ক। "অনেকের ধারণা টেকনোলজি এবং মেশিন যত উন্নত হবে, মানুষের কর্ম সংস্থান তত কমে যাবে। মানুষ উল্লেখযোগ্য হারে বেকার হয়ে যাবে।"
এটা কারো জন্য সত্য, কারো জন্য আধা বা সিকি সত্য এবং কারো জন্য মিথ্যা।
টেকনোলোজির ১। উদ্ভাবন ২। বিকাশ এবং ৩। ট্রান্সফর্মেশন তিন ধারাতে একটি দেশের কতটুকু পারদর্শিতা তার নির্ভর করে এই "সত্য" এর মাত্রা।
টেকনোলজির উদ্ভাবন ও বিকাশে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ম্রিয়মাণ। বাংলাদেশ শুধু টেকনোলজির বিপণন ও কিছু ক্ষেত্রে ট্রান্সফর্মেশনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তথাপি কৌশলগত খাত গুলোতে বাংলদেশের টেকনোলোজি ট্রানফার আন ডিফাইন্ড, ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কারিগরি খাতে বর্তমানে বিদেশী স্কিল্ড শ্রমিক আধিক্য বাড়ছে। সামনের দিনে এর সাথে আরো বেশি গতিতে যোগ হবে অটোমেশন ও রোবোটিক্স।
বাংলাদেশ তাঁর সুবিশাল মানব সম্পদকে নিত্য নতুন টেকনোলোজির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে, ট্রেইন আপ করতে ও টেকনোলোজি ট্রানফার সক্ষম করতে ব্যর্থ হচ্ছে। উচ্চ টেকনোলোজি বাস্তবায়িত হচ্ছে সেগুলো বিদেশীরা এসে করে দিয়ে যাচ্ছে এবং মেইন্টেইনও করছে রিমোটলি অথবা লোকালি। ফলে দেশে মানসম্পন্ন উচ্চ কারিগরি রিসোর্সের প্রতুলতা রয়েছে।
আমাদেকে অবশ্যই পর্যাপ্ত সংখ্যক হাই স্কিল্ড ফরেন রিসোর্স রাখতে হবে, তবে কিন্তু আছে। এটা এমনভাবে রাখতে হবে যাতে তারা টেকনোলজি ট্রান্সফারে বাধ্য হন অর্থাৎ ট্রেনিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট উইন্ডো ওয়েল ডিফাইন্ড করে দেশীয় রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের কৌশলগত উদ্যোগ জরুরী।
ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন ও ম্যান্যুফাকচারিং ফ্লোরে বিদেশি নাগরিকের আধিক্য আসলে একটি দেশের পশ্চাৎ পসারতারই স্বারক। এই ক্ষেত্রে বুঝে নিতে হবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্পন্ন ও পর্যাপ্ত কারিগরি রিসোর্স তৈরিতে অক্ষম।
খ। "আবার অনেকেই মনে করেন টেকনোলজি এবং মেশিন ভবিষ্যতে এত উন্নত হবে, মেশিনই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে।"
কম্পিউটিং, ম্যাশিন ল্যাঙ্গুয়েজ, প্রোগ্রামিং, কন্ট্রল সিস্টেমস টেকনোলজি ইত্যাদির বিপরীতে রোবোটিক্স এর টেকনোলজি ন্যাচারে এবং প্রয়োগে ভিন্ন। ১ম ধারা চিন্তা ও উদ্ভাবন করে, ২য় ধারা তার মেশিন লার্নিং ও ১ম ধারায় প্রয়োগ কৃত কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে কাজ করে।
আগে যে শ্রম ঘন কিংবা পুনঃ পুনঃ ধাপের কাজ বা প্রয়োগ মানুষ করতো তার রিপ্লেইস্মেন্ট রোবোট হয়ে গেলে কর্ম সংস্থানের সঙ্কোচন হওয়ায়ই স্বাভাবিক। তবে চিপ ফেব্রিকেশন, সিলিকম সিরামিক্স, মাউক্রো ও ন্যানো সিলিকম সিরামিকসে ও প্রসেসর শিল্পের মত বেশ কিছু সফস্টিকেটেড শিল্পে রোবটের বিকল্প নাই, এগুলা হাতে করা যায় না।
