somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প : পরী ও আমার বৌ

১১ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দীপা খুব ভাল মেয়ে। বিজ্ঞাপনের বিয়ে হলেও দীপার সঙ্গে মাসতিনেক একটুআধটু ঘোরাফেরা করেছি। দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের মেলামেশা। বিষয়ের মধ্যে নতুন কিছু নেই। আজকাল সব পরিবারই এরকম করে। সময় বদলে গেছে। দুজন মানুষ একসঙ্গে জীবন কাটাবে। বিরাট বড় সিদ্ধান্ত। এরকম একটা সিদ্ধান্তের আগে দুজন দুজনকে জানবে না। চিনবে না। এটা ঠিক কথা না। তিনমাস একটু-আধটু মিশে মানুষ চেনা যায় না। কথা সত্য। পুরোটা হয়তো বোঝা যায় না। কিন্তু খানিকটা বেরিয়ে আসে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মধ্যে। আমার মনে হয়েছে দীপা খুবই সহজ-সরল একটা মেয়ে। দীপার মধ্যে ঘোর-প্যাঁচ কম। সেই দীপা যে এরকম বিপদে ফেলবে ভাবতে পারিনি। তিনমাসের পরিবার অনুমোদিত প্রেমের পর বিয়ে হয়ে গেল। বেশ ধুমধাম করে। সবই ঠিকঠাক। বিপদে পড়লাম ফুলশয্যার রাতে। দীপা তাঁর সারল্য মাখা মুখটা আমার একদম কাছে এনে বলল--"আমরা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। আমি চাই না কোনরকম মিথ্যা দিয়ে আমাদের জীবন শুরু হোক। তুমি তোমার অতীতের কথা নাই বলতে পারো। বাধ্যবাধকতার কিছু নেই।" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল। তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলতে শুরু করল। স্কুলের বাচ্চারা যেমন মুখস্থ পড়া বলে। সেরকমই খুব দ্রুত বলছে দীপা। যেন একটু দেরী হলেই ভুলে যাবে সবটা। মিনিট দশেকের মধ্যে চব্বিশ বছরের জীবনের ইতিহাস বলে ফেলল দীপা। এই ইতিহাসের মধ্যে প্রেমের ঘটনাও আছে। কলেজের কোন এক স্যারকে ভীষণ ভাল লাগত। এই অল্প সময়ের মধ্যে সবটা বলল। আশ্চর্য ব্যাপার। আমার বুঝতে কোন অসুবিধা হল না। গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতা আছে দীপার। খুব কম মানুষের এই গুণ থাকে। অনেক পন্ডিত ব্যক্তিকে দেখেছি। ছোট করে কিছু বলতে পারে না। বলতে গেলেই আওয়ালে ফেলে। আমি পড়লাম বিপদে। একটা না। একসঙ্গে দুরকম বিপদে পড়লাম। প্রথমত আমি দীপার মত অল্প কথায় গুছিয়ে বলতে পারব না। সেইসঙ্গে ভাবছি। গোপন কথা বলা ঠিক হবে কিনা। দীপা যদি ভুল বোঝে। অন্য ভাবে কথাটা নেয়। এই ভুল বোঝাবুঝির ভয়ে পরীর কথা কাউকে বলতে পারি না। পরীর ঘটনা বাদ দিয়ে নিজের ইতিহাস বলতে পারি। হয়তো বেশি কথায় বলব। কিন্তু দীপা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবে না। আমার বুকের মধ্যে একটা গল্প লুকিয়ে আছে। কিন্তু সমস্যায় ফেলল দীপার সারল্য। মিথ্যা বলতে ইচ্ছে করল না। জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে। যখন মিথ্যে বলা যায় না। বুঝলাম। এখন সেরকম সময়। জানি অনেক সময় লাগবে। মাঝামাঝি পৌঁছনোর আগেই হয়তো দীপা বিরক্ত হবে। তবুও বলতে শুরু করলাম। পরীর গল্প--"দীপা শোনো। শুধু একটা গল্প। এটা ছাড়া আমার বলার মত তেমন কিছু নেই। বাবার ট্রান্সফার হত। চার পাঁচ বছর পর পর। আমরাও নতুন নতুন জায়গায় যেতাম। বাবার সঙ্গে সঙ্গে। শুরু হত নতুন স্কুল। নতুন পরিবেশে আমাদের জীবনযাপন। সেবার বাবার বদলি হল নর্থবেঙ্গলে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল। উত্তরবঙ্গটা দেখার। বদলির খবরে বাড়ির সবার মন খারাপ হলেও আমার বেশ ভাল লাগল। কিন্তু তখনও কি জানি। আমার জন্য এরকম ঘটনা অপেক্ষা করছে। বাড়িটা খুব সুন্দর। ফ্ল্যাট না। বাড়ি। জীবনের বেশিরভাগ সময় ফ্ল্যাটে থাকতে হয়েছে। এই প্রথম কোন বাড়িতে থাকছি। উঠোন আছে। বেশ বড়। উঠোনের এক কোণে ফুলের বাগান। দিন কাটতে লাগল। সপ্তাহখানেক পর পাশের বাড়ির ছাদে একটা মেয়েকে চোখে পড়ল। অসহ্য সুন্দর একটা মেয়ে। অসহ্য সুন্দর বললাম। কারণ আছে। মেয়েটা খুব বেশি সুন্দর। খুব বেশি সৌন্দর্য বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। বেশিক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম না। মাসখানেকের মধ্যে তিনচারবার মেয়েটাকে দেখেছি। অদ্ভুতভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাধারণত বিকেলের দিকে ছাদে আসত। তাকানোর মধ্যে একটা মন উদাস করা ভাব আছে। মেয়েটা বোধহয় কবিতা লেখে। আমার সেরকমই মনে হল। কিন্তু শুধু দেখলে তো আর হবে না। কথা বলতে হবে। খোঁজ নিতে হবে। কোন কলেজে পড়ে ? নাকি এখনো বসে আছে স্কুলের চৌকাঠ পেরোনোর অপেক্ষায়। আমার তখন কলেজবেলা। মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছি। অন্য কিছু ভাল লাগছে না। জীবনে প্রথম প্রেমে পড়লাম। খোঁজ নিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম। আমার কপাল মন্দ। অল্প মন্দ না। ভয়ংকর রকমের দুঃখের কপাল আমার।" দীপা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দুঃখের গল্প দীপা খুব মন দিয়ে শুনছে। অন্য কথা না বলে আবার শুরু করলাম। জল খাওয়ার দরকার। কিন্তু মনে হল জল খেতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। দীপা যেরকম মন দিয়ে শুনছে। এই অবস্থায় অন্য কিছু করতে পারলাম না। সেই ভয়ঙ্কর কষ্টের কথাগুলো বলতে হবে। ভাবতেই আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।

