স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ঈদ উৎসবে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে টেলিভিশনে প্রচারিত ঈদ অনুষ্ঠানমালা। কিন্তু আশি-নব্বইয়ের দশকে একমাত্র বিটিভি ভিত্তিক ঈদে বিনোদনের নিমিত্তে নির্মিত অনুষ্ঠানমালায় যে আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল, ছিল যে সন্মোহনী জাদুর খেলা; তা আজকের ২০/২২টি টেলিভিশন চ্যানেল মিলে কোটি কোটি টাকার বাজেট নিয়েও স্পর্শ করতে পারছে না। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটি এখন প্রতি ঈদের শেষেই আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ থেকে দেড়-দুই দশক আগে, যখন প্রযুক্তিগত এতো উৎকর্ষতা ছিল না, ছিল না এতো সুযোগ-সুবিধা, এফডিসি’র ফ্লোরে সেট তৈরি করে নির্মিত হত অনুষ্ঠানমালা, তা কীভাবে দর্শক হৃদয় ছুঁয়ে যেত? অনেকে বলবেন, “তখন টিভি চ্যানেল ছিল একটা, তাই বাধ্য হয়ে যা দেখাতো তাই দেখতাম”। তর্কের খাতিরে কিছুটা না হয় সত্য বলে ধরে নিলাম। কিন্তু মান আর গুণগত বিচারে আজকের নির্মিত অনুষ্ঠানমালা কি আসলেই সেই সময়কার উচ্চতায় পৌঁছতে পারছে? উত্তর সর্বসম্মতিক্রমে একটাই আসবে, “না”।
আগে বিটিভি’র ঈদ অনুষ্ঠানমালায় খুব বেশী কিছু কি ছিল? আমজাদ হোসেন বা হুমায়ুন আহমেদ এর নাটক, ঈদ আনন্দমেলা, ঈদের বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান ছায়াছন্দ এইতো! কিন্তু কি অধীর আগ্রহে মানুষ এই অনুষ্ঠানগুলো দেখতো, কল্পনা করা যায়? আর আজকে এতো এতো চ্যানেল, সেখানে ৫-৮ দিন পর্যন্ত চলে ঈদের বিশেষ আয়োজন, কিন্তু রিমোট চেপে চেপে হাত ক্লান্ত, ক্লান্ত দুটি চোখ, তাও যদি মেলে তেমন কিছু! প্রতিটি চ্যানেলে কোটি টাকার ঘরে বাজেট রাখা হয় ঈদ অনুষ্ঠানমালা’র জন্য, কিন্তু ফলাফল কি? টিভি চ্যানেলের কর্তা ব্যাক্তিরা ভালো জানেন।
এবার ঈদের চতুর্থদিনে (যতদূর মনে পরে) ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে একটা টকশো’তে উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার, নির্মাতা, ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্র খ্যাত গিয়াসউদ্দিন সেলিম, প্রবীণ অভিনেতা আবুল হায়াত এবং আরটিভি’র অনুষ্ঠান পরিচালনা বিভাগের নির্বাহী (নাম মনে পরছে না) তো এই টকশো’তে আরটিভি’র ঐ নির্বাহীর কথা হতে স্পষ্টতর হয়ে যে বিষয়টি ফুটে উঠলো, ভালো বাজেট বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও তারা ভালো মানের অনুষ্ঠান পাচ্ছেন না। কারণ, অন্তঃসার শুন্য, মেধাহীনে ভরে গেছে টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রটি, যার প্রমাণ ঈদের সামগ্রিক অনুষ্ঠানমালা। ঈদ হচ্ছে দেশীয় চ্যানেলগুলোর জন্য সর্বাধিক টিআরপি প্রাপ্তির সময়, সেই সময়ের অনুষ্ঠানগুলো দেখলেই বুঝতে পারা যায়, কেন দর্শক দেশীয় চ্যানেল না দেখে বিদেশী চ্যানেলের প্রতি ঝুঁকছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, বাংলাদেশে এখন দুই ধরনের চ্যানেল রয়েছে, সংবাদভিত্তিক এবং বিনোদনমূলক। কিন্তু সবাই জানি, এই বিনোদনমূলক চ্যানেলগুলো আদতে পরিণত হয়েছে সংবাদভিত্তিক চ্যানেলে। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর, সাথে রয়েছে সার্বক্ষণিক স্ক্রলে নিউজ। এর ফাঁকে ফাঁকে যা দেখানো যায় আর কি...
