Click This Link

৩য় দিনঃ
ফজরের নামাজ পড়ে জানালা দিয়ে অন্ধপ্রদেশের ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। সকালের শুরু এক কাপ কফি দিয়ে। সম্পূর্ণ ট্যুরে আমাদের একটাই আফসোস যে ভুবনেশ্বর আর কলকাতা ছাড়া আর কোথাও লাল চা পেলাম না। রাতে ডিনার ভাল না হওয়াতে ক্ষুধা তখন চরমে। হোসাপেট জাংশনে ট্রেন থামলে আমি জানালা দিয়ে এক পুড়িওয়ালাকে ১৮ পিসের অর্ডার দিলাম। লিটনকে পাঠালাম বিল দিতে কারন পুরো ট্যুরে ও আমাদের ক্যাশিয়ার ছিল। পুড়িওয়ালার সহকারী জানালা দিয়ে আমাদের হাতে পুড়ি পৌছিয়ে দিল আর আবার চলে গেল ভাজি আনতে। এতক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিল, লোকটা পেছনে পেছনে দৌড়ে আমাদের হাতে ভাজি দিয়ে গেল। ঐদিকে লিটন তখনো বিল দিচ্ছিল, আর আমরা ওকে ট্রেনে উঠার জন্য চিল্লাছিলাম। কোনমতে ও ট্রেনে উঠেছিল অন্য একটা বগিতে।


লিটন এসে বলল নাস্তার বিল ৫৪০ রুপি, শুনে তো আমাদের মাথায় হাত। পরে হিসাব করে দেখি আমি যে ১৮ পিসের অর্ডার দিয়েছিলাম ঐটা আসলে ৩০ টাকা করে ১৮ সেটের অর্ডার দিয়েছিলাম। মানে ১৮ জনের খাবার এখন ৬ জনে খেতে হবে। ট্রেন ছেড়ে দিবে বলে লোকটা চালাকি করে আমাদের ভাজিও কম দিয়েছিল। কি আর করা খাওয়া শুরু, ৩ টার জায়গায় ০৬ টা করেও শেষ করা যায় নাই। কিছুক্ষণ পরে হকাররা ইটলি, ধোসা ইত্যাদি সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার নিয়ে ট্রেনে উঠলো। লিটন প্রথমে ২টা ইটলি নিল, টেস্ট করার আগেই বললাম খেতে পারবি না নিস না এই খাবার আমাদের ভাল লাগবে না। পাশের এক বাঙ্গালী দাদা বলল নিয়ে নিন দাদা খুব ভাল। কে শুনে কার কথা ও শালা টেস্ট না করেই আরও একটা নিয়ে নিল। শেষ পর্যন্ত একটু টেস্ট করে আর খেতে পারলো না।
আজ গরম নেই বললেই চলে, বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। ট্রেনে দুপুরের খাবারের অর্ডার নিতে এলো। লোকটা বারবারই আমাদের চিকেন বিরিয়ানি নেওয়ার জন্য বলছিল। আমরা চিকেন হালাল হবে কিনা সেই ব্যাপারে আলোচনা করছিলাম। লোকটা বলল হালাল হবে আপনারা নিশ্চিন্তে নিতে পারেন, আমার নাম ইমরান (প্রমান স্বরূপ সে তার আইডি কার্ড দেখালেন), তাছাড়া যেখান থেকে খাবার দেওয়া হবে সেটা মুসলিম এলাকা। তাই আর ২য় বার চিন্তা না করে ৬ টার অর্ডার দিয়ে দিলাম।

বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু কিছুটা দূরে পাহারগুলোতে রোদ মেঘের যে খেলা চলছিল তা এক কথায় অপূর্ব। সকালের যে সময়টা বাইরে দেখছিলাম এই সময়টাতে যদি আমরা বিহার কিংবা উত্তর প্রদেশ থাকতাম অনেক মানুষকেই দেখতে পেতাম যে তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। ঐ তুলনায় তেমন কাওকে দেখি নাই। সকাল ১১:০০ টার দিকে হুবলি থেকে আমাদের চিকেন বিরিয়ানি অর্ডার মত পৌঁছে দিল। মোট দাম ৭২০ টাকা (১২০ টাকা জন প্রতি)।
