কলকাতার অসহ্য গরম, দুধসাগর ফলসে লিটন আর রাকিবের দুধের মত সাগর খুজে না পাওয়া, নর্থ গোয়ার বিচের মনমুগ্ধতা, সাউথ গোয়ায় যাওয়ার সময় ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল ভঙ্গ করে স্কুটার নিয়ে ছুটে চলা, লোনাভালাতে বর্ষাকালেও একদিনের জন্য হালকা শীতের আমেজ, বিশাখাপত্তমের বীচ, আর ভাইজেগের গোছানো শহর কি ছিলনা আমাদের এই বাজেট ট্যুরে!!
এই ঈদে কোন ট্যুরে যাব কিনা তা নিয়ে পাঁচটানায় ছিলাম। তারপরেও কি ভেবে সোহেল ভাইকে বললাম ভাই রাজস্থান ট্যুর দিয়ে আসি কি বলেন? উনি বললেন একবারতো ঐদিকে গেলেনই এইবার অন্যদিকে যান, গোয়া-বিশাখাপত্তম এই রুটে যেতে পারেন। গোয়া আমার কাছে বরাবরই একটা খরুচে জায়গা মনে হয়। সোহেল ভাই আশ্বস্ত করলেন খরচ বেশি হবে না। রোজার আগেই পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম। কলকাতা টু কলকাতা বাজেট ১৪০০০ টাকা নির্ধারণ করলাম আর এ নিয়ে গ্রুপে একটা পোস্ট দিলাম যে কেউ যাবে কিনা? হালিম ভাই ইতিবাচক সাড়া দিলেন, লিটন আর রেজাউল ভাইয়ের সাথে কথা বলার পর তারাও রাজী হলেন। অনলাইনে কলকাতা-গোয়া-পুনের টিকেট নিজেই টিকেট করে ফেললাম রোজার এক সপ্তাহ আগে। কলকাতা-গোয়া এর টিকেট RAC তে ছিল তাই এত আগে টিকেট করা। ২-৩ দিন পর লিটন ফোন দিয়ে বলল রাকিব আর রাসেলও যেতে চায়, তাই ওদের সহ টিকেট করে ফেললাম। আসলে পুনে আমাদের ট্যুরের অংশ কখনই হত না যদি না যেভাবে গিয়েছি আর সেইভাবে আসার টিকেট পেতাম। কলকাতা-গোয়া-পুনে-লোনাভালা-বিশাখাপত্তম-কলকাতা এর ট্রেন টিকেট বাবদ আমাদের খরচ মোটামুটি ৩১০০ টাকা। এসির টিকেট না পাওয়াতে সব নন এসি স্লিপার ক্লাসের টিকেট করেছিলাম।
আমাদের ঢাকা-কলকাতা-গোয়া-লোনাভালা-বিশাখাপত্তম-কলকাতা-ঢাকা ৫৭০০+ কিলোমিটার ভ্রমনের শুরু ঈদের পরের দিন ১৭ জুন ২০১৮ রাতে নবীনগর থেকে বাসে (হালিম ভাই কল্যাণপুর থেকে)। সকাল ০৫:৩০ মিনিটে বাস থেকে বেনাপোল নেমে দেখি অন্তত ১০০০ মানুষের লম্বা লাইন। এত বড় লাইন দেখে বেনাপোলে পরিচিত দালাল জনিকে ফোন দিলাম, বাকি সবাইকে লাইনে রেখে জনির কাছে আমাদের ছয় (০৬) জনের পাসপোর্ট দিয়ে দিলাম ইমিগ্রেশন করার জন্য। এই ফাকে প্রায় ২৫ মিনিট চেষ্টা করার পর আমি টার্মিনাল এর টিকেট কেটে নিলাম ৪৫ টাকা করে। জনির বদলে অন্য একজন সকাল ০৬:১৫ মিনিটে ইমিগ্রেশন করে আমাদের পাসপোর্ট ফেরত দিল।