প্রতি ঈদে সব বিনোদন চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠানমালায় একটি অদৃশ্য সামঞ্জস্য থাকে। সকালবেলা বাংলা ছায়াছবি, দুপুরের খবরের পর টেলিফিল্ম, সন্ধ্যা’র পর হতে ধারাবাহিক নাটক, রাতে নাটক, এবং দশটার পর খবরের শেষে লাইভ স্টুডিও কনসার্ট। এবারো তার ব্যাতিক্রম ছিল না খুব একটা। এবার ঈদে কোথাও বেড়াতে না গিয়ে বসেছিলাম টেলিভিশন সেটের সামনে। রিমোট চেপে চেপে ঘুরেছি চ্যানেল থেকে চ্যানেলে। দুয়েকটি বাদে প্রায় সবকয়টি অনুষ্ঠানই হতাশ করেছে। আসুন কয়েকটি পর্যালোচনা করি।
ঈদের নাটক আর টেলিফিল্ম হল বর্তমানে ঈদের প্রধান অনুষ্ঠানমালা, এরপরেই রয়েছে লাইভ স্টুডিও কনসার্ট। যদিও এর বাইরে বলার মত আর কিছু দেখতে পাই নাই। নাটক আর টেলিফিল্ম দুটোতেই ভালো স্ক্রিপ্টের অভাব প্রকটভাবে চোখে পড়েছে। ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের টকশো’তে আরটিভি’র নির্বাহী ভদ্রলোকও সেই কথাই বললেন। গিয়াসউদ্দিন সেলিম সাহেব যখন সরাসরি মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী’র ভাই-বেরাদার গ্রুপকে ব্যাঙ্গ করে কিছু কথা বললেন, ঠিক তখন আরটিভি’র ঐ ভদ্রলোক জায়গা মত হাত দিলেন। গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মত সকল নাট্যকার এখন নিজেই পরিচালক, ভালো স্ক্রিপ্ট নিজের জন্য লিখে রেখে দিচ্ছেন, তখন রদ্দি মার্কা স্ক্রিপ্টে বাজার সয়লাবতো হবেই। সাগর জাহান, এজাজ মুন্না, সকাল আহমেদ, চয়নিকা চৌধুরী প্রমুখদের নাম ধরেই ভদ্রলোক বললেন, ঈদে সব চ্যানেল মিলে প্রায় তিনশত নাটক-টেলিফিল্ম নির্মাণ হয়েছে। দুই ঈদে প্রায় ছয়শত। চার/পাঁচ মাস সময়ে এই ছয়শত নির্মাণ কাজের জন্য ভালো মানসম্মত স্ক্রিপ্ট পেতে কমপক্ষে শ’খানেক নাট্যকারতো প্রয়োজন। কিন্তু আদতেই কি তা আছে?
প্রথম যখন প্যাকেজ নাটক নির্মাণ শুরু হল, তখন নির্মাতাদের বিজ্ঞাপন যোগাড় করে নাটক টেলিভিশনে জমা দিতে হত। কিন্তু নাটকের মান দিনদিন পড়তির দিকে থাকায়, একসময় টিভি চ্যানেলগুলো তাদের এয়ারটাইম কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে নাটক কিনে নেয়া শুরু করে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের এটা করতে হয়, নাহলে ব্যাবসা করা যে দায় হয়ে যায়। তো ঈদে সেই এয়ার টাইমে মানসম্মত অনুষ্ঠান না পেলে তখন আর কি করা? যা হাতের কাছে পেলাম, তাই চালিয়ে দিলাম। এবারের ঈদের প্রতিটি নাটক বা টেলিফিল্মে স্ক্রিপ্ট দুর্বলতার পরপরই যে জিনিষটা চোখে পড়েছে তা হল নির্মাণে যত্নের অভাব। স্বল্পসময়ে, তাড়াহুড়ো করে যেনতেন একটা নির্মাণ করতে পারলেই বাঁচা যায়, এমন একটা ভাব। অনেক সিনিয়র শক্তিশালী অভিনেতা/অভিনেত্রীদের পর্যন্ত অভিনয় দেখে অবাক হয়েছি, আমার মত একজন সাধারন দর্শকের চোখেও ঐ দুর্বলতাটুকু প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। আরেকটা বিষয়, বেশীরভাগ নাটক বা টেলিফিল্মে’র কাহিনীতে পরকীয়া, অবৈধ সম্পর্ক এই বিষয়টা উপজীব্য ছিল, প্রশ্ন হল এগুলো সমাজে কিসের লক্ষণ বলে ধরে নেয়া যায়?
