাধ্যমের যে-চিত্র অঙ্কন করেছেন, সেইরকম মূলনীতির বেশ বেশ কিছু বিকল্প মাধ্যম রয়েছে সাইবারপরিসরে। এই মাধ্যমগুলো অনেক ক্ষেত্রে পাঠক ও সদস্যদের চাঁদানির্ভর। এইসব বিকল্প মাধ্যম কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবাদনির্ভর - যেমন ইন্ডিমিডিয়া (Indymedia)। অনেক সময় তা বিশ্লেষণনির্ভর - যেমন জিনেট (Znet)। কোনো কোনো বিকল্প মাধ্যম আবার বিদ্যমান মূলধারার প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার সরসরি প্রতিপক্ষ নাম ও কাজ নিয়ে আবির্ভূত। যেমন মূলধারার প্রতিষ্ঠানে পরিবেশিত সংবাদের পাল্টা সংবাদ বা বিশ্লেষণ প্রদান করে ফেয়ারনেস এ্যান্ড এ্যাকুরেসি ইন রিপোটিং (FAIR) ও মিডিয়া চ্যানেল (Mediachannel)। আছে কর্পোরেটওয়াচ (Corporatewatch) বা ওয়ালমার্টওয়াচ (Wallmartwatch)। কর্পোরেট, সরকারী দুর্নীতি নিয়ে ও মূলধারার মিডিয়ার পাল্টা রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত হয় মাদার জোন্স (Motherjones)-এ। ফাস্টকোম্পানি (Fastcompany) বলে যে ওয়েবসাইট আছে তা মূলত দ্রুত বর্ধনশীল কোম্পানিগুলো ও সেগুলোতে নতুন চাকরির খবরাখবর পরিবেশন করে। ২০০০ সালে এর পাল্টা বিকল্প মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়েছিল ফাকডকোম্পানি (Fuckedcompany) যাতে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হওয়া ও বহুমানুষের চাকরি হারানোর খবরাখবর থাকতো। এরকম ভুরি ভুরি বিকল্প মাধ্যম ইন্টারনেটজুড়ে বিরাজ করছে। এইসব মাধ্যমে যারা কাজ করে তারা এ্যাক্টিভিস্ট, অনেক ক্ষেত্রে বামপন্থী ও র‌্যাডিকাল এবং এদের লক্ষ্য বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন। যেমন ১৯৯৯ সালে সিয়াটলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনবিরোধী আন্দোলনের ফসল হলো ইন্ডিমিডিয়া। পরবর্তী সময়ে বোস্টন থেকে বোম্বে পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী বিকল্প মাধ্যমটির ১২০টি অনলাইনভিত্তিক শাখা স্থাপিত হয়েছে (Beckerman, 2003)। ইন্ডিমিডিয়ার রিপোর্টাররা মনে করেন কোনো সাংবাদিকতাই পক্ষপাতমুক্ত নয়। এই পক্ষপাতকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যই মূলধারার সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতার কথা এত বেশি উচ্চারিত হয়। এধরনের বিকল্প মাধ্যম তাদের পক্ষপাতকে লুকানোর চেষ্টা করে না। তাদের লক্ষ্য হলো সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ভেঙ্গে ফেলা। অর্থাৎ সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাওয়া।

