somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালবাসা'র তৃতীয়জনা (ছোটগল্প)

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার মুখোমুখি বসে থাকা এই বয়স চল্লিশের মেয়েটির শ্যামবর্ণ পানপাতা গড়নের মুখের উপর কৃষ্ণবর্ণ সিল্কি চুলের খেলায় হঠাত করেই চোখ পড়ল, কাকতালীয়ভাবে আমার হেডফোনে বাজছে পার্থ বড়ুয়া’র গান... “দক্ষিণা হাওয়া ঐ তোমার চুলে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় এলোমেলো করে। কয়েকটি চুলে ঢেকে যায়, তোমার একটি চোখ”।

নয়দিনের সলো ট্যুর দিয়ে ফিরছি কর্ণাটক হতে, বেঙ্গালুরু থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে সকালবেলা রওনা দিয়ে দুপুরে পৌঁছেছি কলকাতা, ঘন্টা পাঁচেকের ট্রানজিট। ট্যুরের মাঝখানে মেসেঞ্জারে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর ম্যাসেজ পেলাম, তার এক বছর বয়সী ছেলের জন্য কিছু জিনিষ কিনে আনার অনুরোধ মাখা। আমার এই ভ্রমণে কলকাতা ছিল শুধু ট্রানজিট এয়ারপোর্ট হিসেবে, কিন্তু বন্ধুর অনুরোধ বলে কথা। লাগেজ যেহেতু চেকইন করে দিয়েছি, ভাবলাম যাই একটু কলকাতা শহরে, সময়ও কাটবে, বন্ধুর অনুরোধও রাখা হবে। আর যেহেতু সময় কাটাতে যাচ্ছি, তাই ট্যাক্সি না নিয়ে বিমানবন্দরের কাছ হতে এসি বাসে করে এই প্রাচীন শহরের ব্যস্তময় রূপ আরেকবার না হয় দেখতে দেখতে চলে যাওয়া যাক। বিমানবন্দর হতে বের হয়ে বাসের কাছে গিয়ে দেখি, পুরো বাস ফাঁকা, আগের বাসটি মিনিট পাঁচেক আগেই ছেড়ে গেছে। আমি বাসে উঠে পছন্দ মাফিক একটি সিটের দুটি আসন দখল করে বসে পড়লাম। এরপর এক এক করে ধীরে ধীরে বাস ভরে উঠতে লাগল।

মিনিট দশেকের মাথায় আমার বিপরীত দিকের সিট দুটি দখল করে মেয়েটি আসন গাড়ল। সাথে একটি লাগেজ আর একটি একটু বড় সাইজের হ্যান্ডব্যাগ। লাগেজটি কোথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছিল না দেখে আমি ইশারা করে জানালার পাশে আমার পায়ের কাছের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে হিন্দিতে বললাম, “ইধার রাখখিয়ে”। গত নয়দিনে কর্ণাটকে থেকে সব কথায় হিন্দি বলার অভ্যেস হয়ে গেছে, যদিও সেখানে অনেক কম মানুষই হিন্দি বুঝে, কন্নড় ভাষায় সবাই কথা বলে।

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, জানালার কাঁচের গা বেয়ে কেমন বিষণ্ণ অলসভাবে ফোঁটায় ফোঁটায় বয়ে নীচের দিকে নামছে। হালকা ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাঁচের ভেতর দিয়ে বৃষ্টিস্নাত কলকাতা আদিমতা খুঁজতে মগ্ন যখন কানে লাগানো হেডফোনের গানে, হঠাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় মিনিট পঞ্চাশ পেড়িয়ে গেছে, মনে হল সময়ের ঝামেলায় না আবার ফ্লাইট মিস করি। তখন সামনের মেয়ের (মেয়ে বলা যায় কি না, জানি না, ভদ্রমহিলা বলাই শ্রেয়, বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি হবে। কত বছর বয়স হলে, মেয়েদের মহিলা বলা যায়, তা আজো নির্ধারিত হয়েছে কি না জানা নেই)দিকে তাকিয়ে ভাবছি জিজ্ঞাসা করি, ‘এসপ্লানেড পৌঁছতে আর কত সময় লাগবে?’। মজার ব্যাপার হল ঠিক তখনই উনি হ্যান্ডব্যাগ খুলতে খুলতে আমাকে জিজ্ঞাসা করল,

- “আর কতক্ষণ লাগতে পারে ধর্মতলা পৌঁছতে?”।

- “বলতে পারছি না, আসলে আমি এখানে থাকি না তো...”

- “ও... কোথায় আপনার বাড়ি? শিলিগুড়ি?”

- “নাহ, বাংলাদেশ। বেড়াতে এসেছিলাম...”

- “এসেছিলেন মানে এখন কোথায় যাচ্ছেন তাহলে?” উনি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

- “একটু কলকাতা শহরে যাচ্ছি, সন্ধ্যের পর ঢাকার ফ্লাইট, তাই কিছু কেনাকাটা করতে নিউমার্কেট যাচ্ছি”
এরপর ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ খুলে একটা লাঞ্চ বক্স বের করে ভেজিটেবল রাইস চামচ দিয়ে খুব যত্ন করে খেতে লাগলেন, দুপুরের খাবার। কিছুক্ষণ পর ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কোথায় থাকেন?”

