somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নারকেল পাতার চশমা

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেখাটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক
নাহিদা নাহিদ ম্যাম এর লেখা,
ভালো লাগায় কপি করলাম
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। ময়নার মা তাড়া দিচ্ছে বারবার। স্কুলের ঘণ্টা ধ্বনি মনে হয় বাড়ির দরজায় বেজে উঠছে ঢং ঢং করে। ময়নার মনটা আজ উদাস উদাস। পড়ালেখা ভালো লাগছে না, ভালো লাগছে না ঘরের কাজকর্ম। ঘরের বন্ধ হয়ে যাওয়া জানালাটা খুলে দেয় সে। গুমোট একঝটকা বাতাস আটকে থাকা ঘর থেকে থেকে লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মতো বাইরে ছুটে যায়। এলোমেলো ময়না নিজেকে গোছাবে আজ। পুরনো ময়নাকে নতুন সাজে সাজাতে ইচ্ছে হয়। চোখে যতœ করে কাজল লাগায়। চুলগুলোকে ফিতা দিয়ে বাঁধে। লাল ফিতা, সবুজ ফিতার বাহারি রং রঙিন আল্পনা তৈরি করে তার চুলে। খুব শাড়ি পরতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তবু খুঁজে খুঁজে জামা জুতাই বের করে। ঘরের দেয়ালে আঁকিবুকি করা চিত্রশিল্পে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কিছুক্ষণ। কাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছিল, ভিজেছিল ময়না, এই তার প্রথম ভিজে যাওয়া। সাথে আরো একজন ভিজেছিল। রিহান রিহান রিহান। তার প্রথম ভালোলাগা, তার প্রথম নির্বোধ স্বপ্ন। আবার ময়না তার চোখের দিকে তাকায়, হ্যাঁ রিহান তার চোখের কাজলও। সর্দার বাড়িতে বেড়াতে আসা ছেলেটি কেমন করে মুগ্ধতার ইন্দ্রজালে আটকে দিল তাকে, ময়নার কাছে তা অজানা। ঢাকার কোনো এক নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র রিহান, পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও আগ্রহ তার প্রচুর। বিপ্রতীপ সমীকরণে একদিকে তার আবেগী সত্তা, অন্যদিকে বাস্তববোধ- সবটা মিলিয়েই রিহান। কী তার কথার ঢং, কেমন তার দৃষ্টি, সবকিছুই অন্যরকম। রহস্যের বাতাবরণে রিহান নিজেকে আলাদা করতে পারে সবার মধ্য থেকে। তাকানোর দৃষ্টিতে পড়ে নিতে পারে সরল ময়নার ব্যক্তিত্বের সমস্তটা। এ এক অন্য জাতের পুরুষ। স্বপ্নে দেখা রাজকুমাররাই শুধু এমন হয়। রিহান তার কে হয়? দ্বিধা আর সংশয়ে ময়নার বুকের ভেতরটা কাঁপে। ভয়ে কাঁপে, সুখেও কাঁপে।

