ক্লাস ফোরে আমাদের র্যাপিড রিডার ক্লাস হতো। সেখানে এক ধবধবে সাদা ব্রিটিশ তরুনি আমাদের এক একটা গল্প শোনাতো। ওর হাতে কখনো বই দেখি নি। লিটারেচারের স্টুডেন্ট হিসেবে সব গল্পগুলো ওর একেবারে গড়গড়ে মুখস্থ ছিল। বেশ কঠিন বাঁকাচোড়া উপন্যাসগুলো একদম রূপকথার মতো বলে যেত ও। সাদা শার্ট-গাঢ় নীল স্কার্টের সোনালী চুলের খুব শীর্ণকায় সেই মেয়েটাকে আমি ভুলতে পারি নি এখনো। আমাদের ছোট ছোট মনে রূপকথার আদলে সে ভরে দিয়েছিল সেক্সপিয়র-কিটস্ বা প্যাপিলনের মতো গল্পগুলো। আমরা তার ভিন্ন অবয়বের জন্য নাকি অদ্ভুতভাবে গল্প বলার জন্যই তার মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক-শ্রোতা বনে গিয়েছিলাম।
পাঠকেরা যদি পোস্ট শিরোনামের সাথে কথার কোন মিল না খুঁজে পান তাহলে দুঃখিত। টপিকের বাইরে কথা বলতে বলতে ওটা আমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বিরক্ত পাঠকদের এখন-ই পড়া থামিয়ে দেয়া উচিৎ নাহলে বিরক্তি বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
আমাদের সেই "ম্যাম" আমাদের বছর শেষের এক ক্লাসে এসে এক ঝুড়ি চিরকুট রেখে একজন একজন-কে ডেকে তার স্টোরি রাইটিং টপিক নিতে বললেন। আমার টুকরো কাগজটা খুলে দেখি ওতে আস্ত আস্ত হরফে দাবিয়ে লেখা, "THE P A U S E ." অনেকে ম্যামের কাছে গিয়ে টপিক বদলে নিলেও আমার লজ্জা লাগলো দেখে গেলাম না। বরং বসে বসে একটা আধা-খেঁচড়া গল্প লিখে ফেললাম যেটা তখন আমার মাত্রাতিরিক্ত সায়েন্স ফিকশন গেলার ফল।
গল্পের শুরু এক বাঙালি জিনিয়াস সায়েন্টিস্ট বুড়োকে নিয়ে। বুড়োর বয়স প্রায় ৫০-৬০। সে একা একা ল্যাব-এ কাজ করে, তার সাথে থাকে তার এ্যসিস্ট্যান্ট এক রোবট। বুড়ো হওয়ার সাথে সাথে তার শারীরিক বা মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। সে সবকিছুর চাপে অতিষ্ট হয়ে সবকিছু থেকে একটা pause পাওয়ার এক অষুধ আবিষ্কার করে ফেলে। ওটা ইনজেক্ট করে টাইম সেট করে দিলে ততোদিন সে ঘুমিয়ে থাকবে। ঘুমটা তাকে বাইরের পৃথিবীর ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিবে। বোকা বুড়োটা ওটার এ্যান্টিডোট -ও বানালো যেটা রোবটটা ইনজেক্ট করে দিলে সে জেগে উঠতে পারবে। কিন্তু ঐ এ্যান্টিডোটটায় একটা ভুল এলিমেন্ট চলে যাওয়ায় ওটা পয়জনে বদলে গেলো। এভাবে বুড়ো মরে গেল শেষে আর একটা perfect pause তাকে খুঁজে নিল।
ম্যাম সেই গল্প আর ক্লাসের আরেক ছেলের গল্প নিয়ে মহা হৈচৈ ফেলে দিলেন। ওটা আমাদের ইয়ারলি স্কুল ম্যাগ-এও চলে গেল। গল্পটা দুমড়ে-মুচড়ে আমার ভেতরে রয়ে গেল আর সেই শ্বেত-তরুনীও সময়ের ভাঁজে কোথাও হারিয়ে গেলেন।
আজকে প্রায় ১০ বছর পর আমার নিজের সেই বোকা বুড়োটার মতো একটা pause solution খুঁজে বের করতে ইচ্ছা করছে। আশেপাশের প্রতিটা মানুষ বা পারিপার্শ্বিকতা থেকে একটা বিরতি নিতে ইচ্ছা করছে। আমি ঐ সময়েই কিভাবে যেন জীবন থেকে এই রেহাই পাওয়াটা আঁচ করেছিলাম। সময় কি তখনো আমাকে যন্ত্রণা দিতো? তখনের সময় বা দিনযাপন ছিল সহজ-উচ্ছল। তাহলে ঐ বোধ কেন আসলো ভেতরে ?! এসব জানি না আমি নিজেও। তবে আমি বুঝি যে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে বেঁচে থাকা থেকে রেহাই পেতে ইচ্ছা করে ঐ perfect pause-এর মতো। প্রতিটা বিষয় থেকেই মন উঠে গেছে। কোন একটা টাইমপাসিং অবজেক্টের ভেতরে কিছু খুঁজে পাই না। তারপর-ও আশাহত হওয়া বিষয়টা মানুষের ভেতরে নেই বোধহয়। জেনেটিক্যাল ঐ ডিসওর্ডার নিয়ে আমি তাও একটু আলোর খোঁজে এক নিরেট ব্ল্যাকহোলের মধ্য চোখ রাখি আর প্রতিবার-ই থরথরাই।
এক জার্মান ধর্মপ্রচারক নান-কে চিনতাম। তাকে আমার খুব পবিত্র লাগতো দেখলেই! সে একদিন তার এক অলস অনুসারিকে বুঝানোর সময় বলছিলেন, "sleep is the sister of death. don't you know my child ?" আমি আজকে মৃত্যুর সেই বোনকে খুব ভালবেসে আলিঙ্গন করতে চাই, একটা pause এর খোঁজে...
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:২৪