যার দিলে মোহর মারা, তারে বোঝাবে কে? ফলে তর্ক হয়ে যায় জাহির করার আষ্ফালন, আলোচনা হয়ে যায় দম্ভ প্রকাশ, বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়ায় অন্ধকারে হারানো সূচঁ আলোর তলে খোঁজার সামিল। তারপরও দেখা যাক না, সবুরে মেওয়া ফলে কী না।
একজন ব্লগার রিফাত হাসান তাঁর ভাস্কর্য ভাংনেওয়ালাদের সমর্থনে লেখা পোস্টে আমার সমালোচনার জবাবে আমাকে বর্ণবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল বলেছেন। বলাটা দোষের কিছু না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তাঁর অবস্থানকেই আমার বরং প্রতিক্রিয়াশীল তো বটেই, বাড়তির মধ্যে ফ্যাসিবাদী লক্ষণযুক্তও মনে হয়। কীভাবে সেটাই ব্যাখ্যা করি বরং। তার আগে কিঞ্চিত পটভূমি বর্ণনা আবশ্যক।
কথা হচ্ছিল ভাস্কর্য ভাঙ্গা বা অপসারণের দাবিদারদের কাজের রাজনৈতিক মাজেজা নিয়ে। সে আলোচনা অনেক হয়েছে এখানে। আপাতত এই ইসলামী শক্তির রাজনৈতিক অবস্থানটিকে দাগিয়ে নেয়া দরকার। তা থেকে যারা এর বুদ্ধিবৃত্তিক ওকালতি করছেন, তাঁদের রাজনীতিটাও ধরতে সুবিধা হবে।
এই শক্তিকে তিনটা ধারায় ফেলে চেনা যায়। এক: শহর-মফস্বলের উঠতি মধ্যবিত্ত-ব্যবসায়ি-পেশাজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা, দুই: প্রধানত গ্রামীণ দরিদ্র, শহুরে নিুবিত্ত এবং হতদরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্ররা। প্রথম অংশভুক্তদের প্রধানতম প্রতিনিধি হলো জামায়াত। এরা পুঁজিবাদের মধ্যে অনেকটা আত্মীকৃত, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভাষায় মডারেট ও ডেমোক্র্যাটিক। দ্বিতীয় ধারাটির মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে পুঁজিবাদবিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সামন্তীয় বৈশিষ্ঠ্যের জন্য শেষ পর্যন্ত বর্তমান মুনাফাখোরি ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য পেশ করেই তারা রাজনীতির মাঠে খেলতে নামে। এই দুই অংশের মধ্যে মিল এক জায়গায় যে, তারা উভয়ই রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণীর মদদের জোরেই রাজনীতিতে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। এদের কোনো স্বাধীন ভূমিকা অদ্যাবধি জাহির হয় নাই। কখনো কখনো এদের প্রেসার গ্র“প হিসেবে দেখা গেলেও, সেটা যে শেষ বিচারে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানকেই পোক্ত করার জন্য, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন পড়ে না। তবে এদের সাফল্য এখানেই, তারা বিরাটসংখ্যক মাদ্রাসা ছাত্রদের রাজনৈতিকভাবে জমায়েত করতে পেরেছে। যদিও, সেই জমায়েত এখনও স্বশ্রেণীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, ফলত নিঃসার। যে গরিবিপনার শিকার তারা, যে আধুনিকতাবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাদের হেয় করে রাখে, যে লুণ্ঠনতন্ত্র তাদের শেকড় যে কৃষক শ্রেণীর সঙ্গে সেই শ্রেণীকে চুষে ছিবড়া বানায়, তার বিরুদ্ধে এদের কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। বরং এরা বাঁধা থাকে তাদেরই নিয়োজিত ইসলামী ঠিকাদারদের হাতে। যারা কেবল সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত তা-ই নয়, এরা