স্কুলে যাওয়ার পথেই ময়না তার ঘটে যাওয়া জীবন নামক নাট্যচিত্রের ক্যানভাসে সরলরৈখিক দৃষ্টি ফেরায়। গল্পটা পুরনো এবং খুব সাধারণ। নিঝুমপুরের মেয়ে ময়না রিহানকে প্রথম দেখে সর্দার বাড়ির বড় ছেলের সাথে মেঘনার ঘাটে। ময়না তার বন্ধুদের সাথে নদীর ঘাটে জলতরঙ্গের খেলা দেখতে এসেছিলো,তার পরনে ছিল লাল পাড়ের সবুজ শাড়ি, খোঁপায় রক্তজবা। সুন্দরী সাজার বায়নায় সে নিজেকে সুন্দরী করেছিল সেদিন। তার বন্ধুদের সাথে ছোট্ট ডিঙায় চরবে সে, হাসবে, গান গাইবে, সন্ধ্যার বাতাসের শীতল হাওয়ায় উড়িয়ে দিবে রঙিন শাড়ির পাড়। এই তার শখ। এ ওর গায়ে জল ছিটিয়ে দেয় তারা। তাদের হাসির উচ্ছ¡াসে নদীর বুকে তরঙ্গ ভাঙে। উচ্ছ¡ল ময়না হেসে কুটিকুটি হয়, ময়নাকে সবাই সখী বলে ডাকে, ওর কাজলটানা চোখ, পাতলা ঠোঁটের হাসি, লাউ ডগার মতো শরীর মধ্যযুগের রাধার কথা মনে করিয়ে দেয়। মহুয়া পালার মহুয়াও মনে হয় কখনো কখনো তাকে। দুচোখ জুড়ায়, মনও ভেজে এ নারীর চলার ছন্দে। টিপিক্যাল গায়ের মেয়ে সে নয় কিন্তু তার চোখ মুখের উদাসীনতা, নরম আদুরে ভঙ্গি, পোশাক, চলন বলন তাকে ভাটির গানের সুরের মতো স্নিগ্ধ আবরণে ঢেকে রাখে জগতের সব পঙ্কিল কদর্যতা থেকে। তাই সে গাঁয়ের সবার অতি আপন কেউ। তাকে কেউ ডাকে পাখি, কেউ ডাকে রাধা, কেউ ডাকে সখী। ময়না শুধু হাসে। তার সে হাসি অধর নিঙরে শেষ বিকালটাকে আরো আপন করে তোলে, নির্জন করে তোলে। সেই সে ময়নার চোখ গোধূলীর রঙে রঙিন হয়ে ওঠে রিহানের চোখে। সব পাখি নীড়ে ফিরছে। এই প্রথম শূন্য হৃদয় নিয়ে ময়নাও তার ঘরে ফিরে। শহরের মার্জিত সভ্য চাহনি ময়নার সরল চোখে রব তোলে, বিস্ময় জাগায়।

তারপরের ইতিহাস একটা ঘোরের ইতিহাস। ময়না নামক সুরের বাঁশিটিকে রিহান সাজিয়ে তোলে একটু একটু করে, নদীর ঘাটে নারকেল পাতা ছিড়ে আংটি গড়ে দেয়, চশমা গড়ে দেয়, চুড়ি পরিয়ে দেয়, কানে কানে বলে সখী তুই আমার হবি! আমি তোকে রাজকন্যা সাজিয়ে রাখবো, তোর রূপের আলোয় আমি অন্ধ হয়ে থাকবো, বন্ধ করে দিবো আমার চলার পথ। পৃথিবীর ধ্বংসরূপের মাঝে দাঁড়িয়েও আমি তোর হাতে রাখতে চাই আমার হাত। সখী তোকে চাই আমি আমার করে, তোর অর্ধেকটাও চাই, সমস্তটাও চাই। তুই আমার বৌ সাজবি? রিহানের দেয়া নারকেল পাতার চশমায় চোখ ঢাকে ময়না। লজ্জায়, আনন্দে। হেসে গরিয়ে পরে রিহানের কোলে। সভ্য আধুনিক রিহান অসভ্য ঠোঁট রাখে ময়নার ঠোঁটে। তারপর একদিন, দুদিন আর দুই পক্ষ যায়। নদীর জলে লেখা হয় ময়না আর রিহানের স্বপ্ন গাঁথা। গ্রোতে ভাসিয়ে দেয়া হয় তাদের অতীত ইতিহাসের সব অধ্যায়। ডিঙায় বসে রিহান ময়নাকে বলে সখী আমার তো ফেরার সময় হলো, কী করে যাই বল তোকে রেখে। পরান সখী, চল ডুবে মরি অতল জলে। ময়না হাত রাখে রিহানের ঠোঁটে, এই কথা কইও না, আমি মইরা যামু। তোমারে ছাড়া পরাণ সখা একদিনও বাঁচমুনা। ময়না তার আলতারাঙা পা ডুবায় নদীর জলে। আনমনা হয়, উদাসী হয়। হঠাৎ দেখে নদীর জলে টপটপ করে পরছে রিহানের চোখের জল। ময়না দিশাহারা কান্নায় আঁকড়ে ধরে রিহানের হাত। আর সে রাতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরেছিল খুব। ভিজেছিল রিহান আর ভিজেছিল ময়না। সদ্য ঋতুমতি হওয়া ময়নার কপালের চুল লেপ্টে যায়, চোখের কাজল নষ্ট হয়, আরো নষ্ট হয় কত কী। রিহান তাকে আদরে আদরে ফিসফিসিয়ে বলে,

সখী কাল আমার ঢাকা ফিরতে হবে, তুই যাবি আমার সাথে?

