somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের সংহতি মঞ্চে (একটি অগবেষণামূলক তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি)

১৬ ই জুলাই, ২০১১ রাত ৩:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের সংহতি মঞ্চে যাবার সময় বাসে দেখা হয়ে গেলো আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রিয়, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সাথে। সাধারণ কুশল বিনিময়ের শেষে সাম্প্রতিক সময়ের তাগিদে আমাদের আলোচনায় বিকারগ্রস্ত পরিমলের কথা চলে এলো। তখন স্যার, অনেকটা ক্ষোভের সাথে তাঁর একজন সহকর্মী অর্থাৎ আমার বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মন্তব্যের কথা উল্লেখ করলেন। সেই শিক্ষকের মতে পুরো দোষটা আসলে ঐ ছাত্রীর! তার বক্তব্যের এই পর্যায়ে স্যার দ্বিমত প্রকাশ করার এবং আরো কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডার পর সেই শিক্ষক বেগতিক দেখে অভিযোগ করে বসলেন, স্যার নাকি তার সাথে সব ব্যাপারেই বিরুদ্ধাচরণ করেন, অর্থাৎ যুক্তিতে না পেরে অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আসার সেই পুরনো কৌশল! স্যারের মতে সেই শিক্ষক মনেহয় অভিন্ন ধর্মাবলম্বি হওয়ায় পরিমলের সমর্থন করছিলো! তবে আমরা সবাই জানি, যে ব্যক্তি অপরাধী, সে সব ধর্মে, গোত্রে, বর্ণে, স্তরেই অপরাধী। সেটা তারেক রহমান থেকে শুরু করে আমার এলাকার নাজু-আজু ভ্রাতাদ্বয় পর্যন্ত!

পরের দৃশ্যে স্যার নেই; সময় বিকেল ৩.৫৭ মিনিট। আমি দাঁড়িয়ে আছি শহীদ মীনারের মূল বেদিতে উঠবার সিড়ির গোড়ায়। লক্ষ করছি কারা কারা এর মধ্যে এসে পৌছেছেন। পেছনে, ডান দিকে একজন লোক এগিয়ে এলেন; তার দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। কথা শুরু করার জন্যে তার প্রথম বাক্য-
- কী যে অবস্থা হইলো, পরিমলের তো খবরই আছে, এই অপরাধের শাস্তি মৃতুদন্ড, এ্যামেন্ডমেন্টে আছে, ৯১ ধারায়।
(সঠিকভাবে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০; সেকশন ৯, সাবসেকশন ১; লিঙ্ক) । তবে এই আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটা নির্ভর করছে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ওপর। এখানে বলা ভালো, আমার উকিল বন্ধুর ভাষ্যমতে, মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে শর্ত থাকলেও সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে বিচারকের ওপর। অর্থাৎ বিচারক চাইলে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কারণে মৃত্যদণ্ড ঘোষনা করতেও পারেন।

পরের বাক্যে তিনি নিজেকে সুপ্রিম কোর্টের একজন উকিল বলে পরিচয় দিলেন। অপরিচিত কারো সাথে হুট করে এমন একটি গূঢ় বিষয়ে জড়াতে চাইলাম না বলে আমার উত্তর ছিলো-
- হুম!
কিন্তু পরিচয়ের যে দূরত্ব সেটা মনে হয় ঐ ব্যক্তি মানতে চাইলেন না, দ্বিগুন উৎসাহে তার মুখ চলা শুরু করলো। এবার একটা প্রশ্ন দিয়ে-
- “আচ্ছা আপনার কী মনে হয়, দোষটা কার? পরিমলের নাকি ঐ মেয়েটার?”
অনলাইনে নানান বাকবিতণ্ডা প্রত্যক্ষের পর এই গুরুতর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম-
- আপনার কী মনে হয়?
সোৎসাহে তিনি বললেন,
- আমার তো মনে হয় আসলে একটা মিউচুয়াল রিলেশন ছিলো, পরে হয়তো কোন টিচার বা স্টুডেন্টের কাছে ধরা পরে যাবার পর ব্যাপারটা এভাবে প্রকাশিত হইসে।
ঠান্ডা কন্ঠে আমার প্রশ্ন ছিলো-
- কেন এমন মনে হলো আপনার?
তিনি বললেন-
- কারণ মেয়ের শরীরে কোন আলামত নাই, কোন আচড় নাই, জামাকাপড় ছিড়াফাড়া নাই। ধর্ষণ করলে কিন্তু এইসব থাকবে। পরিমল যখন মেয়েটারে বাধতে চাইলো, তখন মেয়েটা নিশ্চয়ই বাধা দেয় নাই, দিলে তার জামাকাপড় ছিড়া থাকতো কিন্তু সেইরকম কিছুই হয় নাই।
এখানে আমি তাকে থামালাম-
- মেয়েটা বাধা দিলে, ধস্তাধস্তি করলে কার জামা ছিড়তো? নিজেরটা নিশ্চয়ই না, পরিমলেরটা ছিড়তো। শক্তিতে পরিমলের সাথে মেয়েটা পেড়ে ওঠেনি আর ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনায় বস্ত্রহরণের সময় পরিমল নিশ্চয়ই ধীরস্থির ছিলো! আর একজন ব্যক্তি যখন এমন কিছু গোপন করতে চাইবে তখন সে নিশ্চয়ই এই ব্যাপারগুলো সযত্নে খেয়াল রাখবে!