সবাইকে ফোন করে টার্মিনালের সামনে আসতে বললাম। কোনমতে একটা লাইনে ঢুকে পড়লাম। ০৬:৩০ মিনিটে গেট খুলে দিল, আর শুরু হল ধাক্কাধাক্কি। প্রায় ২০০ লোকের পরে টার্মিনালের ভিতর ঢুকা গেল। ইমিগ্রেশনের সামনে জনিকে প্রতি পাসপোর্টের জন্য ২০০ টাকা (আসলে এত ভিড় আর ঈদের সময় ২০০ টাকাও কম হয়ে যায় মনে হয়) করে দিয়ে নু-ম্যান্স ল্যান্ডে ঢুকে পড়ি। ইন্ডিয়ান কাস্টমস আমার ক্রেডিট কার্ড দেখতে চাইলো, সাথে নগদ ডলার আছে কিনা, বাংলা টাকা আছে কিনা জানতে চাইলে আমি বলি সাত-আট হাজার বাংলা টাকা আছে আর কোন ডলার নেই। ইন্ডিয়ান সময় সকাল ০৬:৪৫ এর মধ্যে ইমিগ্রেশন শেষ করে ঢুকে পড়লাম। হালিম ভাইও চলে এসেছেন কিন্তু লিটন, রাকিব আর রাসেলের আসতে একটু দেরী হচ্ছে। পরে জানতে পারলাম রাকিবের সাথে থাকা ক্যামেরা পাসপোর্টে এন্ট্রি না থাকার কারনে ইন্ডিয়ান কাস্টমস ৫০০ টাকা খেয়েছে।
একটা মানি এক্সচেঞ্জে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম আর প্রয়োজনমত টাকা সবাই রুপি করে নিয়ে বনগাঁ রেলওয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম অটোতে করে। ১০০ টাকা থেকে রুপি রেট পেলাম ৮১.১ করে। অটো তে চললাম পরিচিত যশোরে রোড ধরে উদ্দেশ্য বনগাঁ রেলওয়ে স্টেশন, অটো ভাড়া ৩০ রুপি। বনগাঁ স্টেশনের প্লাটফর্মে গিয়ে লুচি, রুটি আর ভাজি দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। সবার খরচ ১৬৫ টাকা। ০৯:৫০ এর ট্রেনে উঠলাম একদম শেষ বগিতে নামবো দমদম ভাড়া ১৫ রুপি। আশা ছিল একটু দেরীতে ট্রেনে উঠলে হয়তোবা অফিস টাইমের ভিড় এড়ানো যাবে কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। ভিড় আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে চরম আকার ধারন করলো। আমার সামনে পুলিশে চাকুরী করেন একজন ভদ্রলোক দাঁড়ালেন। উনারা সবাই সামনের জামাই ষষ্টি নিয়ে মজা করছিলেন। বারাসাতের পরে অন্য একজন আমার সামনের লোকটাকে বলছিল তুমি ওদের বল উঠে যেতে, কিন্তু ভদ্রলোক বললেন থাক উনারা মেহমান। শুনতে অনেক ভাল লাগলো, সাধারণত বনগাঁ লোকালে এই কথাটা শোনা যায় না। আমার আর হালিম ভাই ছাড়া বাকি সবার বনগাঁ লোকালে এইটা তাদের প্রথম যাত্রা, আর প্রথমেই তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা।
দমদম নেমে মেট্রোতে করে পার্ক স্ট্রিট চলে গেলাম ১০ রুপি দিয়ে। কলকাতায় এত গরম যে, সূর্যের তাপের সাথে মাটি থেকে উঠে আসা ভাপ সেই গরম আরও দিগুন করে দিচ্ছিল। রাত ০৯:০০ পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ১০০০ রুপি দিয়ে একটা এসি রুম নিয়ে নিলাম। দুপুরের খাওয়া খরচ একেকজনের ১০০ রুপি। খাওয়া শেষ হোটেলের ছোট রুমে বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে বের হলাম। বিকেলে নিজেদের মত করে ঘুরাঘুরি আর