কম্পিউটিং, প্রোগ্রামিং, কন্ট্রল সিস্টেমস টেকনোলজি মেশিন ও অটোমেশনের ব্যাকগ্রাউন্ড নলেজ ফাউন্ডেশন, আর রোবোট হল এই কারিগরি উতকর্শগুলোর সমন্বয়ে তৈরি হিউম্যানোয়েড প্রোডাক্ট। একদিকে জ্ঞান ও ইনোভেশন ব্যবস্থাপনা, অন্যদিকে স্বল্প কারিগরি ও পুনঃ পুনঃ করা লাগে এইসব শ্রম ঘন কাজের জন্য তৈরি হিউম্যান রিসোর্সের বিল্পক বা রিপ্লেইস্মেন্ট।
ইন্ডিস্ট্রিয়ালাইজেশনের চরম রূপে স্কিলড ও সেমি স্কিল্ড কর্মজীবী শ্রমিকের ছুটি, ট্যাক্স, হিউম্যান ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স কস্ট ও কস্ট অফ লাইফ এডজাস্টমেন্ট এর যাবতীয় কষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে মাস প্রডাকশন রোবটে ঝুঁকছে। সুতরাং কাজের সঙ্কোচন তো হবে। হতে পারে আজ থেকে ২০ বছর পরে কার সেলফ ড্রাইভ হবে এটাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের ৫০ লক্ষ প্রাইভেট কারের বিপরীতে ৫০ লক্ষ ড্রাভাইরের চাহিদা থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক।
যারা অত্যাধুনিক টেকনোলজি "ন্যারো ব্যান্ড আইওটি", "এলটিই আইওটি" এবং "ফাইভ জি" নিয়ে কাজ করছি, যারা "রোবোটিক্স" এবং "আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স" নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের কাছে ব্যাপারটা যত ক্লিয়ার অন্যদের এই ধারণা দেয়া কিছুটা মুশকিলের বটে!
হিউম্যান ম্যানেজমেন্ট, লাইফ স্টাইলের পরিবর্তন, বাজার, ম্যানেজমেন্টের নতুন নতুন ধারা সৃষ্টি হচ্ছে, যার সবই হাই টেক। এই নতুন ডমেইন গুলোকে আমাদের মানব সম্পদ উন্নয়ন কৌশলে কিভাবে সমন্বিত করা যাবে, বিশ্ব বিদ্যালয় গুলো নতুন নতুন সাবজেক্ট কভার করবে, দ্রুত পুরানো সাব্জেক্টের কারিকুলাম এডাপ্ট করবে বাংলাদেশ তা নিয়ে ভাবনা বেশ বাড়াতে হবে।
নতুন টেকনোলজি নতুন কর্ম সংস্থান তৈরি করবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা অস্বাভাবিক কম হিউম্যান রিরোর্স নিয়ে কাজ করবে এটা সাধারণ বোধগম্যতায় আনা দরকার। সুতরাং এখানে এই বোধ তৈরি জরুরি যে কিভাবে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের এ আই, রোবোটিক্সের মত উন্নত টেকে সক্ষম করে তোলা যায়, যাতে অন্তত কিছু স্টেইক এই খাতে দেশ নিতে পারে।
সেই সাথে আরেকটি বোধ জরুরি, কেন ইন্ডাস্ট্রি রোবোটে ঝুকছে। ইন্ডিস্ট্রিয়ালাইজেশনের চরম রূপে স্কিলড ও সেমি স্কিল্ড কর্মজীবী শ্রমিকের ছুটি, ট্যাক্স, হিউম্যান ম্যানেজমেন্ট ও ওয়ার্ক মোটিভেশন, হিউম্যান রিসোর্স কস্ট ও কস্ট অফ লাইফ এডজাস্টমেন্ট এর যাবতীয় জঞ্জালকে ও সমূদয় কষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে মাস প্রডাকশন রোবটে ঝুঁকছে।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগ উপযোগী করা এবং ইন্ডাস্ট্রি ওরিয়েন্টেড করা, কর্ম সংস্থানের বাজার উপযোগী করা এবং ভবিষ্যৎ মূখী করে, কারিগরি সক্ষম করতে হবে। বাংলাদেশের আন স্কিল্ড ও সেমি স্কিল্ড শ্রমবাজার কে ট্রান্সফর্মেশনের রূপরেখা তৈরির বোধ জরুরি। "দেশের নেতৃত্বকে একটা তাগাদা নিতে হবে যেন তারা নতুন নতুন বিদেশী টেকনোলজির দেশীয় বাজার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি টেকনোলোজি ট্র্যান্সফার, বিকাশ এমনকি উদ্ভাবনে দেশের সক্ষমতা তৈরির দিকে মনোযোগ দেন"।