কথোপকথনের এই পর্যায়ে তিনি থেমে যান, খুব মনযোগ দিয়ে আমার কথা চিন্তা করছেন বলে মনে হয়। আমি একরকম অবহেলায় তাকে পেছনে রেখে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকা মানুষের ভিড়ের দিকে এগিয়ে যাই। আরো কোটি কোটি মানুষের চিন্তাধারার এমন একজন ব্যক্তিকে আমি বিন্দুমাত্র গুরুত্ত্ব দেই না, তবে চিনে রাখি।

আসলে আমাদের পুরো সমাজের এইসব নিয়মতন্ত্রগুলো একটা ভুল পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছে। শৈশবে আমাদের বাবা-মা, অভিভাবকরা কন্যা সন্তানের হাতে পুতুল, খেলনা থালাবাটি তুলে দিয়েছিলেন; অন্যদিকে পুত্র সন্তানদের হাতে টেনিসবল, ফুটবল। অর্থাৎ আমরা নিজেরা বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো ঘর/বাহিরমুখি বাধকতার মধ্যে। ঠিক একই প্রক্রিয়ার/নিয়মের ধারাবাহিকতায় কিছু মানুষ তাদের পারিপার্শ্বিকতার নারীদের চিনেছে নিছক একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে। তাদের চিন্তামতে/বিবেচনায় নারী মাত্রই ক্ষুদ্র মননের, স্বল্প ক্ষমতার একটি প্রাণী যা আসলে পুরোপুরি পুরুষের অধীন! আমার এই কথাটি বেশ ভদ্র করে বলা, এই কথাগুলো আরো বিশ্রী এবং অশ্লীল করে ঐ মানুষগুলো (?) চিন্তা করে! ওরা এই রকম ঘটনায় প্রথমেই নারী চরিত্রটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেষ করে। অন্য কোন কিছু বিবেচনা করার আগে শুধুমাত্র নারীটির ভুল খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! এমন হিসেবের ক্ষেত্রে আমরা এই সমিকরণেই অভ্যস্ত। এটা আমাদের বহুচর্চিত ঘৃণ্য একটি অভ্যাস।

এর পরের দৃশ্যে আমি বসে আছি শহীদ মীনারের সবচাইতে প্রশস্ত অংশে। অদূরে, মূল বেদীর কাছাকাছি বসেছেন আজকের সংহতি মঞ্চের মূল বক্তা এবং সংহতি প্রকাশকারী দেশের কয়েকজন গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁরা ছিলেন রেহনুমা আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী, নাট্য সংগঠক মামুনুর রশীদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, নিউ এজ’র সম্পাদক নুরুল কবিরসহ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, স্পর্ধা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো কয়েকটি সংস্থার/প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ। এছাড়া ছিলেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের বর্তমান এবং প্রাক্তন অনেক ছাত্রী। প্রথমেই মিরসরাইয়ের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা স্মরণ করে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হলো। এরপর প্রতিনিধিগণ সংহতি প্রকাশ করত তাদের বক্তব্য দিচ্ছিলেন, ক্রমে মঞ্চের আশেপাশে মানুষ বাড়ছিলো। এক পর্যায়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের পক্ষ থেকে এলেন ছয় বছর আগে পাশ করা একজন। আমি তাঁর নাম ভুলে গেছি, মনে রাখাটা খুব দরকার ছিলো কারণ পরের মিনিট দশেক ধরে তিনি যা বললেন তা এর আগে অন্য কোন বক্তা বলেননি! তাঁর প্রতিটি বাক্যে আগুন ছিলো, দৃঢ়তা ছিলো, অঙ্গিকার ছিলো! ছাত্রীদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবের গুজব আর পরিমলের বিকারগ্রস্ত আচরণের সমর্থকদের ধুলোয় মিশিয়ে তিনি কথাগুলো বলছিলেন! প্রতি মূহুর্তে পুরো মঞ্চ উষ্ণতর হচ্ছিলো! উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো পুরো শহীদ মীনার! মনে হচ্ছিলো শেষ বিকেলের পুরো আলোটুকু তাঁর ওপর গিয়ে পড়েছে! কথা শেষে যখন তিনি তাঁর সতীর্থদের কাছে ফিরে এলেন, তাঁকে আবেগে জড়িয়ে ধরলেন সবাই! আমি, আমার আশেপাশে সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম উত্তেজনায়।


এরপর আরো কয়েকজন বক্তা আর বক্তব্যের পর সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং তারপর আজকের মতোন শেষ হলো সংহতি মঞ্চের উপস্থাপনা। কিন্তু প্রতিবাদ এখানেই শেষ নয়; পরিমল ও তার মদদ দাতাদের কঠোর বিচারকার্য নিশ্চিতকরণ, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের জন্যে এই মঞ্চ আরো এগিয়ে যাবে; এটা আমার মতো আরো লক্ষাধীক মানুষের প্রাণের চাওয়া। আর অনেকগুলো মানুষ যখন একমত হয় তখন তার বাস্তবায়ন শুধু সময়ের ব্যাপার। আমি আশা ছাড়তে অভ্যস্ত নই, আমি আশা ছাড়বো না! আমি জানি আমার সাথে আছে অসঙ্খ্য মানুষের অভিন্ন একটি প্রতিজ্ঞা!




২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×