দুপুর ১২:০০ টার দিকে লাঞ্চ করে নিলাম বিরিয়ানি দিয়ে। আমাদের দেশের বিরিয়ানির স্বাদ আর এই বিরিয়ানির স্বাদ আকাশ পাতাল তফাৎ, তবে কলকাতায় বা আজমিরে যে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম তার থেকে অনেক ভাল ছিল। আমাদের দেশের বিরিয়ানির ঘ্রান নিলেই মন ভরে যায়, আর এই বিরিয়ানি খেলে আপনার পেট ভরবে ঠিকই কিন্তু মন ভরবে না। কিছু সময় পর আমাদের খাবার সরবরাহকারী ইমরান ভাইকে কল করলাম আমাদের কাছে আসতে, উদ্দেশ্য দুধ সাগর ফলসে যাওয়ার ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারবে কি না? ফোন পেয়ে বেচেরা ভাবল খাবারে কোন সমস্যা আছে কি না সেজন্য হয়ত ফোন করেছি। ইমরান ভাই জানালেন দুধ সাগর ফলস জুন মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বর্ষা কালের জন্য সরকারিভাবে বন্ধ থাকে, গেলে সমস্যা হতে পারে। বাকি সময়টা অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ক্যাসেল রক স্টেশনে আসবে। কারন ক্যাসেল রক হচ্ছে অন্ধপ্রদেশের শেষ স্টেশন, এর ১২-১৩ কিলোমিটার পরেই দুধ সাগর ফলস, যা অন্ধপ্রদেশ আর গোয়ার বর্ডারে অবস্থিত (মূলত দুধ সাগর ফলস গোয়াতেই অবস্থিত)।

নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৪০ মিনিট পরে ১২ টার সময় ক্যাসেল রক স্টেশনে পৌঁছাই। সেখান থেকে ট্রেনে একটা বাড়তি ইঞ্জিন লাগানো হয় কারন ট্রেন এখন পাহাড়ের উপর উঠবে তাই বাড়তি শক্তি দরকার। সব মিলিয়ে ১ ঘণ্টা লেটে ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। এখন আমাদের পালা সব ব্যাগে তালা দিয়ে যার যার পজিশন নিয়ে নেয়া সেই কাঙ্খিত দুধ সাগর ফলস দেখতে (কারন ট্রেন কিছু অন্ধকার টানেল দিয়ে যাবে তখন ব্যাগ চুরি হওয়ার সম্ভবনা থাকে, আর বাতিও জ্বালিয়ে দিলাম)।



আমাদের মধ্যে ৩ জন দরজায় আর বাকি ৩ জন আমাদের পাশের জরুরী বের হওয়ার জানালার গ্রিল উপড়ে তুলে দুধ সাগর ফলস দেখার জন্য অবস্থান নিলাম। আমরা জানতাম যে দুধ সাগর ফলসের কাছের ভিউ প্রথমে বাম পাশ থেকে দেখা যাবে। শুরু হল গভীর অরণ্যের মাঝে আঁকাবাঁকা রেল পথ আর ছোট বড় টানেলর মধ্য দিয়ে ছুটে চলা। প্রায় চল্লিশ মিনিট চলার পর ট্রেন দুধ সাগর ষ্টেশনে থামল। এটা বড় কোন স্টেশন না, লাইন ক্লিয়ার আছে কিনা হয়তো এই কারনেই ট্রেন এখানে থামে। পাঁচ মিনিট পরে আবার চলা শুরু করে আমাদের ট্রেন। ২-৩ মিনিট পরে ফলসের কয়েকশ ফিট আগে দুধ সাগর ফলসের উপরের অংশ চোখে পড়ে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা দুধ সাগর ফলসের সামনে যা এত দিন শুধু টিভিতেই দেখে এসেছি। ৪-৫ সেকেন্ডের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেল কিন্তু মনের ভিতর দাগ কেটে গেল সাড়া জীবনের জন্য। মনে হল সারাদিন দুধ সাগর ফলসের সামনে বসে থাকলেও এ সৌন্দর্য দেখে মন ভরবে না। এই সৌন্দর্য দেখার রেষ কাটতে না কাটতেই আবার ডান পাশে চলে গেলাম দুধ সাগর ফলসের দূরের ভিউ দেখতে যা আসলেই মনোমুগ্ধকর।


