জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ নিজেই ছিলেন আল বদর বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান। এই তথ্য পাওয়া যায় জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম এ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। আর এ বাহিনীর পুরো পাকিস্তানের প্রধান ছিলেন দলটির প্রধান (আমির) মওলানা মতিউর রহমান নিজামী। বিগত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-১ (সাঁথিয়া ও বেড়ার একাংশ এলাকা) আসনে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নিজামী প্রথমে এমপি নির্বাচিত হয়ে কৃষিমন্ত্রী, পরে শিল্পমন্ত্রী হন। তিনি পাবনার মানুষের কাছে একাত্তরের কুখ্যাত 'মইত্যা রাজাকার' হিসেবে পরিচিত। এই নিজামী এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী বাঙলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধেই শুধু অবস্থান নেননি, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞ ও যাবতীয় ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বাঙালিদের হত্যা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানী, সম্পদ লুট. বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া সহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে জামায়াত ও তাদের সৃষ্ট রাজাকার, আল-বদর, আল সামস বাহিনীর অপকর্মের খবর পাওয়া যায়।
একাত্তরের নথি কি বলে ?
১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর আমির মওলানা নিজামী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য আল বদর বাহিনী গঠন করা হয়। মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন এই আল বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। আল বদরের নেতারা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন করেন এবং তাদের নির্দেশে ডিসেম্বর মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে শত শত বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। নিজামীর নেতৃত্বে পরিচালিত আল বদর বাহিনীর হাতে বুদ্ধিজীবী হত্যার ভয়াবহ বিবরণ দেশের বিবরণ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
নিজামী ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর দলীয় মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম এ 'বদর দিবস : পাকিস্তান ও আল বদর' শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেন। তিনি লিখেন, ' আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাক বাহিনীর সহযোগিতায় এদেশের ইসলাম প্রিয় তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল বদর বাহিনী গঠন করেছে। সেদিন আর খুব দূরে নয় যেদিন আল বদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি হিন্দু বাহিনীকে (শত্রুবাহিনী) পর্যুকরে হিন্দুস্থানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করবে।' তিনি তার দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের পাকিস্তান রক্ষায় আক্রমণাত্মক হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন,' ... শুধু পাকিস্তান রক্ষার আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা চালিয়েই এ পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে না।'
শান্তি কমিটি গঠনের পর ১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে ঢাকায় প্রথম ঢাকঢোল পিটিয়ে মিছিল বের করা হয়। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম, খান এ সবুর, মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ। মিছিল শেষে গোলাম আযমের নেতৃত্বে পাকিস্তান রক্ষার জন্য মোনাজাত করা হয়। ( তথ্যসূত্র : দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ এপ্রিল১৯৭১)
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের ধ্বংস করার আহবান সম্বলিত নিজামীর বক্তব্য, বিবৃতির বহু বিবরণ একাত্তরের জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে পাওয়া যায়। যশোর রাজাকার সদর দপ্তরে সমবেত রাজাকারদের উদ্দেশ্য করে নিজামী বলেন, ' জাতির সংকটজনক মুহূর্তে প্রত্যেক রেজাকারের উচিত ইমানদারীর সাথে তাদের উপর অর্পিত এ জাতীয় কর্তব্য পালন করা এবং ঐ সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরু্দ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ( দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
বিবরণ
মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার এলাকাবাসীও হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদির অভিযোগ এনেছেন। পাবনার জেলার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের আমিনুল ইসলাম ডাবলু গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছে, তার পিতা মোঃ সোহরাব আলীকে একাত্তরে নিজামী নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরও জানান যে, নিজামীর নির্দেশেই তাদের এলাকার প্রফুল্ল (পিতা : নয়না প্রামানিক), ভাদ ( পিতা : ক্ষিতীশ প্রামানিক ), মনু ( পিতা : ফেলু প্রামাণিক) এবং ষষ্ঠী প্রামাণিক ( পিতা : প্রফুল্ল প্রামানিক) কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী রয়েছে বলে তিনি জানান।
একাত্তরের সাত নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুসকে (পিতা : ডি. সৈয়দ আলী শেখ, সাং-গ্রাম : মাধবপুর, পো: শোলাবাড়িয়া, থানা-জেলা : পাবনা) আল বদররা ধরে নিয়ে গেলে তিনি প্রায় দু'সপ্তাহ আল বদর ক্যাম্পে আটক ছিলেন। ক্যাম্পে আটক থাকাকালীন তিনি আল বদর বাহিনী কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, অগ্রিসংযোগ, ধর্ষণ ইত্যাদির পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করেন। এই পরিকল্পনারয় মতিউর রহমান নিজামী নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে তিনি জানান। ২৬ নভেম্বর সাত্তার রাজকারের সহযোগিতায় ধুলাউড়ি গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস আল বদর বাহিনীর একটি সমাবেশ এবং গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। বৈঠকে নিজামীও উপস্থিত ছিলেন। নিজামী সে বৈঠকে তার বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত ও সমূলে ধ্বংস করার নিদের্শ দেন। ব্ঠৈকে কোথায় কোথায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি এবং আওয়ামী লীগ সেতৃবৃন্দের বাড়ি আছে তা চিহ্নিত করা হয়। কুদ্দুস আরো জানান, নিজামী তার গ্রামের ঝুটি সাহার ছেলে বটেশ্বর সাহা নামক একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধোকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন।
নিজামীর বিরু্দ্ধে অনুরূপ অভিযোগ করেন সাঁথিয়া থানার মিয়াপুর গ্রামের মোঃ শাহাজাহান আলী ( পিতা : জামাল উদ্দিন)। যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে আরো কয়েকজন আটক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারও গলায় ছুরি চালানো হয়েছিলো। অন্যদের জবাই করে করলেও শাহাজাহান আলী ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। গলা কাঁটা দাগ নিয়ে তিনি এখন পঙ্গু জীবন যাপন করছেন। তাঁর সহযোদ্ধা দারা, চাঁদ, সুলমে, আখতারসহ আরো অনেককে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে গরু জবাই করার লম্বা ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। সে দিন প্রায় ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা জবাই হয়েছিলেন। মু্ক্তিযোদ্ধা কবিরের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের নীল নকশা প্রণয়ন করেন মতিউর রহমান নিজামী।
৭ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে জামায়াতের আমির হিসেবে নিজামীর শপথ গ্রহণের দিন ঢাকায়, কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক গণসমাবেশে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পাবনা থেকে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ। একাত্তরে নিজামীর হাতে নির্যাতিত নিজামীর-ই নির্বাচনী এলাকা পাবনা জেলার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের অধিবাসী আবদুল লতিফ সেদিন সমবেত সমাবেশে বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনায় যিনি মইত্যা রাজাকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনিই জামায়াতে ইসলামীর নতুন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। তিনি একাত্তরে নিজামীর দুষ্কর্ম বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাতে নিজামী এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ এবং বাড়ি-ঘরে অগ্নি সংযোগ করে। সেই আক্রমণে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। . . . সেই রাতে হামলাকারী আল বদর ও পাকিস্তান হানাদাররা তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতনের পর তাকে গুলি করে হত্যা কর। এর আগে ১৩ আগষ্ট আবদুল লতিফকে আল বদর বাহিনীর বেড়া বাজার থেকে ধরে নগরবাড়ি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ষেকানে পাকিস্তানী বাহিনীদের পাশাপাশি মতিউর রহমান নিজামীও তাঁর ওপর নির্যাতন
চালায় ( ভোরের কাগজ, ৮ ডিসেম্বর ২০০০)।
প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র :
: একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি-গণতদন্ত কমিশন রির্পোট সংক্রান্ত প্রকাশনা
: প্রথম আলো
: সমকাল
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



