তারপরো লক্ষণ শুভ, আঘাতে আঘাতে তারা জাগিয়ে তুলছে মানুষকে, প্রহারে প্রহারে খরচ করছে শক্তি। স্বৈরশাসনের পতনের শুরু এভাবেই হয়।
শাহবাগে, পল্টনে, মীরপুরে, মোহাম্মদপুরে, ঢাবিতে কেবল গ্রেফতার আর গ্রেফতার। ভোর সাতটায় জাদুঘরের সামনে থেকে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পিটিয়ে একজনের পা ভাঙ্গে পুলিশ, একজনের চোখে আঙ্গুল ঢুকানোর চেষ্টা করে, মেয়েদের প্রত্যেকেই হয় চড়-থাপড়ের শিকার। তুলনায় পল্টন এলাকায় ভোরের গ্রেফতারে নির্যাতন কম ছিল। সবার আগে গ্রেফতার হন আনু মুহাম্মদ। অবশ্য, গনঅসন্তোষের ভয়ে ঘন্টাখানেক পরেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধসাজে ছিল পুলিশ ও র্যাব, জলকামান, টিয়ার-কামান। এ পর্যন্ত গ্রেফতার শতাধিক।
ভোরেই শাহবাগ-আজিজ মার্কেট-চারুকলা এলাকায় চলে পুলিশের দাঙ্গাবাজি অ্যাকশন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গ্রেফতার হন কবি অভিজিত দাস। সাড়ে আটটার দিকে সিপিবির পাশের গলি থেকে নিশ্চিত গ্রেফতার জেনে স্লোগান দিতে দিতে আসেন বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা জোনায়েদ সাকি, আবু বকর রিপন, ছাত্র-যুব আন্দোলনের কামরুল ইসলাম সবুজ। দেখামাত্রই তাদের আটক করা হয়, ‘রক্ত দেব জীবন দেব, তেল-গ্যাস দেব না’ স্লোগান দিতে দিতে প্রিজন ভ্যানে ওঠেন তাঁরা। নেতাদের গ্রেফতার দেখে দূরে দাড়ানো দীপক রায় স্থির থাকতে পারেনি। ছুটে আসা মাত্রই তাকেও আটক করা হয়। এখন পল্টন থানার হাজতঘর ভরা বিপ্লবী নেতাকর্মী।
মিছিল নিয়ে এগতে গিয়ে গ্রেফতার হন শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশুসহ তার কয়েকজন সহযোদ্ধা। জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল্লাহর সঙ্গে হাইকোর্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের নেতা লেখক ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও কর্মী নাসরিন সিরাজ অ্যানি, কর্মী বিথী চৌধুরী। পুলিশ তুলে নিয়ে যায় তাদেরও।
১১টায় যখন ঢাবির রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ শেষ করে চলে যাচ্ছিল জাতীয় কমিটির ছাত্রকর্মীরা, ঠিক তখনই শতশত পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। টিসএসসির ভেতরে আশ্রয় নেওয়া ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করে। রমনা পার্কে পালিয়েও রেহাই পায়নি অনেকে। শাহবাগ থানার হাজত ভরে গেছে ঢাবির শিার্থীদের দিয়ে। খবর পাচ্ছি সামারি কোর্টে অনেকেরই কারাদণ্ড নিশ্চিত করা হয়েছে।
১১.৫০ এ বাসদের গলিতে চলছিল সমাবেশ। সেখানে পুলিশ হামলে পড়ে, ইচ্ছামতো লাঠিচার্জ করে, মেয়েদের রাস্তায় ফেলে পেটায়। আওয়ামী গণতন্ত্রের স্বাদ বিএনপি জামাতের গণতন্ত্রের মতো বড়ই মধুর। বিএনপি যা করেছিল ফুলবাড়ী-কানসাটে, আওয়ামী লীগ আজ তার করার মহড়া দিল রাজধানী শহরে।
কারা দেশদ্রোহী? যারা দেশ বিক্রি করে তারা, নাকি যারা দেশের সম্পদ বাঁচাতে জানবাজি লড়ে তারা? হরতাল করা যদি দেশদ্রোহ হয় তাহলে হাসিনা-খালেদা কতবার দেশদ্রোহ করেছেন? যে জুলুম আজ সরকারি বাহিনী করেছে, তা সেনাশাসনকেও হার মানাবে। স্পষ্টতই মার্কিন দূতাবাসের হুকুমে জাতীয় কমিটির কর্মীদের ওপর তারা নির্যাতন-গ্রেফতারের স্টিমরোলার চালিয়েছে। সরকারি দাপট দেখে প্রভুরা খুশি হবে, কিন্তু এই জুলুমবাজি তোমাদের ‘রাজাকার’ হিসেবে দেশবাসীর কাছে চিনিয়ে দিল। যে বিএনপি চুক্তির কপি দেখেনি বলে হরতাল সমর্থন করতে পারেনি, সেই বিএনপি-জামাত এখন মসনদলোভী হরতাল ডেকেছে ৪৮ ঘন্টার। স্পষ্টতই তাদের এই হরতাল ডাকা জাতীয় কমিটির আন্দোলন এবং সরকারি নির্যাতন-নিপীড়নকে কিছুটা আড়াল করতে সহায়ক হবে। তারা আগেও রাজাকার ছিল, এখন বাড়তি যোগ হয়েছে রাজনৈতিক লুম্পেন চরিত্র।
লুটপাটের সরকারের প্রতিহিংসাই আজ চিনিয়ে দিচ্ছে কারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, কারা জাতীয় সম্পদের পাহারাদার। যে অদৃষ্টপূর্ব ধড়পাকড় নির্যাতন চললো, তা ফ্যাসিবাদের সামিল। দেশবিক্রির ঠিকাদার আওয়ামী লীগ সরকার আজ প্রমাণ করলো, জাতীয় কমিটিই জাতির হয়ে কথা বলছে। মুখোশ খসে পড়ছে আর ভীত হয়ে পড়ছে তারা। জাতীয় কমিটির প্রতিপক্ষতা করে সরকার জাতীয় কমিটিকে জনগণের কমিটি হিসেবে এক ধাপে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেল। প্রচার আন্দোলন এভাবেই পরিণত হচ্ছে প্রতিরোধ আন্দোলনে। প্রশ্ন হচ্ছে, সহস্র সাহসীরা বুক পেতে যে নির্যাতন-গ্রেফতার-লাঞ্ছনা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের রুখে দিচ্ছেন, তখন আপনি/আপনারা কী করছেন?
লক্ষণ শুভ, আঘাতে আঘাতে তারা জাগিয়ে তুলছে মানুষকে, প্রহারে প্রহারে খরচ করছে শক্তি। স্বৈরশাসনের পতনের শুরু এভাবেই হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৪