দুধ সাগর ফলসের মোটামুটি ১ কিলোমিটার পরে ট্রেন আবার থামালো, এই সৌন্দর্য খুব কাছে থেকে দেখার জন্য সবাইকে বললাম চলেন নেমে যাই আবার গিয়ে দুধ সাগর ফলস দেখে আসি। আমরা ৪ জন ব্যাগ নিয়ে তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু রেজাউল ভাই সেই কুলেম পর্যন্ত রেল লাইন ধরে ১২ কিলোমিটার হাটতে চাইলেন না আর হালিম ভাইও তার ভারী ব্যাগ নিয়ে ঝুকি নিতে চাইলেন না। কি আর করা ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো, মনে মনে ভাবতে লাগলাম জীবনে আর হয়তো কখনও দুধ সাগর ফলসের সামনে গিয়ে সময় কাটানো হবে না। কিছু সময় পরে শুরু হল হালকা বৃষ্টি তারপর তা চরম আকারে। সবাই বললাম আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন। মজার বিষয় হল লিটন আর রাকিব (আরও একজন নাম বলা যাবে না, তাহলে চাকরী থাকবে না) তখনো দুধ আর সাগর মিলাতে পারছিল না। ওরা ভাবছিল দুধের মত কোন সাগর হবে!!!!
ট্রেন প্রায় দেড় ঘণ্টা লেটে বিকাল ০৪:২০ এ ভাসকো দা গামা পৌঁছায়। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, মনটা খারাপ হয়ে গেল যখন শুনালাম গত তিনদিন ধরে এভাবেই বৃষ্টি হচ্ছে। নিজের উপর খুব গোস্বা হচ্ছিল, কে আমাকে বলছিল যে এই সময় গোয়া ট্যুর প্লান করতে!! হালিম ভাই অনলাইনে যোগাযোগ করেছিলেন বাংলাদেশে থাকতেই যারা কিনা গোয়া ট্যুর অপারেট করেন এমন একজনকে ফোন দিলেন একটা গাড়ি দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতে। এছাড়া কোন উপায়ও ছিল না, বৃষ্টি এত হচ্ছিল যে বাইরে গিয়ে আমরা কোন গাড়ি ঠিক করতে পারতাম না। গাড়ির ড্রাইভার আমাদের এসে ফোন দিলে আমরা গাড়িতে উঠে পড়ি, এরই মধ্যে অর্ধেক ভিজা শেষ।
সেই ট্যুর অপারেটরদের কাছে গেলে হালিম ভাই তার বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি ভাড়া করতে চাইলে তারা অপারগতা প্রকাশ করেন, ইন্টারন্যাশনাল লাইসেন্স লাগবে। আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা নর্থ গোয়াতে চলে যাব। বৃষ্টিতে ভিজে আমি গাড়ি ঠিক করতে গেলাম। একটা গাড়ি ঠিক করলাম ১৩০০ রুপিতে কিন্তু তারা হোটেল খোজার জন্য সময় দিবে না, তাই হালিম ভাই বললেন বাদ দিতে। তার বদলে ১৪০০ রুপি দিয়ে সেই ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে একটা Innova নিয়ে নিলাম দূরত্ব ৩৮ কিলোমিটার।
