আমাদের দেশে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ঘটছে মেধার অপচয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনা এবং ক্যারিয়ার কাউন্সিলিংয়ের অভাবে উচ্চশিক্ষায় ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারলে উপযুক্ত সময়েই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় এবং কিভাবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা যায়। সময় বদলেছে। বিজ্ঞানের জোয়ার এখন বিশ্বের সকল দেশের মতো বাংলাদেশেও। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে আইসিটি সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়া। কারণ নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশী তরুণদের জন্য অপেক্ষা করছে সাড়ে ৩১ হাজার কোটি টাকার তথ্যপ্রযুক্তি বাজার। পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নেই সম্ভব সার্থক আইসিটি ক্যারিয়ার গঠন।
বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিধি বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশের আইসিটি খাতও ব্যতিক্রম নয়। সবখানে এখন তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কাজের প্রচুর চাহিদা। এখানে কাজ আছে, কিন্তু নেই সে অনুপাতে চাহিদা পূরণ করার মতো দক্ষ জনশক্তি। এ আইসিটি কাজের চাহিদা পূরণে আমাদের প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। সূত্র মতে, ২০০৪ সালের পর থেকে আইসিটিবিষয়ক চাকরির অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন হতে থাকে। বাড়তে থাকে চাকরির বাজার। ফলে খুব দ্রুত শূন্য হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন, আর তার চেয়ে দ্রুত চাহিদা বাড়তে থাকে এসব বিষয়ের পেশাজীবীদের। এ চাহিদা বেড়েই চলেছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় একই হারে যোগ্য আইসিটি পেশাজীবী বাড়ছে না। তাই ২০০৫ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী আইসিটিতে সব দিক থেকে জ্যামিতিক হারে চাহিদা বেড়েই চলেছে। ইদানীং আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
মূলত ২০০৫ সালের পর থেকেই ধীরে ধীরে আইসিটি ঘরানার লোকদের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। এ সময়ে সব ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে প্রযুক্তি ডিজিটাইজ করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হওয়ায় আইসিটিসংশ্লিষ্ট লোকদের চাহিদা বাড়ে। সে চাহিদা ক্রমশ বেড়েই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষা থেকে আইসিটিবিষয়ক তথ্য পর্যালোচনার জন্য এ খাতের চাকরিকে আট ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- কমপিউটার আইএস ম্যানেজার, কমপিউটার সায়েন্টিস্ট সিস্টেম অ্যানালিস্ট, কমপিউটার প্রোগ্রামার, কমপিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কমপিউটার সাপোর্ট স্পেশালিস্ট, ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রের, নেটওয়ার্ক কমপিউটার সিস্টেমস অ্যাডমিনিস্ট্রের এবং নেটওয়ার্ক সিস্টেমস ডাটা কমিউনিকেশন অ্যানালিস্ট। এদের মধ্যে ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে কমপিউটার আইএস ম্যানেজারের চাকরি বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ২০০০ সালের প্রথমার্ধে যেখানে কমপিউটার আইএস ম্যানেজারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার, সেখানে চার বছর পর এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ লাখ ৪১ হাজার। আমাদের পাশের দেশ থাইল্যান্ডের আইসিটিবিষয়ক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০০৭ সাল থেকে সেখানে ক্রমেই এখাতে চাকরি বাড়ছে। সেই সাথে তাদের এ সমীক্ষার সাথে মিল রেখে ধারণা করা হয়, ২০০৯ সালেও এই বেড়ে চলা অব্যাহত থাকবে। শুধুই যে চাকরি বাড়ছে, তা নয়। আইসিটিবিষয়ক বিভিন্ন সার্ভিস এবং সার্ভিসসংক্রান্ত সুবিধাও অনেক বেড়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, থাইল্যান্ডে অন্যান্য দেশের মতো আইসিটির হার্ডওয়্যারের চাহিদার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি না ঘটলেও চাকরি ও সার্ভিস বেড়েছে।
বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এর জোয়ার। তাইওয়ান যেখানে ইলেক্ট্রনিক্স শিল্প দিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং সৌদি আরব যেখানে নিজেদের খনিজ সম্পদের মাধ্যমে নিজের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে, সেখানে ভারত তথ্যপ্রযুক্তিকে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কাজে লাগাচ্ছে। বাংলাদেশও একই পথ ধরে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে যেখানে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বাজার ছিল আড়াই কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৫০ কোটি মার্কিন ডলারে।
এক্ষেত্রে আমরা পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখবো আইসিটি’র অগ্রযাত্রা। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ভারত তাদের পিডিপির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য হারে তথ্যপ্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। ভারত গত বছরে ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে। এজন্য তারা নতুন করে প্রতিবছর ৩ লাখ তথ্যপ্রযুক্তি জানা লোকদের নিয়োগ দিচ্ছে, যারা প্রতিবছর আরো ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করতে পারে। এজন্য এরা পাঁচসালা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যার বাস্তবায়ন শুরু হতে যাচ্ছে অচিরেই। যেখানে বাংলাদেশে প্রস্তাবিত ২ লাখ তথ্যপ্রযুক্তি জানা লোকদের নিয়োগ দেবার সম্ভাবনা আছে। এরা সাড়ে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার তথা টাকার অঙ্কে সাড়ে ৩১ হাজার কোটি টাকা আয় করে জাতীয় রাজস্বে ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের এ সমীক্ষায় আরো বলা হয়েছে, এখন ঢাকা যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় ১০ বছর আগে ছিল হায়দ্রাবাদ। হায়দ্রাবাদ এখন ভারতের অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি কাজে সমৃদ্ধ নগরী। সুতরাং আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে এ তথ্যপ্রযুক্তি দিয়েই।
আইসিটি সেক্টরে পড়ার সুযোগ
আইসিটি সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়তে হলে এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার বিকল্প নেই। এখনো আইসিটি বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় দেশের ছাত্রদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। তবে আশার কথা হলো সরকারি ও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিবছর মানসম্পন্ন আইসিটি ডিগ্রিধারী তৈরি করছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন মান্ধাতার আমলের পাঠ্যসূচী বদলে আধুনিক পাঠ্যসূচী অনুসরণ করছে। বর্তমানে দেশের প্রায় সবক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিটি সেক্টরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। চাইলে এ বিষয়ে দেশের বাইরেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যাবে। তবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতমানের শিক্ষার পাশাপাশি কাজ করার বা পাওয়ার সুবিধা আছে, যা আমাদের দেশে সীমিত। তবে প্রথমদিকে ভাষা ও পরিবেশগত কিছু সমস্যা হতে পারে, যা কাটিয়ে ওঠা কোনো সমস্যা নয়। আর আইসিটিসহ নতুন প্রযুক্তি বা প্রকৌশল অনুষদে পড়াশোনার জন্য বা হালনাগাদ থাকার জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিকল্প নেই। অনেক সময় বড় বড় প্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির টেকনিক্যাল বিভাগে কর্মরত পেশাদারদের নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা বা উচ্চতর ডিগ্রি নেবার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে থাকে। তাই বিদেশে উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে সবারই কিছুটা ধারণা থাকা দরকার।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো নির্দিষ্ট পর্যায় বা সীমা নেই। অনেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাতে পারেন। আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করেও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে পারেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান বৃত্তি দিয়ে থাকে। বৃত্তি নিয়ে অনেকেই ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তাছাড়া ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফ্রাঞ্চাইজ’ শিক্ষা কার্যক্রমে বিশ্বের বিখ্যাত আইসিটি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা যায়। এজন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলে যোগাযোগ করা যেতে পারে।