এবার ঈদে যে নাটক বা টেলিফিল্ম সবচেয়ে সেরা ছিল, তা নিয়ে কিছু বলবো না, সেটা নিয়ে আলাদা একটা লেখা লিখবো খুব শীঘ্রই। ভালো কিছু নাটক বা টেলিফিল্মের কথা বলতে গেলে যে নামগুলো মনে পড়ছেঃ তাহসান অভিনীত তিনটি নাটক “হি এন্ড শী”, “লাভ এন্ড ওয়ার” এবং “রিটার্ন”, ইরেশ যাকের এবং সুমাইয়া শিমু অভিনীত “সাদাকালো”, মিথিলা এবং জন (ব্যান্ড ব্ল্যাক এর ভোকালিস্ট) অভিনীত “এংরি স্টোরি”, তারিন-পার্থ বড়ুয়ার “অপরাহ্ণ” এবং “তাহার কাছে, তার কাছে”, জিটিভি’তে প্রচারিত তারিক আনাম খান এবং সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনীত একটি নাটক(গাজী টেলিভিশন) যেখানে তারিক আনামের ছেলের বান্ধবী তারিক আনামের প্রেমে পড়ে (পুরাই লুল, বাট নাইস মেকিং); মানবিক আবেদন নিয়ে মাহমুদ দিদারের রচনা ও পরিচালনায় ‘মেঘবতীর জন্যে’; নারী স্বাধীনতা নিয়ে ভিন্নধর্মী নাটক ‘সাধারণ জ্ঞান’, পলাশ মাহবুবের লেখায় এটি পরিচালনা করেছেন হাসান মোরশেদ। এর বাইরেও কিছু নাটক হয়ত ছিল কিন্তু আমার ভাল লাগে নাই অথবা দেখা হয় নাই। ছিল ক্যান্সার রোগী নিয়ে ছোট্ট প্লটে মিষ্টি নির্মাণ, মিশু এবং চিত্র নায়িকা মৌসুমি অভিনীত একটা নাটক, নাম মনে পড়ছে না।
ধারাবাহিক নাটকগুলো সবকয়টা ছিল বিরক্তি উদ্রেকের জন্য যথেষ্ট। “সিকান্দার বক্স বান্দরবান” নাটকে রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতু চলে আসলো, পুরাই লুলরে ভাই। নানান ভাঁড়ামো নিয়ে নানান ধারাবাহিক, কোনটা রেখে কোনটা বলি? আরেকটা বিষয়, সেই একবার ‘আরমান ভাই’ নাটক হিট হল, এরপর প্রতি ঈদে ঢাকাইয়া ভাষায় নাটক নির্মাণ করতে হবেই। এবার ছিল বিপাশা হায়াত এবং আবুল কালাম আজাদ অভিনীত ‘আজমেরি বেগম’। কনসেপ্ট আর স্ক্রিপ্টের দৈন্য’র সাথে ম্যাগির দুই মিনিটে নুডুলস তৈরির মত নির্মাণে পুরো লগ্নিকৃত অর্থই জলে গেছে বেশীরভাগ নির্মাণে। কিছু কিছু আবার ব্যাতিক্রম আছে, ভালো স্ক্রিপ্ট পেয়েও ব্যর্থ নির্মাণ।
সিনেমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চ্যানেল আই’য়ে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস অবলম্বনে নায়ক রাজ রাজ্জাকের ‘আয়না কাহিনী’। আলোচিত টকশো ‘ফেস টু ফেস – অনন্ত জলিল’, সপ্তাহব্যাপী আয়োজন পুরাই ফ্লপ, তবে মজা পাইছি যেদিন ফরিদুর রেজা সাগর আর আনিসুল হক গেস্ট ছিল, সেদিনের’টায়। লাইভ কনসার্ট প্রথম যখন ২০০৭ সালে ইটিভি চালু করল, খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু লেবু বেশী কচকালে তিতা হয়ে যায়, এখন হয়েছে তাই। কলকাতার ব্যান্ড দল এনেও দর্শক পাচ্ছে না। লাইভ কনসার্ট নিয়ে মজার কথা বলি, ঈদের পঞ্চম দিন যতদূর মনে পড়ে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর গান নিয়ে দুপুরের লাইভ অনুষ্ঠান দেশ টিভি’তে। শিল্পি ঝুমা খন্দকার বারবার ভুল সুরে, বিকৃত সুরে গেয়ে চলেছেন গানগুলো, এমন সময় প্রবাস হতে এক দর্শকের ফোন, একটু ভুমিকা করে মুখের উপর এই সত্য কথা বলা শুরু করতেই প্রডিউসার ফোন লাইন কেটে দিয়ে শিল্পীকে উদ্ধার করলেন। এছাড়া অপি করিমের উপস্থাপনায় সঙ্গীত শিল্পী মমতাজের সাক্ষাৎকার, শিল্পী দম্পতি রুনা লায়লা এবং আলমগীরের সাক্ষাৎকার ভালো ছিল। ছিল মুনমুনের উপস্থাপনায় ফারুকী-তিশা দম্পতি এবং সাকিব-আল হাসান ও তার স্ত্রী’র সাক্ষাৎকার মোটামুটি মানের। আর মাছরাঙ্গা চ্যানেলে প্রচারিত মুস্তফা মনোয়ার এর পাপেট শো প্রশংসার দাবী রাখে।
এই যে এতোগুলো অনুষ্ঠানের কথা বললাম, কোনটাই কিন্তু এ-প্লাস ছিল না, তারপরও এগুলো মন্দের ভালো। প্রতি ঈদে কয়েক কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত অনুষ্ঠান যখন দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়, তখন সাধারন সময়ে কীভাবে দর্শক আশা করা যায় দেশীয় চ্যানেলগুলোতে? আর তখন কোরাস গাওয়া কি উচিত, বিজাতীয় সংস্কৃতিতে ভরে গেল দেশ বলে? উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের যুগে আপনি কি দর্শক ধরে রাখতে পারবেন দেশীয় গণ্ডিতে এসব ছাইপাশ নির্মাণ করে? এগুলো থেকে উত্তরনের পথ সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে, আমরা দর্শক হিসেবে অপেক্ষায় রইলাম ভালো কিছুর আশায়। আশা করি আমার লেখার শিরোনাম মিথ্যা প্রমানিত হবে অদূর ভবিষ্যতেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:৪৯