somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তর... (রিপোস্ট)

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একাত্তর সালের মে মাস। হবিগঞ্জ জেলার সীমান্ত ঘেষা গ্রাম নবিগঞ্জ এর প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প করেছে মিলিটারিরা। ক্যাম্প করার পর থেকেই সেখানে ঘন ঘন যাওয়া আসা এলাকার মুরব্বি মোতাহার মোল্লার। বেলা ডুবে যাওয়ার পর ইদানিং কালে কাজে বের হতে হয় মোতাহার সাহেবের, গন্তব্য মিলিটারি ক্যাম্প, ইতিমধ্যে তিনি বেশ সুনজর অর্জন করেছেন মেজর সাহেবের। আজকাল তাই আবার তার সাথে সঙ্গী হয় মসজিদের মৌলবী আনসার আলী আর স্কুলের ভাইস-প্রিন্সিপাল আব্দুর রাজ্জাক।

মোতাহার মোল্লার ৩ ছেলে। জামাল,কামাল আর ছোটজন বেলাল। জামাল যেন পুরো বাপজানের ফটোকপি! বেলাল শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। আর কামাল হল বাপের আদর্শের বিরুদ্ধগামী! তার বাবা যখন ঘড়ে বসে সর্বদা বঙ্গবন্ধুর গুষ্টি উদ্ধার করতেন বয়সে তরুন কামাল প্রতিবারই তার বিরোধিতা করে এসেছে। তাই কয়দিন ধরে বাপ তার প্রতি সুনজর দেয় না। তাদের মা ও তার বাপের দেয়া মগজ ধোলাই এ বিশ্বাস করে সর্বয়া আওরাচ্ছেন যে মুসলমান মুসলমান ভাই-ভাই, এই যুদ্ধ হিন্দুদের ষড়যন্ত্র।

সময় যত বাড়তে থাকে মিলিটারিরা ততই অত্যাচার বাড়াতে থাকে স্থানীয়দের উপর। আর এর সুযোগ নিতে থাকেন মোতাহার মোল্লা আর তার সহযোগীরা, মানুষের বাড়িঘড় লুট করে নিজের সম্পদ বাড়াতে ব্যস্ত তারা। মিলিটারিদের নিজেদের লোক হবার সুবাদে কামালদের কেউ কিছু বলতো না, তারা ছিল গ্রামের মধ্যে তখন সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবার। কিন্তু বয়সে তরুন কামাল দেশের চিন্তায় ব্যকুল। সে তার সহযোগীদের সাথে কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবাই তাকে এড়িয়ে যায়। তারা এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের জান বাচাতে রাজাকার কমিটি তে যোগদান করাই শ্রেয় মনে করে। কিন্তু কামাল অবশেষে তার মনের লোক পেয়ে যায় দুইজনকে। তার বয়সে দুই বছর ছোট রমজান আর তার সহপাঠী নাঈম ও দেশের চিন্তায় সমব্যথী।
জুনের শেষের দিকে এক রাতে এই তিনজন বাড়ি ছেড়ে যায়। গন্তব্য হবিগঞ্জ জেলা শহরে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয়া। নাঈম এর বাবা কয়দিন আগেই ভারত থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে দেশে এসে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য তার কাছেই পৌছান।
তারা সেখানে যখন পৌছায় তখন রাতদুপুর, নাঈমের বাবা তার ছেলেকে দেখে আশ্চর্য হয়ে পড়েন। সৃষ্টি হয় আবেগঘন মূহুর্তের। কিন্তু খানিক বাদেই যখন তিনি জানতে পারেন তার ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়, তখনই নাঈমের বাবার মুখটা শক্ত হয়ে আসে!
"তোমরা বয়সে অনেক ছোট। তোমাদের জন্য এই কাজ নয়"
নাঈম জবাব দেয়, "এই দেশ যেমন তোমার, তেমন আমারও!"
তার বাবা কিছুটা কঠিন হয়ে বলে, "মুখে মুখে তর্ক করো না"
নাঈম বলে, "দেশের প্রতি তোমার যেমন দায়িত্ব, আমারো তেমন দায়িত্ব আছে। এটা বলা যদি অন্যায় হয় তাহলে সেই অন্যায় করতে আমি সদা প্রস্তুত। তুমি আমাদের দলে না নিলে আমরা অন্য কোথাও পালিয়ে যাবো।"

নাঈমের এই গোয়ার্তুমির কাছে তার পিতা হাড়তে বাধ্য হয়। ছেলেকে বুকে টেনে নেন এবং বলেন যে তাদের যুদ্ধে নিতে তিনি প্রস্তুত। পরবর্তি কয়েক দিন তারা প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষন নেয়। এরপর তাদের দিনকাল চলতে থাকে অলস বসে থেকে। এর মাঝে একজন মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাকে পটিয়ে তারা গ্রেনেড চালানো শিখে নেয়। যদিও নাঈমের বাবার কড়া নির্দেশ ছিল তাদের যেন কোন ভাবেই গ্রেনেড চালানো না শিখানো হয়।