যেন তাড়াতাড়ি শেষ হলে কষ্ট কম হবে। সেইজন্য খুব দ্রুত বলতে শুরু করলাম--"খোঁজখবর নিয়ে জানলাম। মেয়েটির নাম-পরী। নামের সঙ্গে সাধারণত মানুষের মিল থাকে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখলাম। ঘটনা অন্যরকম। পরী আকাশের পরীদের মতই সুন্দর। আর সেইসঙ্গে জানতে পারলাম। পরী পাগল। বেশিরভাগ সময় পরীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। স্নান খাওয়ার সময় পরীর বাঁধন খোলা হয়। পরীকে দেখাশোনা করার লোক আছে। অনেক সময় তাঁদের ফাঁকি দিয়ে পরী ছাদে উঠে যায়। অবশ্য ছাদে উঠলে ভয়ের কিছু নেই। পরীদের ছাদ ঘেরা। পড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ঘটনা জানার পর আমি পরীদের বাড়িতে গিয়েছি। দেখেছি। পরীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেই অবস্থায় পরী হাউ-হাউ করে কাঁদছে। এরকম কষ্টের দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। পরীর মা বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। পরীর চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পরীর চিকিৎসার কোন ত্রুটি নেই। কিন্তু পরীর কোন উন্নতি হচ্ছে না। পরীর কষ্ট সহ্য করতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানে থাকা যাবে না। বাবাকে বললাম। সব। সব কথা। বাবা দ্রুত বুঝতে পারল। আমি আসলে গভীর খাঁদের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। চলে এলাম কলকাতায়। মাঝপথে কলেজ ছাড়লাম বলে বছর নষ্ট হল। বাড়ির সবাই আমার ওপর রেগে গেল। সেই ভয়ঙ্কর কষ্টের সময় বাবা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির সবাই উত্তরবঙ্গে থাকল। আমি একা চলে এলাম। কলকাতায়। আমাদের নিজের বাড়িতে। পরের বছর আবার কলকাতার কলেজে ভর্তি হলাম। তারপর এগারো বছর কেটে গেছে। বাবা ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় এলো। বাবার রিটায়ারমেন্ট হল। আমি চাকরি পেলাম। জীবনে আর কখনো উত্তরবঙ্গে যায়নি। জানিনা পরী কেমন আছে। পরী বুকের গভীরে বেঁচে আছে। গোপন দুঃখের মত।

পরীর গল্প বলা শেষ। এবার দীপার চোখের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। দীপার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এতক্ষণ আনমনে কথা বলছিলাম। কষ্টের ঘোরে। খানিকটা নিজের সঙ্গেই। দীপা নামের কোন নববধূ আমার কথা শুনছে। শুধু শুনছে না। গল্প শুনে দীপার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সেটা খেয়াল করিনি। দীপাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলাম। অন্যের কষ্টে যাঁর চোখ থেকে জল পড়ে। সেই মানুষকে দূরে রাখা যায় না।
.
ছবি সৌজন্য : গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:০৩
১১টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×