সেই শ্রেণীরই রাজনৈতিক স্বার্থের হাবিলদার। কিন্তু এরা জৈবিকভাবে যে শ্রেণীর অংশ, সেই কৃষক-মজুর-নিম্নবিত্ত শ্রেণী গুচ্ছের উত্থান ঘটার সম্ভাবনা এদের মধ্যে জায়মান। এদের সংগঠিত হবার শক্তি এবং প্রতিরোধী মানসিকতা ইসলামী প্রতীকের আবডাল নিয়ে সুপ্ত, সেই শ্রেণীকে রাজনৈতিক ভাবে জাগতে হলে ঐসব ধর্মব্যবসায়ীদের খপ্পর ছিঁড়ে বেরতে হবে। এবং আমি মনে করি তা সম্ভব হলে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনমুক্তির সংগ্রামে বিরাট বেগ সঞ্চার ঘটতে পারে।
কিন্তু কোনোরকম রোমান্টিকতার বশে পড়ে এদের নের্তৃত্বের মার্কিন-ভারত সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধা চোহারা আড়ালে চলে গেলে তা আত্মঘাতী হতে বাধ্য। আমাদের শাসকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো কর্মসূচির বিরুদ্ধে এদের কখনো সোচ্চার হতে দেখা যায় না।
এদের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান এজেন্ডা হলো প্রধানত নারী ও শ্রমিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিরোধিতা করা। মাঝে মাঝে তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলে বটে, কিন্তু সেটার মধ্যে দিয়ে ইসলামের নামে চলা এক গুচ্ছ চরম প্রতিক্রিয়াশীল বিধানই তারা কায়েম করতে চায়। এর নাম তারা দেয় ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কিন্তু সেই ইসলামী আইন কখনো শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিকের শোষণ-লুণ্ঠন উচ্ছেদ, মার্কিন ঘেঁষা রাষ্ট্রীয় অবস্থান, জনগণের সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক বিকাশের পে লড়ে না, লড়ে কায়েমি স্বার্থের পক্ষে। পাকিস্তান আন্দোলনের নামে তা মুসলিম কৃষকদের জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধের লড়াইকে বিভ্রান্ত করে। স্বাধীনতার দাবি তাদের কাছে মনে হয় অনৈস্লামিক। একাত্তরের পর প্রতিটি প্রতিবিপ্লবী উত্থানে (সেনাতন্ত্রের বরাতে) তারা দোসরগিরি করেছে। আজ অবধি তসলিমা বিতাড়ন ছাড়া আর কোনো আন্দোলন পাওয়া যাবে না, যা তারা নিজেদের শক্তিতে গড়ে তুলেছে। এমন কোনো দাবি তারা উত্থাপন করে নাই, জনমুক্তির সংগ্রামে যার কোনো প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। বরং বাংলার জনগণের সবথেকে অগ্রসর রাজনৈতিক সংগ্রাম যে স্বাধীনতা যুদ্ধ, এরা এবং এদের পরে বুদ্ধিজীবী সৈনিকেরা তার রাজনৈতিক মর্মকে ধ্বংস করে একে কেবল ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে চায়।
এখানেই তাদের সঙ্গে ইরান, মিসর, আলজিরিয়া এবং লেবানন ও ফিলিস্তিনের ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের তফাত। এই আন্দোলনগুলি মোটা দাগে জাতীয়তাবাদী, পাশ্চাত্য আধিপত্যবিরোধী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। এদের দেখে কেউ যদি বাংলাদেশের ইসলামওয়ালাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কিংবা সংগ্রামী মনে করে থাকেন, তিনি কল্পনার খেয়ালে কলা খেতে পারেন, অসুবিধা নাই। কিন্তু সেই কলার ছোলায় কেউ কেউ পিছলায়, ভয় এই যা।
পরের পর্ব: বাংলাদেশের ইঙ্গ-মার্কিন এলিটদের পোদ্দারির মূলে
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৮:১২