নাস্তা করে নিলাম। চিকেন কাবাবের নাস্তাতে আমার আর হালিম ভাইয়ের খরচ ৪০ রুপি করে। ০৭:৩০ এর দিকে সবাইকে ফোন দিয়ে একত্রিত করে রাতের খাবারের জন্য চিকেন কাবাব আর চাউমিন নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। নামাজ শেষ করে হোটেলে বসে ডিনার শেষ করলাম। ফ্রেশ হয়ে হোটেল চেক আউট করে বাসে করে হাওড়া স্টেশনে পৌছালাম।
স্টেশনে ঢুকার আগে পরের দুই দিনে ট্রেনে খাওয়ার জন্য হালকা কিছু খাবার নিয়ে নিলাম যেমন- কলা, ব্রেড, চিড়া ভাজা, চানাচুর, সবার জন্য ২ লিটার করে পানির বোতল, ঘুমানোর জন্য হাওয়া বালিশ ইত্যাদি। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ব্যাগ রেখে এক এক করে সবাই ১০ রুপি করে দিয়ে গোসল করে নিলাম, কারন টানা ৪০ ঘণ্টার জার্নিতে গোসল করার কোন সুবিধা পাব না। বাকি সময়টা ওয়েটিং রুমে ছবি তুলে কাটালাম।
স্টেশনের বড় পর্দায় আমাদের ট্রেন কত নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে সেটা দেখে ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে পড়ি। ট্রেনে উঠার ঠিক আগে পাশের প্লাটফর্মে একটি ট্রেন মাত্র ছাড়ছিল ঠিক তখনই একজন মহিলা পা ফস্কে নিচের রেল লাইনে পড়ে যান, আল্লাহ মনে হয় নিজ হাতে মহিলাকে বাঁচিয়েছেন। মহিলা যদি একটু এদিক ওদিক নড়াচড়া করত তাহলে ট্রেনে কাটা পরতেন। বাচ্চাটাকে অন্য এক ব্যক্তি কোনমতে নিচে পড়া থেকে বাচিয়েছেলেন।
আমাদের বগি নাম্বার ছিল S7, খুজতে খুজতে ট্রেনের প্রায় শেষে চলে গেলাম। আমাদের টিকেট দুইবারে কাটা হয়েছিল বলে আমরা ৪ জন একসাথে আর বাকি ২ জন একই বগিতে অন্যজায়গায় ছিল। আমরা ৪ জন যেখানে ছিলাম সেইজায়গায় অন্য ২ জন লোককে অনুরোধ করলাম তারা যাতে রাসেল আর রাকিবের সিটে গিয়ে বসে আর ওরা দু’জন এখানে চলে আসবে। তারা রাজী হয়ে গেলে টিটি কে বলে সিট পরিবর্তন করে নিই। শরীর হালকা করে স্টেশন থেকে কেনা বালিশ ফুলিয়ে দিলাম এক ঘুম, এক ঘুমে সকাল।
১ম দিনের খরচঃ
ঢাকা থেকে বেনাপোল নন এসি বাসে ভাড়া- ৬৫০ টাকা
ইমিগ্রেশন করার জন্য দালালকে-২০০ টাকা
বর্ডার থেকে বনগাঁ অটো ভাড়া- ৩০ রুপি
বনগাঁতে নাস্তা-২৮ রুপি
বনগাঁ থেকে দমদম ট্রেন ভাড়া- ১৫ রুপি
দমদম থেকে পার্ক স্ট্রিট মেট্রো ভাড়া- ১০ রুপি
কলকাতায় হোটেল ভাড়া- ১৬৭ রুপি
দুপুরের খাবার- ১০২ রুপি
বিকালের নাস্তা- ৪০ রুপি
রাতের খাবার-৭১ রুপি
পার্ক স্ট্রিট থেকে হাওড়া বাস ভাড়া- ৭ রুপি
আইসক্রিম- ৪০ রুপি
হাওয়া বালিশ, ট্রেনে খাওয়ার জন্য খাবার কলা-রুটি- ১২১ রুপি জনপ্রতি
সারাদিনে পানি ও অন্যান্য- ৩৮ রুপি
স্টেশনে গোসল বাবদ-১০ রুপি
