আজকের পৃথিবীর প্রধানতম স্বপ্নটি কী? অনেকেই অনেক কথা বলব। বলব দারিদ্র্যমুক্তি, ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানো, যুদ্ধের অবসান প্রভৃতি। এগুলো মানবজাতির বিরাট স্বপ্ন। কিন্তু দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে, দারা-পুত্র-পরিবার এবং স্ত্রী-কন্যাদি নিয়ে জানাচ্ছে সেই আদিম প্রয়োজনের কথা, যার নাম 'খাদ্য'। হ্যাঁ, অফুরান খাবারই আজকের পৃথিবীর প্রধান স্বপ্ন; এবং আমাদের বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষও এই বাসনাই দিনরাত জপ করে। আজকের পৃথিবীর প্রধানতম সাফল্যও এই যে সেই স্বপ্নপূরণের সামর্থ্য মানবজাতি অর্জন করেছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ফাও) এলান করেছে: ২০০৭ সালে বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ শস্য ফলেছে, বর্তমান চাহিদার দেড় গুণ বেশি। বাস্তবে ২০ বছর ধরে খাদ্য উৎপাদন টানা দুই শতাংশ হারে বাড়ছে। বাংলাদেশও এ সাফল্য থেকে পিছিয়ে নেই। ড. সাদত হুসাইন লিখেছেন, স্বাধীনতার সময় যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশে খাদ্য উৎপাদিত হতো এক কোটি টন, সেখানে এখন ১৪ কোটি মানুষের দেশে খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে তিন কোটি টন (খোলা কলম, প্রথম আলো, ৬ জুন)। অর্থাত জনসংখ্যা দ্বিগুণ বাড়লেও খাদ্য উতপাদন বেড়েছে তিন গুণ। তার মানে, চাহিদার চেয়ে খাদ্যের জোগান বেশিই তো হওয়ার কথা। এর চেয়ে বড় সুসংবাদ ‘ভুখা বাঙালি’র জন্য আর কী হতে পারে!
এতে ম্যালথাসের তত্ত্ব আবারও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বৈশ্বিক খাদ্য উতপাদন একটানা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পেরিয়ে যাচ্ছে। এই ২০০৭ সালেই বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল খাদ্যের দুই শতাংশ ফলনবৃদ্ধির তুলনায় কিঞ্চিত কম: ১ দশমিক ১৪ শতাংশ।
এখান থেকেই জন্মায় দ্বিতীয় প্রশ্নটি: তাহলে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা ফাওই কেন বলছে, বিশ্বের ৮৫ কোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার? কেন খাদ্যের অভাব, এমনকি বাজারের তাপে মায়ের পেটের মধ্যে শিশুও জন্মাতে ভয় পাচ্ছে? এর একটা উত্তর হলো, ক্ষুধার্তকেই গালি দেওয়া যে তুমি ক্ষুধার্ত কেন, চারদিকে এত খাবার! কিংবা উত্তরটি এই যে খাদ্য আছে দোকানে, গুদামে, খাদ্যবেচা কোম্পানির কবজায়; কিন্তু মানুষের তা কেনার সামর্থ্য নেই। অর্থাত কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। আকাশে রোজ চাঁদ দেখি বলেই কি আর চাঁদ সহজলভ্য নাকি!
সাধারণ মানুষ দরকারমতো খাদ্য কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। শুক্রবারের প্রথম আলোর শিরোনাম হয়েছে গবেষণা সংস্থা সিপিডির একটি জরিপ। তা বলছে, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত ১৫ মাসে গরিব মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। ওদিকে একজন পোশাকশ্রমিকের ন্যূনতম আয় সাব্যস্ত হয়েছে কমপে এক হাজার ৬৬২ টাকা পাঁচ পয়সা। আয় কমার ফলে, ওই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সেটা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫২ টাকা। এই টাকায় তাকে পরিবার নিয়ে বাঁচতে হয়! ভাগ্যিস, তারা জাদু জানে! তা না হলে কীভাবে তা সম্ভব!