সিয়াটলের ঘটনা যদি ইন্ডিমিডিয়ার জন্ম দেয়, নাইন ইলেভেনের ঘটনা ব্লগকে জনপ্রিয় করে তোলে। ব্লগ শব্দটি এসেছে ‘ওয়েবলগ’ থেকে, যাকে ভাঙলে দাঁড়ায় ‘ওয়েব’(সাইট)-এর ‘লগ’। এক্ষেত্রে ‘লগ’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে ‘দৈনন্দিন কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করার রেকর্ড বই’ ধারণা থেকে, যা আবার এর মূলগত অর্থ ‘সমুদ্রযাত্রার সময় জাহাজের দৈনন্দিন ক্রিয়া-কলাপের রেকর্ড’ থেকে এসেছে। ‘ওয়েবলগ’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন জর্ন বার্জার, ১৯৯৭ সালে, তার অনলাইন জার্নাল ‘রোবোট উইজডম’-এ (Gurak and others, 2004)। ব্লগ হলো ব্যক্তি-পরিচালিত ওয়েবসাইট, যেখানে সাধারণত মতামত, ঘটনার বর্ণনা কিংবা স্থির বা সচল চিত্রের নানা ভুক্তি থাকে। অর্থাৎ এটি এক ব্যক্তির সাইট যেখানে তিনি ইচ্ছামতো তার মতামত, দর্শন, বিভিন্ন চলমান বিষয় সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ স্বাধীনভাবে পরিবেশন করেন। টেক্সট ছাড়াও তিনি চিত্র বা ভিডিও সরাসরি বা হাইপারলিঙ্ক আকারে পরিবেশন করতে পারেন। ভুক্তিসমূহ সাধারণত বিপরীত ক্রমে সাজানো থাকে। ব্লগের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এতে পাঠকদের মতামত প্রদান, তর্ক-বিতর্ক করার সুযোগ থাকে এবং এভাবে এটি একটি মিথস্ক্রিয়ামূলক পাতা হিসেবে গড়ে ওঠে। একেকটি টেক্সট বা অন্য যেকোনো প্রকারের ভুক্তিকে ‘পোস্ট’ বলা হয়ে থাকে। তবে টেক্সটনির্ভর ছাড়াও কেবলই স্থিরচিত্রের (ফটোব্লগ), সচলচিত্রের (ভিডিওব্লগ বা ভ­গ), অডিওর (পডকাস্টিং) ব্লগ থাকতে পারে।

ব্লগ সার্চ ইঞ্জিন টেকনোরাতি ২০০৮ সালের ব্লগ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাচ্ছে যে, ২০০২ সালের পর থেকে তারা এ পর্যন্ত ১৩ কোটি ৩০ লক্ষ ব্লগের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। আর সাইবার পরিসরে প্রতি ঘণ্টায় ৯ লাখ ব্লগ পোস্ট করা হয়ে থাকে। ব্লগারদের দুই-তৃতীয়াংশই পুরুষ আর শতকরা ৫০ ভাগ ব্লগার ১৮-৩৪ বছর বয়সসীমার। তো এটা হলো আরেকটি বিরাট ক্ষেত্র যেখানে বিকল্প মাধ্যমের চরিত্র নিয়ে লক্ষ লক্ষ ব্লগসাইট কাজ করে চলেছে। ব্লগের মিথস্ক্রিয়ার চরিত্রটি একে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নাইন ইলেভেনের ঘটনা বহু ব্লগের জন্ম দিয়েছিল, ইরাক যুদ্ধের সময় ব্লগের সংখ্যা হাজার হাজার ব্লগসাইট আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ সারা পৃথিবীর মানুষ বড়ো বড়ো আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক ঘটনায় স্বাধীনভাবে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চায় এবং সেই বিষয়ে মিথস্ক্রিয়া করে। প্রাতিষ্ঠানিক মূলধারার মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের এই এ্যাক্সেস বা অভিগম্যতা ছিলনা এতদিন। সাইবারপরিসরের বিকল্পমাধ্যমগুলো মিডিয়ার গণতন্ত্রায়নের অনন্য নজির হিসেবে আজ হাজির।

ইন্টারনেটে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুক চালু হয় ২০০৪ সালে। মাত্র ছয় বছরে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি। এখন এটা হয়ে গেছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ‘দেশ’। এর ২৮% ব্যবহারকারীর বয়স ৩৪ বছরের বেশি (Fletcher, 2010)। বাংলাদেশে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় লাখ। নগরায়ণের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের ‘কমিউনিটি গড়ার ক্ষুধা’ (রেইনগোল্ড, ১৯৯৯; দেলান্তি উদ্ধৃত, ২০০৩) মেটাতে সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকের আবির্ভাব ঘটেছিল। পরে আবির্ভাব ঘটেছে টুইটারের। লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাইবারপরিসরে আন্তসম্পর্কিত রাখার জন্য অনেক ফিচার যুক্ত হয়েছে ফেসবুকে। এরমধ্যে কয়েকটির মাধ্যমে মানুষ নিজের মতপ্রকাশ করছে স্বাধীনভাবে, কথা বলছে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য। এভাবে ফেসবুক, টুইটার বা মাইস্পেসও হয়ে উঠছে বিকল্প মাধ্যমে।