মোট- ৬৭৯ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা জনপ্রতি
২য় দিন:
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, ট্রেন তখন উড়িষ্যা দিয়ে যাচ্ছিল। গত বছর এই সময় বিহার হয়ে যখন যাচ্ছিলাম আশেপাশে কেমন যেন মরুভূমির মত শুকনা ছিল, কিন্তু উড়িষ্যার অবস্থা অনেকটাই ভিন্ন চারিপাশে ভালই সবুজ আছে। একটু পরপর ছোট ছোট পাহাড়ের সাড়ি। ট্রেন ভুবনেশশর স্টেশন আসলে স্টেশনের ঠাণ্ডা পানির কল থেকে বোতল ভরে নিলাম। নাস্তার জন্য পুড়ি, ডাল খরচ ৩৫ রুপি, সাথে নিজেদের সাথে আনা ব্রেড, কলা। ডালের স্বাদ এমন ছিল যে পুড়ি যদি আর একটু মচমচা হতো তাহলে এটা ফুচকা বলে চালান যেত।
দিন বাড়ার সাথে সাথে গরমও বাড়ছিল, নাস্তার কিছু পরে টেস্ট করার জন্য ডাবল আণ্ডা বিরিয়ানি খেলাম ৫০ রুপি দিয়ে। দুপুরে ১২০ রুপি দিয়ে ডিম, সবজি, রুটি, ডাল অর্ডার দিলাম, খেয়ে দেয়ে নামাজ পরে দিলাম ঘুম। তাছাড়া সারাদিন চা, কফি, চিড়া ভাজা, মুড়ি, চানাচুর ইত্যাদি খেয়ে খেয়ে সময় কাটিয়েছি। সারাদিন যে স্টেশন থেকে পেরেছি ঠাণ্ডা পানির বোতল ভরে নিয়েছি কখনো ফ্রি আর কখনো টাকা দিয়ে। সারাদিন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম রেল লাইনের আশেপাশে অথবা একটু দূরে সারাদিনই ছোট বড় পাহার ছিল। গরম লাগলেও প্রকৃতি দেখতে দেখতে কষ্টের কথাগুলো মনে পড়ছিল না। দুপুরের পরে ট্রেন অন্ধ প্রদেশ দিয়ে যাচ্ছিল।
রাতের খাবার সামনের স্টেশন থেকে কিনবো কিনবো করতে করতে শেষ পর্যন্ত আর খাবার পাই নাই। ভালই যে রাসেল একটা আণ্ডা বিরিয়ানি নিয়েছিল যা সবাই একটু করে টেস্ট করেছিলাম দাম ৮০ রুপি। তাই শেষ পর্যন্ত সারাদিনে মুড়ি-চানাচুর ওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে নেওয়া কাচা মরিচ, চিড়াভাজা-মুড়ি আর চানাচুর দিয়ে ডিনার করতে হল (বিদ্রঃ রেজাউল ভাইরে কাঁচা মরিচ ছাড়া কোন খাবারই ভাল লাগছিল না তাই যেভাবে পেরেছি কাঁচা মরিচ সংগ্রহ করেছিলাম)। শরীর হালকা করে দিলাম ঘুম, এক ঘুমে ফজরের ওয়াক্ত।
২য় দিনের খরচঃ
সকালের নাস্তা- ২০ রুপি
আণ্ডা বিরিয়ানি- ২৫ রুপি জনপ্রতি
দুপুরের খাবার- ১২০ রুপি
ট্রেনে চা, পানি, ঝাল মুড়ি ইত্যাদি- ১৩০ রুপি
নতুন একটা বালিশঃ ৯ রুপি জনপ্রতি (রাসেলের টা ভাল ছিল না তাই)
মোট- ৩০৪ রুপি
আগের দিনের খরচ ৬৭৯ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা।
২ দিনের মোট খরচঃ ৯৮৩ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা
২য় পর্বের লিঙ্ক নিচে
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৩৪