এবং এ অবস্থায়ও খাদ্যপণ্যের, বিশেষত চালের দাম কমেনি। এত দিন বলা হচ্ছিল, উতপাদন কম হওয়া এবং জৈব জ্বালানি তৈরিতে শস্য চলে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। এটা বাজারের যুক্তি। এ যুক্তির সারমর্ম হচ্ছে, জোগানের চেয়ে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে এবং চাহিদার চেয়ে জোগান বাড়লে দাম কমবে। কিন্তু যখন জোগানও বেশি, দামও বেশি, তার ব্যাখ্যা কী? এও বলা দরকার যে আন্তর্জাতিক চালের বাজারে বিকিকিনি হয় বিশ্বের মোট চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ। তাহলে এই ১০ শতাংশের সরবরাহে গড়বড় হলেই চালের আস্ত বাজারটিই বেসামাল হয়ে পড়বে কেন? মুক্তবাজারের নীতির মধ্যে এমনটা ঘটে কোন জাদুবলে? জিজ্ঞাসি জনে জনে; মেলে না উত্তর।
সুতরাং খাদ্যসংকট নিছক চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য টলে যাওয়ার জন্য হচ্ছে না; হচ্ছে গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে। বিশ্বের ৮৫ কোটি অপুষ্ট মানুষের আয়ু কমে যাওয়া এবং ুধায় দৈনিক ১৮ হাজার শিশুর মরে যাওয়া যদি রাজনৈতিক সমস্যা না হয়, তাহলে রাজনীতির কাজ কী, তা নিয়ে ভাবতে বসতে হবে। আর ভাবলে আন্তর্জাতিক মজুদদারি, ফটকাবাজি, অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির বিশ্বের খাদ্য ও কৃষিবাণিজ্যে একচেটিয়া প্রাধান্য কায়েম হওয়ার দিকে চোখ পড়বে। বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানি কারগিল ও মাসেকাকে দায়ী করা হচ্ছে খাদ্যসংকটের জন্য। এমনকি এমন অভিযোগও জোরের সঙ্গে উঠছে যে তেলের দামের ৬০ শতাংশই বেড়েছে কয়েকটি অর্থকরী সংস্থার অসাধু কার্যকলাপের জন্য। তেলের চাহিদা বাড়ার যে গল্পটি শোনানো হয়, তা খারিজ করে দিয়ে জে পি মরগ্যান ফান্ডের ডেভিড কেলি ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘আমার কাছে একটা জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে যে বিশ্বে তেলের ব্যবহার ও চাহিদা তত জোরালোভাবে বাড়েনি।’ অতএব খাদ্য দেখলাম, তেল চাখলাম। কাজেই, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। বাজারে ঢুকে পড়েছে কিছু অদৃশ্য হাত। আর তাদের হাতে বন্দী আমাদের খাওয়া (খাদ্য) ও চলার (তেল) রসদ।
তৃতীয় প্রশ্নটি তখনই সামনে চলে আসে: বৈশ্বিক কৃষিবাণিজ্যের নিয়ন্তা কোম্পানিগুলো কেন বৈশ্বিক ক্ষুধা মেটাতে ব্যর্থ? উত্তরটি সরল: ওটা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা গড়ে উঠেছে মুনাফার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে, একদা যেখানে কম হলেও দেশের সব রকম খাদ্যের চাহিদা তথা চাল থেকে আনাজ, তেল থেকে লবণ পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হতো এবং এখনো প্রধান খাদ্য চালের ৯০-৯৫ শতাংশ স্থানীয় কৃষকেরাই উতপাদন করে থাকে, তাদের এত ভয়ের কী আছে? তবু ভয়ের আলামত মিলছে। দুই দশক ধরে কাঠামোগত সংস্কার, দেশের বাজারকে বিদেশি পণ্যের জন্য অবাধ করে দেওয়া এবং কৃষিতে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ক্রমশ তুলে নেওয়ার মাধ্যমে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশও মেক্সিকো, আফ্রিকার দেশ মালাবি কিংবা ফিলিপাইনের মতো খাদ্য-আমদানির দেশে পরিণত হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ তিনটি দেশই দুই দশক আগে খাদ্যে সচ্ছল ছিল। স্বৈরশাসক মার্কোসের অপশাসনের ভেতরও ফিলিপাইন তো বিরাট খাদ্যমজুদও গড়ে তুলেছিল। এখন মেক্সিকোর খাদ্যচাহিদা ও খাদ্যের দামের ওঠানামা পরিপূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ফিলিপাইন ও মালাবিকেও বিদেশ থেকে চড়া দামে খাদ্য কিনে খেতে হয়।
