একা মানুষের ভাবনা
========================
==
নিশি রাত এখন অথচ বাঁশি কোথাও বাজে না । সেই ১১ টা থেকে দুম করে ঘুম উধাও হয়ে গেছে স্বপ্নে বাঁশি বাজানো শুনে । নাহ, আজকাল এত পাতলা ঘুমে নাজেহাল হওয়াটা বাজে অভ্যেসে পরিণত হয়েছে । ঘরের দরজাটা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বৈদুতিক পাখার বাতাসে হেলেদুলে নড়ছে, যেন আজরাইল এসে দরজায় কড়া নাড়ছে তার ।পানির বোতলের পানি একদম তলায়, তৃষ্ণা লাগলে হুট করেই যদি জান কবজে সুবিধা হয়, কেউ টেরই পাবেনা । কয়েক জোড়া জুতা স্যান্ডেল এলোমেলো হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে, যেন অলস দেহ । খানিকটা ধূলো জমা, খানিকটা নির্বাক । বহুদিন কালি করা হয়নি ওগুলো । আচ্ছা আমার মৃত্যুর পর ওগুলো কী করা হবে ? বস্তায় বন্দী কাঁথা – কম্বল ? কেউ আমার মত করে আদরে জড়িয়ে রেখে ঘুমোবে ? আচারের বয়ামটার কী হবে ? কোণায় পরে থাকা যত্নে জমানো পেপার কাটিংগুলো ?
এই যে টেবিল আর মেঝে জুড়ে বিছানো বইয়ের স্তূপ, টিউশনির টাকা জমিয়ে কেনা একেকটা বই যেন আমার একেকটা শিরা-উপশিরা । আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরে কেজি দরে ঠাই পাবে কোন এক পান-খেকো হকারের ভাঁড়ের ডালিতে । মুড়ি-চানাচুরের ঠোঙা হয়ে পথে পথে লুটোপুটি খাবে, পঁচা জলের নালায় ধুকে ধুকে পঁচবে আমার সমাধির দিকে তাকিয়ে । ক্যাম্পাসের ক্লাসরুম সংলগ্ন লম্বা করিডোরের চলার পথটুকু আমার পদচিহ্ন বিলীন করে দিবে নিমেষেই ! পরিধেয় বস্ত্রগুলো কোন হতভাগা নিঃস্ব ভিখেরীর গায়ে শোভা পাবে আরো কিছুদিন । বসার চেয়ারটায় হেলান দেয়ার জন্য হয়তো পরিবারের অন্য কোন সদস্যের ঘরে দিয়ে দেয়া হবে । হয়তো লেখালেখি করা, আঁকাবুকি করা খাতা-কলম, ডায়েরিগুলো জীবন সঙ্গিনীর হাত ধরে পরম যত্নে আলমারির কাপড়ের ভাঁজে থাকবে তার জীবনাবসান পর্যন্ত । আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করতে গিয়ে চোখগুলো ভিজে উঠবে নিয়মিত, সমস্ত আবগের বাঁধ ছিন্ন করে !
জীবন-নাট্যে এই অঙ্কই যদি আমার অভিনয়ের শেষ দৃশ্য হয়, তবে তা মিশে যাবে ধূলি-ধূসরিত পথের দিগন্তের মত । এই যে আমি, বিছানায় শুয়ে, এই যদি হয় শেষ শোয়া ; এই যে ভাবছি, এই ভাবনার দৃশ্য যদি হয় জীবন-ক্যামেরার শেষ ক্লিক, তাহলে ? তাহলে....................... ! কাল আর আসবেনা আমিসুদ্ধ একটি ভোর । তাতে কিছুই যায় আসবেনা এই বিশ্বজগতের । সকল বন্ধনের সুতাগুলো ছিড়ে যাবে একের পর এক । মাঝে মাঝে সেই বিচ্ছিন্নতার কথা মনে উদয় হওয়ামাত্রই কারো কারো গলায় কথা আটকে আসবে, উষ্ণ নোনা জলে উথলে উঠতে চাইবে নয়ন-জোড়া । জীবনের গল্পগুলো শুরু করবে নতুন অধ্যায়, আমিবিহীন । খেয়ালি চিত্রকরের মত আমার মনকবি আঁকবেনা আর কোন নতুন রাঙা প্রভাতের ছবি, সূর্যাস্তের সাথে একাকার হয়ে যাওয়া অপার সমুদ্রের বক্ষ, শিস দিয়ে ডেকে যাওয়া হলদে পাখির ডানা ।
আমার মিনি নামের বিড়ালটার চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে থাকবে কিছুদিন । কেউ বুঝবেনা ওটি কান্নার চিহ্ন ! বাগানের গোলাপ, গাঁদা ও জবাগুলোর বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো আবার কারো সতেজ পরশে জীবন ফিরে পাবে । আমার এই হাসি, এই উচ্ছলতা, অদম্য ছোটাছুটি, এই খানিক বা ঠুনকো অভিমান করে গাল ফুলে থাকা কিংবা জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে উঠা খুশিতে আত্মহারা হওয়া মানুষটির আত্মার ছায়া নতুন সূর্যের আলোয় দূরে যেতে যেতে অস্তিত্বহীন বা অদৃশ্য হয়ে যাবে একসময় । আর কোন সকালে আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠা হবেনা, ব্রাশটার জায়গা হবে রাস্তার পাশের কোন এক বিচ্ছিরি ডাস্টবিনে ! আমার ঠিকানায় আসবেনা কোন চিঠি, মোবাইলে বাজবেনা আমায় ডেকে চেয়ে কোন রিংটোন । কেউ এসে দরজায় কড়া নেড়ে বলবেনা , “ সে কি বাসায় আছে ?”
............... অবশেষে ঘুম ধরেই গেলো ! বড় বিস্ময়কর !
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৯