রাস্তায় জ্যাম থাকার কারনে ড্রাইভার অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন। ড্রাইভারের নাম বিষ্ণু, বাংলাদেশের ক্রিকেট ভালই ফলো করেন, বাংলাদেশের মাশরাফির খেলা পছন্দ করেন। সন্ধার একটু আগে আমাদের চাহিদা মত ক্যালাংগুট বিচের একবারে পাশে একটা হোটেলে নিয়ে গাড়ি থামালেন। বৃষ্টি আরও দিগুন পরিমান হচ্ছিল। বাকিদের গাড়িতে বসিয়ে রেখে আমি আর হালিম ভাই হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বললাম ভাড়া চাইলো ১৫০০ রুপি প্রতি রুম। আমাদের ২ রুম লাগবে। ভাড়া বেশি মনে হল, আমরা ৮০০ বললাম। ওদিকে ড্রাইভার আমাদের তাড়া দিচ্ছিল যে তার ট্রিপ আছে। আমরা বললাম ঠিক আছে আমাদের অন্য একটা হোটেলে নিয়ে চলুন, ড্রাইভার বললেন অন্য হোটেলে শুধু নামিয়ে দিয়ে চলে আসবো তারপর আপনাদের তা আপনারা বুঝবেন। কি আর করা শেষ পর্যন্ত ১০০০ রুপিতে মিটিয়ে রুমে গিয়ে উঠলাম। রাতে আমি আর লিটন হোটেল ম্যানেজারের গাড়িতে করে সুপার শপে গিয়ে সাবান আর শ্যাম্পু নিয়ে আসলাম। আমাদের দেশের সুপার শপের সাথে পার্থক্য দেখলাম যে, বিশাল একটা এরিয়া জুড়ে দেশি বিদেশি মদ, বিয়ার, দামও অনেক কম। বুঝলাম মানুষ গোয়া কেন আসে, প্রকৃতি দেখা বাদে বাকি কিছু আমার জন্য না। এই ফাকে হোটেল ম্যানেজারের সাথে পরিচয় পর্বটা সেরে নিলাম। ভদ্রলোকের নাম মোঃ আলী, বিহারের। উনি যে মুসলিম আমি বিশ্বাস করি নাই দেখে আইডি কার্ড দেখালেন।
রাতে খাবারের জন্য আলী ভাইয়ের পরিচিত হোটেল থেকে চিকেন মাসালা আর রুটি আনালাম কারন বাইরে তখনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। আলী ভাই একটা কথা বলেছিলেন ৩ দিন টানা বৃষ্টি হচ্ছে দেখো কাল বৃষ্টি হবে না। আমরা আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। মনে মনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল এই ভেবে সবাইকে নিয়ে আসলাম আর না ঘুরে হয়তো চলে যেতে হবে। হালিম ভাই বলছিল কাল যদি দুপুর পর্যন্ত এইভাবেই বৃষ্টি হয় তবে ভাসকো দা গামা গিয়ে বাসের টিকেট করে মুম্বাই চলে যাব, আমিও রাজী হলাম যদি না কিছুই করার থাকে তবে এখানে বসে বৃষ্টি দেখার কোন মানে হয় না। আমরা যে রুমে ছিলাম ঐ রুমে এসির লাইন দিয়ে পানি ঢুকছিল, তাই আলী ভাই আমাদের রুম পরিবর্তন করে দেন। নতুন রুমে গিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে ঘুমিয়ে পড়লাম একটা ভাল সকালের অপেক্ষায়।
৩য় দিনের খরচঃ
সকালের নাস্তা- ১০০ রুপি (ইটলি সহ)
দুপুরের খাবার- ১২০ রুপি জনপ্রতি
ট্রেনে চা, পানি- ৩১ রুপি জনপ্রতি
গাড়ি ভাড়া ভাসকো দা গামা থেকে ক্যালাংগুট বিচ-২৩৪ রুপি জনপ্রতি
ডিনার-১১০ রুপি (পানি সহ) জনপ্রতি
সাবান এবং শ্যাম্পু- ৫ রুপি জনপ্রতি
হোটেল ভাড়াঃ ৩৩৪ রুপি জনপ্রতি
মোট- ৯৩৯ রুপি জনপ্রতি
আগের ২ দিনের খরচঃ ৯৮৩ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা জনপ্রতি
৩ দিনের মোট খরচঃ ১৯২২ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা জনপ্রতি
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