এসবই আশির দশক থেকে চালু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের ফল। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সরাসরি হস্তেক্ষেপে কৃষিতে রাষ্ট্রের অনুদান ও সহায়তা তুলে নিতে বাধ্য করা হয়। স্থানীয় প্রয়োজন মেটানোর বদলে কৃষিকে করা হয় রপ্তানিমুখী। কৃষি থেকে তহবিল সরিয়ে সেই টাকা ঢালা হয় বিদেশি ঋণের সুদ মেটাতে। (উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে প্রধানত রপ্তানীমুখী করা হয় মূলত এ কারণেই, আমাদের দেশে যেমন ধানী জমিগুলোতে জোর করে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ কিংবা পাহাড়ের জমিতে রাবার বাগান করা ইত্যাদি এরই ধারাবাহিকতা) বিলোপ করা হয় বাজার নিয়ন্ত্রণকারী আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলো। এই ধারা বাংলাদেশেও চলেছে। এসবের পর খোলাবাজার দিয়ে বাইরে থেকে ঢুকে পড়ে বিপুল ভর্তুকিপ্রাপ্ত বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য। স্থানীয় কৃষকেরা প্রতিযোগিতায় মার খেয়ে আবাদ থেকে উচ্ছেদ হয়। মার্কিন গবেষণা সংস্থা কার্নেগি এনডৌমেন্টের এক প্রতিবেদন অনুসারে, কেবল নাফটা চুক্তির ফলেই মেক্সিকোর ১৩ লাখ কৃষক কর্মচ্যুত হয়। এরা ভিড় জমায় শহুরে বস্তির অমানবিক পরিবেশে। ভারতেও একই ঘটনা। সেখানে সরকারি অবহেলার শিকার হয়ে গত এক দশকে দেড় লাখ কৃষক আÍহত্যা করেছে। অথচ খাদ্যসংকটের মুখে গত বছরও ভারত খাদ্য রপ্তানি করেছে। বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য যে ডলার প্রয়োজন, তার জন্য এটা পয়লা তরিকা। দ্বিতীয় পন্থা হলো, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ কমিয়ে আনা। প্রভাবশালী দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার একটি প্রতিবেদন জানিয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষি খাতে সরকারি ব্যয় আগের অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। পরিণামে একসময়কার খাদ্য-উদ্বৃত্ত দেশগুলো পরিণত হলো খাদ্যঘাটতির দেশে। ফিলিপাইন সরকারের এক কর্মকর্তার ভাষ্যে, বৈশ্বিক বাণিজ্যিক কায়দাকানুনের মধ্যে পড়ে আমাদের ছোট উৎপাদকেরা একেবারে কোরবানি হয়ে গেছে। এর অন্য অর্থ, দেশটি তার খাদ্য-সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলল। খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের প্রয়োজন, কিন্তু খাদ্য-সার্বভৌমত্ব না এলে তা সম্ভব কি? কৃষক ও কষিকে শক্তিশালী না করে এটা অর্জনের আর আর কোনো উপায় নাই। Click This Link
আমরা জানি, শক্তির ক্ষয় হয় না; তা এক রূপ থেকে আরেক রূপে যায়। অর্থাৎ এর হাত থেকে ওর হাতে যায়। অনেক দেশ যদি খাদ্য-সার্বভৌমত্ব হারিয়ে থাকে, তবে তা কার হাতে গিয়ে জমা হলো? জমা হলো ওই বিশ্বায়িত শিল্পায়িত কৃষিবাণিজ্য কোম্পানিগুলোর হাতে। সার্বভৌমত্বের প্রতিশব্দ হলো পরমুখিতা। এভাবে তারা পরমুখী হলো। অন্যদিকে প্রকৃত খামারিরা দিন দিন নাজুক হলো, খাদ্যের জন্য তাদেরও করজোড়ে দাঁড়াতে হলো বাজারঠাকুরের সমীপে। একসময় সেটাও তারা পেরে উঠল না। দেখা গেল যে একই দেশের বিশ্বায়িত এলাকায় খাদ্য-ঝলমল সমৃদ্ধি, অন্যদিকে গরিবি এলাকায় হানা দিল ‘নীরব দুর্ভিক্ষ’। এ রকম একটি সময়েই কিনা কৃষি খাতে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো অভূতপূর্ব মুনাফা অর্জন করে!http://www.globalresearch.ca/index.php?context=listByAuthor&authorFirst=Ian&authorName=Angus