ময়না চুপ করে থাকে।

ময়নার চোখে ভয় আর দ্বিধা। কেমন করে ছাড়বে সে তার নিঝুমপুর। নিঝুমপুরের আকাশ তার সখা, বাতাস তার সখী। নিঝুমপুরের গাছ, নদী সব যে তার আত্মার আত্মীয়। কেমন করে ছাড়বে সে নিঝুমপুর। এও কী সম্ভব! পারবে না ময়না পারবেই না। পায়ে তার আলতা আর নূপুর। এ যে তার শৃঙ্খল। রিহান কী তা বুঝবে না।

রিহান ময়নার সবটাই বোঝে। বলে, সখী আজ না হয় কাল, না হয় আর কটা দিন পর তোর বুকের ভেতর যদি আমার জন্য কান্না জমে তুই আসিস আমার কাছে। কার্তিক মাস পার হলে প্রথম অগ্রহায়ণে আমি তোর জন্য নদীর ঘাটে অপেক্ষা করবো, তুই আসিস যদি আসতে ইচ্ছে হয়। তোর হাতের জ¦লে উঠা প্রদীপের আলোয় পাড়ি দেব আমি বাকিটা পথ। সখী তুই ফিরবি তো আমার কাছে?

স্কুলের দরজায় এসে ময়না বাস্তবে ফিরে। ভালো লাগে না কিছুই তার, বাতাসটা আজো যেন কেমন ভেজা-ভেজা, আকাশটাও বিষণ হঠাৎ ময়নার বুকের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে। রিহানকে ছাড়া সে কেমন করে বাঁচবে, কেমন করে কাটবে তার সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যাটা। ময়না জানে না, জানতে চায় ও না। ময়না কাঁদে নিঃশব্দে। তবুও সে কান্না শব্দ তোলে নিঃসঙ্গতার দেয়ালে। বন্ধুরা তাকে জড়িয়ে রাখে। কাছে রাখে। প্রলেপ দিতে চায় ক্ষতস্থানে। একদিন যায়, দুদিন যায়, অস্থির ময়না আরো অস্থির হয়, মনের সাথে সাথে শরীরও তার বিকল হয়। কী অসহ্য যন্ত্রণা, কৃষ্ণ বিহনে রাধাও পুড়েছিল এ অনলে। হায়রে অস্থির মন, বিকল শরীর। ময়না বোঝে, প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ তার। সিথানের প্রদীপটাকে জালিয়ে রাখে,জ্বলতে দেয়। জানালার কপাট খুলে নারকেল গাছটা দেখে, আহারে তার রিহান কী ফিরবে আবার নারকেল পাতার চশমা গড়ে দিতে?

রাত পোহায়, দিন গরায়, দেয়ালে ঝুলালো বাংলা ক্যালেন্ডারে ময়না দাগ কাটে। গায়ের রাস্তা ধরে হাঁটে, বেড়ে ওঠা ধান গাছের দিকে তাকায়, কার্তিকের রং ধরা পাকা ধান দেখে তার চোখে স্বপ্ন জাগে। প্রথম অগ্রহায়ণ আসতে খুব বেশি দেরী নাই আর। প্রতিটা সন্ধ্যায় ময়না সাঝবাতি জ্বালায়, চোখে যতœ করে কাজল টানে, তার রিহান যে চোখ রাখবে এই চোখে। তবুও ময়নার দিন কাটে না, রাতও কাটে না। বিরহ বুঝি এমনই হয়, রাত জাগা পাখি আর সে একসাথে রাত্রি জাগে। আকাশের তারা গোনে, পাতা ঝড়ার শব্দ শোনে। হায়! কী দুঃসহ এ রাত। ময়নার মা কিছুই বুঝতে পারে না, ময়না অনেক চাপা স্বভাবের মেয়ে। মেয়ের ভেতরটা পড়তে পারলে বুঝতো তার কন্যা ঘর ছাড়া ডাকের অপেক্ষায়, যমুনার কালো জলে রাধার মরণ ছিল ময়নাও মরেছে মেঘনার জলে। রিহান আর ময়নার প্রণয় গ্রামবাসীর কাছে এক অজানা অধ্যায়। উড়ে আসা দমকা হাওয়ায়, প্রথম অগ্রহায়নে ময়না যখন হারিয়ে যায় গাঁয়ের লোকেরা অবাক হয়, নির্বাক হয়। প্রতিমা মুখের মেয়েটা বুঝি হারিয়েই গেলো। স্তব্ধ বিস্ময়ে তারা ময়নাকে খুঁজে ফেরে এখানে সেখানে। তাদের গানের পাখি, সুরের পাখি হারিয়েছে কোনো সুদূরে? কেউ জানে না, কেউ বুঝে না। কেবল আধার রাত্রি, কালো পর্দা, প্রশ্ন তুলে দেয় পাওয়া ও না পাওয়ার সংশয়ে।