- “বহরমপুর।”

- “ও, কোথায় গিয়েছিলেন বুঝি?”

- “হ্যাঁ, ব্যাঙ্গালুরু থেকে আসলাম।” মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন।

- “বাহ, আমিও ব্যাঙ্গালুরু থেকেই আসলাম। কোন ফ্লাইট?”

- “জেট এয়ার। আপনার?”

- “এয়ার ইন্ডিয়া”

এরপর আর কথা চালিয়ে নেয়ার জন্য কথা খুঁজে পেলাম না। যদিও কেন জানি ইচ্ছে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে কথা চালিয়ে যেতে। আবার জলেভেজা কাঁচের আড়াল ভেদ করে দেখতে লাগলাম ব্যস্ত কলকাতার রাজপথ, কানে বাজছে অন্তহীন ছবির গান, “যাও পাখি বল, হাওয়া ছলছল, আবছায়া জানালার কাঁচ...”

অনেকটা সময় কেটে গেছে, কোন ফাঁকে ভদ্রমহিলা’র খাওয়া শেষ হয়ে গেছে টের পাই নি। উনার প্রশ্নে যেন আনমনা থেকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

- “আপনি সাংবাদিক?”
প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হলাম, উত্তরে বললাম, “নাহ”

- “তাহলে লেখক নিশ্চয়ই?”

- “আরে নাহ নাহ, আমি একজন ছাপোষা হিসাবরক্ষক। আমাকে দেখে কি আপনার লেখক মনে হচ্ছে?”

- “নাহ, যেভাবে কাঁচের ভেতর দিয়ে আকাশ আর বৃষ্টিভেজা রাজপথ দেখছিলেন, আর গুন গুন করে কি যেন আবৃত্তি করছিলেন, দেখে মনে হল নির্ঘাত লেখক মানুষ।”

- “বাহ, আপনার অব্জারভেশন পাওয়ার দেখি ভয়াবহ মন্দ।” বলতেই ভদ্রমহিলা হেসে দিলেন।

- “কথাটা সুন্দর বলেছেন, কেমন একটা কমপ্লিমেন্টের মাঝে নেগেটিভিটি। বাংলাদেশের লেখক, সাংবাদিকদের কি চেনেন আপনি?”

- “না তেমন একটা না, নামে চিনি অনেককেই, কিন্তু বাস্তবে চিনি না। হাতে গোনা দুই একজন ছাড়া।”

“ও...” বলে ভদ্রমহিলা একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে আনমনা হয়ে। কেমন অস্বস্তি লাগছে, আমি বাইরের দিকে দৃষ্টি হেনে দিলাম। আড়চোখে দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন।
হঠাত দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার এক রিপোর্টার এর নাম বলে জিজ্ঞাসা করলেন, “উনাকে চেনেন?”

- “না, নাম শুনেছি, কিন্তু এরবেশী কিছু না”।

- “উনার সাথে বছরে দুয়েক আগে এই কলকাতায় পরিচয়, এরকম এক বাসে। উনিও আপনার মত বেড়াতে এসেছিলেন। খুব ভাল মনের একজন মানুষ।”
হড়বড় করে একগাদা কথা বলে গেলেন ভদ্রমহিলা। আমি শুধু হু, হা করে সাড়া দিয়ে গেলাম।

- “এরপর মাস ছয়েক আগে এসেছিলেন, আমার সাথে অনেক জায়গা বেড়িয়েছেন, শান্তি নিকেতন থেকে শুরু করে আমাদের বহরমপুর পর্যন্ত। আসলে আমরা অনেক ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছি এই অল্প সময়েই। কিন্তু গত মাস চারেক ধরে উনাকে ফোনে, ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে কোথায় পাচ্ছি না। এক্কেবারে লাপাত্তা। লেখক মানুষ তো, হয়ত কোন লেখায় নিমগ্ন হয়ে ডুব দিয়েছেন।”

শেষের কথাগুলো কেমন অনুযোগ এর স্বর ছিল। এই সময়ই গাড়ীর কন্ডাক্টর হাঁক দিল, এই ধম্মতলা, কে কে নামবেন, নেমে যান। ভদ্রমহিলা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাস হতে নেমে গেলেন, আমি তাকিয়ে রইলাম তার চলে যাওয়ার দিকে। উনি একবারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকালেন না। আমার কাছ থেকে ভদ্রতামূলক কোন বিদায়ও না। ক্ষণিকের জন্য মনে হল আমি নিজেই সেই সাংবাদিক বা লেখক বন্ধুটি তার। ইচ্ছে হচ্ছিল নেমে গিয়ে তার হাত দুটি ধরে বলি, “আরে বোকা মেয়ে, এভাবে অভিমান করতে হয়? দেখো না, তোমাকে নিয়ে এক দারুণ উপন্যাস লিখেছি? চল তোমাদের বহরমপুর, তারপর তোমাকে পড়ে শোনাবো পুরো উপন্যাস, তোমাদের সেই দীঘির পাড়ের পাকুর গাছের বাঁধানো চত্বরে বসে।

“এসপ্লানেড...” কন্ডাকটরের রুক্ষ স্বরে হারিয়ে গেল দৃশ্যপট।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫৯
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×