আগস্ট মাসের শেষের দিকে হঠাত তাদের ক্যাম্পে মিলিটারী আক্রমন হয়। তাদের ক্যাম্পটি পুরো জংগলের মধ্যে, এখানে কেউ সন্ধান পাওয়ার কথা না তাদের। কিন্তু কিভাবে তা পেল তা কেউ ভেবে পায়না। কিন্তু এর মধ্যেই তাদের যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। ৩জন মুক্তিসেনা সেখানেই শহীদ হন। যাতে করে তাদের লোকবল কিছুটা কমে আসে। আবার সামনেই তাদের নবিগঞ্জ আক্রমন করার কথা। এভাবেই সেপ্টেম্বর মাস চলে আসে। তাদের সেপ্টেম্বর এর তৃতীয় সপ্তাহে নবিগঞ্জ আক্রমন করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর মাঝে আর তাদের দলে নতুন কোন সৈন্য এসে যোগ দেয়নি। তাই অগত্যা বাধ্য হয়ে ক্যাপ্টেনের নির্দেশে নাঈম, কামাল আর রমজান কে সাথে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নাঈমের বাবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ছেলেকে সাথে নিতে বাধ্য হয়।

নবিগঞ্জ স্কুলটির পাশেই নদী। সিদ্ধান্ত হয় নৌকায় করে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্যাম্প আক্রমন করা হবে। তখনি মিলিটারিরা পালটা হামলা করলে তিনদিক থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তারা মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে যেতে থাকবে। নাঈমের বাবা দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। তাই তাকে নদী পথের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর এটা যেহেতু নিরাপদ ও বটে, তাই তিনি তার ছেলে কে কাছ ছাড়া করতে রাজি হলেন না।
সময় হলে নাঈমের বাবা নাঈম, কামাল এবং রমজান কে সহ মোট ৭জন রওনা হন নদীপথে। তার বাকি সঙ্গীরা আগে থেকেই তাদের অবস্থানে অবস্থান নিয়েছেন। নাঈমের বাবা রা জায়গামত পৌছে অপেক্ষা করতে থাকেন ক্যাপ্টেনের নির্দেশের। আচমকা তিনি গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। এবং মূহর্তেই পাক-বাহিনী সদল বলে আক্রমন শুরু করে। আসলে স্থলের মুক্তিযোদ্ধাদের ভূলের কারনে মিলিটারি কোন একভাবে টের পেয়ে যায় তাদের আশেপাশে মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব।
এদিকে আচমকা গোলাগুলিতে হতবিহবল নাঈমের বাবা! স্কুলের ছাদে ছিল বেশ কয়েকজন মিলিটারি, সেখান থেকে ঝাকে ঝাকে গুলি আসতে থাকে নাঈম দের নৌকার দিকে। নাঈমের বাবা ও বাকি সঙ্গীরাও পালটা গুলি চালাতে থাকেন।
এভাবে অনেক সময় অতিবাহিত হয়, অন্ধকারে নৌকা আর মিলিটারীদের মধ্যে কি পরিমান হতাহত বা গুলি বিনিময় হয় তা কল্পনার অতিত। মিলিটারিরা ভাবেও নি নদী পথে কেউ আসতে পারে, কিন্তু গুলি ছোড়ার পর পালটা গুলির কারনে তার এলোপাতারি গুলি করতে থাকে। ওদিকে স্থলের যুদ্ধ ও চলতে থাকে বেশ ভালভাবে।
আচমকা একটি বুলেট এসে লাগে নাঈমের বাবার বুকে। তিনি লুটিয়ে পড়েন, তখনই তিন যুবকের হুশ হয় তাদের সঙ্গীদের মধ্যে কেউ আর অক্ষত নেই! কামাল দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়! প্রশিক্ষন প্রয়োগের সময় এটাই। আর এভাবে চলতে থাকলে তাদের বেচে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন। তাদের যে প্ল্যান ছিল সেইমত আক্রমন হয়নি, তাই তাদের রসদ ও ফুরিয়ে যাবে একসময়। কিন্তু মিলিটারিদের রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার কথা নয়।

গ্রেনেড টি হাতে তুলে নেয় কামাল! এক মূহুর্ত চিন্তা করে। তার বাবা এখন মিলিটারি ক্যাম্পেই আছে, এসময়টায় তিনি প্রতিদিন-ই এখানে সময় কাটান মেজরের পা চাটার মাধ্যমে! তখনি কামালের চোখে ভেসে উঠলো, বিধবার শাড়িতে তার মায়ের কান্নাভেজা চোখ। আরো অনেক কিছু ভেসে উঠতে লাগলো চোখে......
কামাল সব চিন্তা এক নিমিষে মন থেকে দূর করে গ্রেনেডের পিন ছুড়ে মারে স্কুল ঘড়ের উদ্দেশ্যে। মূহুর্তেই উড়ে যায় স্কুল ভবন। সে জানে, সে এখন এতিম, তার মা বিধবা, সে তার বাপের হত্যাকারী...কিন্তু তাতে কি? তার বিনিময়ে রক্ষা পেল তার মাতৃভূমি।
এরকম লক্ষ কামালের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা।

সবাইকে বিজয় দিবসের অগ্রিম শুভেচ্ছা :)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×