শস্যবাণিজ্যে: আর্চার ড্যানেয়লস মিডল্যান্ড মুনাফা করে ১.১৫ বিলিয়ন ডলার, এ অংক আগের বছরের ৫৫ শতাংশ বেশি। কারগিল মুনাফা করে ১.০৩ বিলিয়ন ডলার, আগের বছরের ৮৬ শতাংশ বেশি। বাঞ্জ করে ৮৬৭ মিলিয়ন ডলার, আগের বছরের ১৮৯ শতাংশ বেশি। বীজ ও কীটনাশক কোম্পানিগুলোর মধ্যে: মনসান্টো মুনাফা করে ২.২৩ বিলিয়ন ডলার, আগের বছরের ৫৪ শতাংশ। ডুপোঁ অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড নিউট্রিশন লাভ করে আগের বছরের ২১ শতাংশ বেশি। এ রকম হারে সারের ব্যবসা করে মোজাইক নামের কোম্পানি আগের বছরের ১২০০ শতাংশ বেশি মুনাফা বাড়াতে সম হয়। এ রকম ঘটনা রূপকথায়ই সম্ভব। কিন্তু এখন রূপকথাই বাস্তব, বাস্তব হলো এক অদ্ভুত রূপকথা।
সুতরাং এককথায় আজকের খাদ্যসংকট বর্তমান বাজারব্যবস্থার গভীর ত্র“টি এবং কিছু কোম্পানির লাগামছাড়া মুনাফার ফল। আর ঠিক যখন সংকটটা এল, তখন আমাদের কৃষক ও দরিদ্র ক্রেতারা দেখল, তাদের পাশে কেউই তেমন নেই। তিন দশকের অর্থনৈতিক সংস্কারে তারা দুর্বল ও রুগ্ণ। রাষ্ট্র বাজারে হস্তপে করবে না, বরং বিডিআরের মাধ্যমে নতুন ‘ন্যায্যমূল্যের’ দোকান খুলবে। কৃষক দেখল, ভালো ফলন হলেও উপযুক্ত দাম পাওয়ার ভাগ্য তাদের হবে না। মিল মালিকেরা সেখানে ভাগ বসাবে। আগের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও আর তার পাশে নেই। আর ক্রেতা দেখল, বাজারঠাকুরই এ যুগের সর্বেসর্বা মহেশ্বর। আজকের বিশ্ব রাজনীতির আধিপত্যশীল নিওলিবারেল ধারার কাজ হলো এই মহেশ্বরেরই সেবাইতগিরি করা। রাষ্ট্র এখন বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ইউনিট, সরকার হলো কর্পোরেট স্বার্থের ম্যানেজার, তা বাংলাদেশই হোক আর ব্রিটেন-আমেরিকাই হোক।
তাই আজ যখন খাদ্যে প্রাচুর্য, তখনো কি তার ধারে-কাছে পৌঁছতে না পেরে কেবল তার দিকে চাহনি মেলে ক্ষুধায় ঢলে পড়ার ভয়ে সিটকে থাকতে হবে? ভবিষ্যতের ভয় এখনও দুঃসহ স্মৃতির মতো মনে জাগবে কেন?
পরিশিষ্ট: বিরাট এক খাদ্যাভাব তথা দুর্ভিরে পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন বিশ্বের অনেক ওয়াকিবহাল মানুষ। আর আমাদের স্মরণে আসছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলে কুখ্যাত ১৭৬৯-৭০ সালের বাংলার দুর্ভিরে করাল ছায়া। সেই দুর্ভিক্ষে বাংলায় প্রতি তিনজনের একজন মারা গিয়েছিল, দুই হাজার বছর পুরনো সেকালে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী শহর মুর্শিদাবাদ পরিণত হয়েছিল পোড়ো প্রেতপুরীতে। সেই আকালের বছরও সর্বোচ্চ পরিমাণ খাজনা আদায় করা হয়েছিল। এর সাক্ষি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তবিরোধী ইংরেজ লাট জন শোরের বিবরণও মনে আসছে। দুর্ভিরে ৪০ বছর পরও তিনি ভুলতে পারেননি সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এরই তাড়নায় লিখিত একটি কবিতায় তিনি বলছেন,
‘কেউ আর নেই,
মৃতের সঙ্গে মৃতপ্রায় মানুষও
আজ তাদের শিকার!’
জীবিত মানুষ তখন মৃত মানুষের মাংস ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করেছিল। ওটা ভয়াবহতা কিন্তু কিছু স্বচ্ছল মানুষ যখন বাকি সবের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে শান-শওকত বাড়াতে থাকে, সেটা হয় উন্নয়ন। যাদের উন্নতি হচ্ছে উন্নয়নের স্লোগান তারাই বেশি দেয় আর মর্ত্যে বানায় শাদ্দাদের বেহেশত।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের চূড়ান্ত মুহূর্তের মাঠে মাঠে বিপুল ফসল ফলেছিল। লাখ লাখ ভুখা মানুষ ‘ফসল কাটার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে’। এই কাহিনীর বর্ণনাকারী উইলিয়াম হান্টার তাঁর বই পল্লী বাংলার ইতিহাসে লিখেছেন, ‘তাদের কাতর চোখের শেষ চাহনি সম্ভবত ঘন সন্নিবিষ্ট সবুজ ফসলে ঢাকা ক্ষেতর ওপরই নিবদ্ধ ছিল।’ আজ যখন খাদ্যে প্রাচুর্য, তখনো কি সেই প্রাচুর্যের দিকে চাহনি মেলেই ক্ষুধায় ঢলে পড়ার ভয়ে সিটকে থাকতে হবে? ভবিষ্যতের ভয় এখনই দুঃসহ স্মৃতির মতো মনে জাগছে কেন?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