সাইবাপরিসরের বিকল্প মাধ্যমগুলোর শক্তির দিক হলো এগুলো মিথস্ক্রিয়ানির্ভর, ফলে যেকোনো ইস্যুতে একপাক্ষিক না হয়ে একটা ডিসকার্সিভ আলোচনা হবার সুযোগ থাকে। আর মূলধারার মুদ্রণ বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের তুলনায় এগুলো পরিচালনা করার খরচ খুব বেশি নয়। এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের শ্রমজীবীদের পরিচালিত র‌্যাডিকাল প্রেসের কথা আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে, মুদ্রণপ্রযুক্তি সস্তা ছিল বলেই যেগুলো একসময় টিকে ছিল। কিন্তু এর সীমাবদ্ধতার দিক হলো, এগুলোর অভিগম্যতার জন্য দরকার কম্পিউটার ও ইন্টারনেট কানেকশন ফি, সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যা এখনও সর্বসাধারণ মানুষের আয়ত্বের বাইরে। এরপরও কেউ কেউ মনে করেন, সাইবার ক্যাফে, স্কুল, লাইব্রেরি এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে সেই সীমাবদ্ধতা খানিকটা দূর হয়ে যায়। মিজি ওয়ালজের মতে, শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস বা ব্রডকাস্ট মাধ্যম বিবিসির চাইতে বেশি মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত (Waltz, 2005)।

বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিকভাবে জীবনধারণ করতে গিয়েই নাজেহাল হতে হয়, নানা চোরাপথে এ্যাক্টিভিজমের চেতনা তাই বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইন্ডিমিডিয়ার মতো সংবাদনির্ভর বা জিনেটের মতো বিশ্লেষণনির্ভর সাইট তাই এদেশে নেই। শেষ ভরসা তাই ব্লগ ও ফেসবুক। বাঙালিদের রয়েছে কয়েকটি ব্লগ কমিউনিটি যাদের সদস্যসংখ্যা কয়েক লাখ। ফেসবুকের নোট চালাচালির মাধ্যমেও বাংলাদেশের তরুণ বুদ্ধিজীবীরা বিকল্প ভাবনাগুলো শেয়ার করে চলেছেন। কর্পোরেট মালিকানার মূলধারার মিডিয়ার বিপরীতে ভিন্ন ধারণা নিয়ে বিকল্প মাধ্যমে মতপ্রকাশ এখানেও ঘটে চলেছে। এখন প্রয়োজন সামাজিক পরিবর্তনের জন্য, এইসব সাইটের শক্তিমত্তার সর্বোত্তম ব্যবহার করা।

তথ্যসূত্র
হারম্যান, এডওয়ার্ড এস ও চমস্কি, নোম (২০০২)। সম্মতি উৎপাদন: গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি (মামুন, আ-আল অনূদিত)। ঢাকা: সংহতি।
Delanti, Gerard (2003). Community. London: Routledge.
Waltz, Mitzi (2005). Alternative and Activist Media. Edinburgh: Edinburgh University Press.
Fletcher, Dan (2010). Facebook: Friends without Border, Time. Vol. 175, no. 21.
Beckerman, Gal (2003). Emerging Alternatives: Edging Away from Anarchy, CJR. September/October 2003.
Gurak and others (undated). Introduction: Weblog, Rhetoric, Community and Culture, Click This Link.
Albert, Michael (1997). Click This Link. aceesed on 26 September, 2010.
Click This Link

প্রথম প্রকাশ: খালেদ মুহিউদ্দিন সম্পাদিত 'মিডিয়াওয়াচ', সংখ্যা ৪২, অক্টোবর, ২০১০।

ব্লগারদের অবগতির জন্য

জিনেট: http://www.zcommunications.org/znet
ইন্ডিমিডিয়া: http://www.indymedia.org/en/index.shtml
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৯
৬৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×