১৯৭১ সালের ১০ মে আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী 'নিউজ উইক' এর আন্তজার্তিক বিভাগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৭নং সেক্টরের মুক্তাঞ্চল থেকে দেওয়া সমর নায়ক মেজর নাজমুল হকের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। 'পাকিস্তান : হকের বিদ্রোহ' শিরোনামে নিউজউইকের সাংবাদিক মিলান জে. কিউবিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেক্টর কমান্ডার মেজর হকের এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন এপ্রিলের শেষভাগে অর্থাৎ মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আত্মপ্রকাশের ক’দিন পরেই।
পাকিস্তান : হকের বিদ্রোহ
প্রকাশকাল : ১০ মে ১৯৭১
সাময়িকী : নিউজউইক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
-------------------------------------------------
শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বাঙালি বিদ্রোহীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে একের পর এক পরাজয় বরণ করছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালি বিদ্রোহীরা এতে মনোবল হারালো না। তাদের ধারণা বা হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে এসব তুচ্ছ ঘটনা মাত্র। কেননা সুদূরপ্রসারী দীর্ঘস্থায়ী কঠিন যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি ও চূড়ান্ত বিজয়ের ল্য সবার সামনে। সবার চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা ও হিসেব পরখ করতে ‘নিউজ উইক’ প্রতিনিধি মিঃ মিলান জে. কিউবিক গত সপ্তাহে ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে 'বাঙালি লিবারেশন আর্মির' নেতা মেজর নাজমুল হকের মুখোমুখি হন। কিউবিক পরিবেশিত খবরের সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
রণাঙ্গন থেকে সংবাদদাতা মিঃ মিলান জে কিউবিক বলছেন, "পূর্ব পাকিস্তানের ২ মাইল অভ্যন্তরে একজন কৃষকের খামার বাড়ির পেছনের আঙ্গিনায় সাধারণ বাঙালি পোশাক লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরিহিত মেজর নাজমুল হকের সাক্ষাৎ পাই। এটা ছিল তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকার। বুদ্ধিদীপ্ত এ সাহসী সেনানায়ককে মনে হয়েছে অনেক আশাবাদী ও প্রত্যয়দৃঢ়। তার রণকৌশল বর্ণনায় ও সহজ সরল আলাপচারিতায় বারবার উঠে এসেছে অনাগত স্বপ্নের বাংলাদেশ আর চূড়ান্ত বিজয়ের ছক। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সম্পূর্ণ শংকামুক্ত। তিনি দখলদার বাহিনীর সৃষ্ট সশস্ত্র ত্রাস সৃষ্টির মুখেও ভীত নন। এক সপ্তাহের চেয়ে কম সময়ের মধ্যে পাক বাহিনী এলাকার জনগণের মধ্যে ধবংসযঞ্জ চালিয়েছে। এতে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মনোবল অতটুকু কমেনি। কারণ আমাদের মূল লক্ষ্য 'বাংলাদেশ'। এমন একটা সময় আসছে, যখন পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাবার পথ খুঁজবে এবং সেই সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। আমাদের সীমানায় পাক বাহিনী আসুক না। যুদ্ধের প্রথম পর্ব তখনই শেষ হবে এবং এ মুক্তাঞ্চলের অনেক এলাকা আমি পরিভ্রমণ করেছি। মেজর হকের উন্নত নিখুঁত 'উইলিস জিপের' দীপ্ত পদচারণায় মনে হয়েছে এটা যেন একটা বিজয়ী মুক্ত ভূখণ্ড। এখানকার বেশিরভাগ নারী ও অবোধ শিশুরা পালিয়ে ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে এবং মাসের পর মাস স্বদেশ ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এদেশে তখন তেল, গ্যাস, উৎপাদিত জিনিসপত্রের গুদামজাতকরণ চলছে। 'টাইফয়েড ও সংক্রামক জ্বরের ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু দিন আগে একজন ওষুধের দোকানি বলেছিলেন যে, কদিন পর এসপিরিনও পাওয়া যাবে না। এসব প্রতিকূল সমস্যার মুখেও গ্রামবাসীরা স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ইস্যুতে সমর্থন জোগাচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে শাহাপার এলাকার কথাই ধরা যাক। মেজর হকের ধ্যান ধারণা ও রণকৌশলে উৎপাদনে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া দিয়ে হাজার হাজার কৃষক ক্ষেতখামারে ফসল উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছে এবং পরবর্তী মাসসমূহে ধানের আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে হকের যুক্তি ছিল "আপনারা সবাই যদি জান বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যান, তবে সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতের স্বার্থে ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে হবে এবং সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।" মেজর হকের এ উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে কৃষক জনতা তাদের ঘরে তৈরি করা বাংলাদেশের রক্তলাল সবুজ পতাকা উচিয়ে গগন বিদায়ী স্লোগানে মেতে উঠলো জয় বাংলা! জয় বাংলা!! ধ্বনিতে। অর্থাৎ বাংলার জয়, বাংলাদেশের জয় বা বিজয়।
এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় আমার নজর কাড়লো। আর তা হচ্ছে মেজর হক এবং তাঁর প্রধান রিক্রুটার ২৪ বছর বয়েসী শাহ আবদুল মালেককে মনে হল দ্বিধাহীন ও সংকটমুক্ত দৃঢ়চেতা। গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য সারিবদ্ধ বাঙালি স্বেচ্ছাসেবকদের দলে দলে বাছাই করা হচ্ছিল একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীকে পরাভূত করার লক্ষ্যে। গাইবান্ধার এক প্রত্যন্ত গ্রামের হাইস্কুলের এক ছাত্র এই বলে তার মনের অভিব্যক্তি জানালো যে, "আমি শরণার্থী হয়ে বাঁচতে চাই না। আমার দেশ সংকটের মুখে। আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে দেশের জন্য যুদ্ধ করা, পালিয়ে যাওয়া নয়।"
মাদিল গ্রামে মাথাল মাথায় এক কৃষকের সাক্ষাৎ পেলাম, যিনি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছেন। তার মতে, আমার সন্তানেরা যুদ্ধে যাচ্ছে। এজন্য আমি গর্বিত। গরু-ছাগল ভেড়ার মতো কাপুরুষের মৃত্যুর চেয়ে রাইফেল হাতে বীরের মতো মৃত্যু অনেক শ্রেয়। এ সব কিছুর প্রেরণার মূল উৎস তাদের আপনজন ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু মেজর নাজমুল হক। সমর নায়ক নাজমুল হক যেন জনগণের মহান শিক্ষক।
আমি প্রত্যক্ষ করলাম, মেজর নাজমুল হকের সীমাহীন বিশ্বাস, উচ্ছ্বাসমুখর গণজোয়ারের পরও অন্তহীন দুর্গতিতে আচ্ছন্ন বাঙালি জনজীবন। বাঙালি যোদ্ধারা মাত্র ৩ হাজার সেকেলে রাইফেল এবং শ'খানেক ছোট মর্টার নিয়ে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। বাঙালিরা নেতৃত্বের তীব্র সংকটে ভুগছে। এ সব সত্ত্বেও মাত্র কদিন আগে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে প্রকাশ্যে ৬ সদস্যের বাংলাদেশ সরকার আত্মপ্রকাশ করেছে। এখন প্রয়োজন একটি সক্ষম সামরিক নেতৃত্ব, যারা সফল গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে এ সরকারকে অর্থবহ করে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। মেজর হক নিজেই আমাকে একথা বললেন, "আমার সহসা ভারতে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যেতে পারছি না। আমার নিকটবর্তী বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার অবস্থান এখান থেকে ২০ মাইল দূরে। এখানকার জনগণ বর্তমান লালিত ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে এবং আমাকে অনুসরণ করে আমার মতো ভারতে যেতে শুরু করবে।" এত সব কিছুর পরও নয়াদিল্লির সরকার বাঙালিদের জন্য কিছুটা সুযোগ সুবিধা প্রদান করছে। সাম্প্রতিককালে নয়াদিল্লি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গেরিলা প্রশিক্ষণ, রসদপত্র, সামরিক সরঞ্জাম, ট্রাক প্রভৃতি সরবরাহ শুরু করেছে। এটা স্বর্গীয় ব্যবস্থা বলা চলে। অনেক কূটনৈতিক এবং ভারতীয়রাও অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যে অস্ত্র দেয়ার পক্ষে। ৭০ হাজার সৈন্যের একটি নিয়মিত বাহিনীর দখলদারিত্ব সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে প্রহরাধীন বা পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা রাখে না। "আপনি যখন এখন থেকে ৪ মাস পর এখানে আসবেন, তখন ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করবেন। আমরা আপনাকে তখন সফল যুদ্ধের চিত্র দেখাবো।" সাক্ষাৎকার শেষে বিদায় নেওয়ার আগে মেজর নাজমুল হক আমাকে একথা বললেন অত্যন্ত দৃঢ়তা ও আবেগের সঙ্গে। আমার বিশ্বাস হলো- হক যা বললেন, একদিন অবশ্যই তিনি তা পারবেন। #
মেজর নাজমুল হকের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
শহীদ মেজর মোহাম্মদ নাজমুল হক ১৯৩৮ সালের ১১ আগস্ট চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার আমিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এডভোকেট হাফেজ আহমেদ তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মেজর নাজমুল কুমিলা ঈশ্বর পাঠশালা থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, কাকুল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আর্টিলারি কোরে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর কিছুকাল আগে তিনি নওগাঁয় ৭ ইপিআর তৎকালীন উইংয়ের অধিনায়ক হিসাবে যোগ দেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১০ রাত ২:৪৭