সুতরাং বিকল্প কর্ম সংস্থানের পথ নতুন নতুন টেকনোলজি আয়ত্ব করেই বের করে নিতে হবে। আনস্কিল্ড ও সেমি স্কিল্ড ম্যানপাওয়ার ট্রান্সফর্মেশনের রোডম্যাপ বানিয়ে ফেলতে হবে।
তবে মেশিন মানুষকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা বলা সময় সাপেক্ষ পর্যবেখখনের ব্যাপার। তবে রোবোট মানুষের ওয়ে অফ ওয়ার্ক বদলে দিবে সেটা অবধারিত।
গ। বাংলাদেশে অটোমেশন গুলো অসম্পূর্ণ
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অটমেশন বা কিংবা আরো উচ্চ স্তরের এআই এর ফুল ফেসিলিটি পাওয়ার লোয়েস্ট রিক্যোয়ারমেন্ট হিসাবে সেন্ট্রাল ডেটাবেজ গুলোকে এখনই সিনক্রোনাইজ শুরু করা উচিত। ডিজিটাল ডেটাবেজ বেশ কয়েকটা গড়ে উঠেছে স্ক্যাটার্ডভাবে; ইউটিলাইজ করা যাচ্ছে না ওয়েল কানেক্টেড না থাকায়।
আমি ৪টি ভিন্ন ভিন্ন যায়গায় (নির্বাচন কমিশন, মোবাইল অপারেটর, বি আর টি এ, পাস্পোর্ট অফিস) নিজেই বায়োমেট্রিক ডেটার আলাদা আলাদা ইনপুট নিতে দেখেছি। এ আই কিংবা অন্য সকল হিউম্যান ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পোষ্ট প্রসেসিং এর বাইরেও এই প্রতি মন্ত্রণালয় ও সেবা খাতের আলাদা আলাদা বায়োমেট্রিক নেয়া কেন্দ্রিক ব্যবস্থা অতি খরুচে (এই খাত দুর্নিতি ও লুটপাটের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে), এটা নাগরিকের শ্রম ঘন্টা নষ্ট করছে, নগরীতে যানজট বাড়াচ্ছে, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা বাড়াচ্ছে এবং সর্বোপরি ইনটেলিজেন্ট ম্যানেজমেন্টকে বাধ গ্রস্ত করছে।
আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক আমলারা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুবই রক্ষণশীল। তারা যেকোনো পরিবর্তনে ভয় পায়। তারা নতুন টেকনোলজিকে ভয় পায়; তারা নতুন কোন মেশিনকে ভয় পায়। যার ফলে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে নতুন টেকনোলজির আগমন ঠেকিয়ে রাখতে।
এর প্রধান কারণ কারিগরি অটোমেশন সঠিক ভাবে প্রয়োগ করলে তদবির ভিত্তিক প্রশাসনের দুর্বত্ত লুটপাটের কাজ গুলো ট্রান্সফর্ম হয়ে পড়বে, ফলে ঘুষ ও দুর্নিতির সুযোগ উঠে যাবে। তাই তারা এর পরোক্ষ প্রতিরোধ করে, সরাসরি বাঁধা দেয়, অথবা ডিজিটাল সিস্টেমের কথা বলে অটোমেশন প্রয়োগ করলেও ম্যানুয়াল ইন্টারভেনশন রেখে অসমাপ্ত বাস্তবায়ন করে যাতে ঘুষের যুযোগ ধরে রাখা যায়। চট্রগ্রাম বন্দর অটোমেশন, ট্যাক্স সিস্টেম অটোমেশন, ন্যাশনাল আইডি, পাসস্পোর্ট, ব্যাংকিং রেগুলেশন সহ প্রায় সকল খাতই অসম্পূর্ণ ও দুর্নিতি বান্ধব অটোমেশনে বন্ধী! একদিকে সব গুলো মন্ত্রণালয়ের অটোমেশন খাতের ( তথ্য প্রযুক্তি সহ) উচ্চ বরাদ্দ লুন্ঠিত হচ্ছে, অন্যদিকে অটোমেশন গুলো অসম্পূর্ণ ও ঘুষ ও তদবির বান্ধবই থেকে যাচ্ছে।
কৃতজ্ঞতাঃ
সোফিয়াই মারাইবেন নাকি টেক-মারানিও হবেন!!! ব্লগে
মোহাম্মদ আলী আকন্দ ভাই এর কমেন্ট পার্টিসিপেশন এর পরিপ্রেক্ষিতে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:১২