টিভির বিজ্ঞাপনের টপ মডেল রিশা। শাড়ি, গাড়ি, টুথপেস্ট থেকে শুরু করে মিমি চকলেট সব ধরনের বিজ্ঞাপনেই তার সমান উপস্থিতি। চৌকস, বুদ্ধিমতি রিশার কথার ভাঁজে ভাঁজে আভিজাত্য। র্যামম্পে সে যখন পারফর্ম করে তরুণ থেকে বৃদ্ধ সবার নিঃশ্বাস আটকে যায়, মিডিয়া গসিপে এও শোনা যায় মিডিয়ার সব কয়জন গড ফাদারের সুনজর আছে রিশার প্রতি। উঠতি ছেলে ছোকরাদের স্মার্টফোনে নাকি তার পর্ণ ভিডিও অপ্রতুল নয়। সাতাশ বছরের রিশা এসব গল্প নিয়েভাবে না। ভাবতে চায়ও না। রিশা একজন সুপার মডেল। তরুণ প্রজন্মের নিশুতি রাতের উদ্দাম অধ্যায় যদি সে নাই হতে পারলো তবে এ বিহঙ্গম নারী জনম বৃথা তার। রঙিন জগতে রাজত্ব করা রাজকন্যা সে। তাই তার চোখে সর্বদাই জগতবাসী দেখে মোটা ফ্রেমের রঙিন চশমা। ঈর্ষার তীক্ষ্ণ ফলা প্রতিপক্ষকে বিদ্ধ করবেই- এটাই তো স্বাভাবিক। শো-বিজের বাহারি পণ্যের জগতে রিশা নিজেকে সবচেয়ে দামী পণ্যটাই ভাবে। দিনকে দিন রিশা নামক সুপার মডেল ঝড়ে আক্রান্ত হচ্ছে নিবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তের গণ্ডিতে আবদ্ধ, সর্বশ্রেণির মানুষজন। এ বছর তিনটি সিনেমায় সাইন করে সাইনিং মানি নিয়েছে। এর মধ্যে একটা আর্টফিল্ম। সেই শুটিংয়ের অংশ হিসেবেই তার নিঝুমপুরে আসা, দুটি শট শেষ করতেই দুপুর পার হয়ে গেলো। রিশা প্রোডাকশন হাউজকে বলে রেখেছে বিকেলবেলাটা সে একা থাকতে চায়। সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে রিশা তার চোখ থেকে মোটা সানগøাসটা খুলে ফেলে, চোখ তার জ্বালা করছে, পুড়ছে হৃদয়টাও। অমনোযোগে তাকায় আশপাশে। খুঁজে ফেরে পরিচিত সেই নারকেল গাছ। নদীর বুকে জলের ঢেউয়ে দশ বছর আগের প্রতারিত প্রেমটাকে ছায়াস্বপ্নের মতো দেখতে পায় রিশা। প্রথম অগ্রহায়ণে ময়না রিহানের হাত ধরেছিল রাতের অন্ধকারে, হাতে ছিল মাটির প্রদীপ, চোখে স্বপ্ন। রিহানের হাত ধরে পাড়ি দেবে রাত্রির অন্ধকার। মহানিশায় আহুতি দেবে রিহানের পদচরণে। ময়না যে রাধা। কুঞ্জবনে কুসুমভারে ফুটুক তার স্বপ্ন-কল্পনা। বসন্ত বাতাস তার আপন হোক, আপন হোক রিহানের সত্তা। দয়িতার পরিচয়ে সিঁথিতে জ¦লুক সিঁদুর। ময়না ভুলতে চায় নিঝুমপুর, হোক ময়না নামক পাখিটার নতুন পরিচয়।

হ্যাঁ, পরিচয় ময়না পেয়েছে, সেটা নিজের নয় রিহানের। রিহান তাকে ঢাকার এক বিলাসবহুল আবাসিক হোটেলে তোলে। প্রথম তিনদিন ময়না কিছুই বুঝতে পারেনি। হয়তো তার সরলতাই তাকে বুঝতে দেয়নি। কেমন এক ঘোর লাগা আবেশে ময়না আচ্ছন্ন ছিলো প্রথমটায়। সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছিল তার। বোকা ময়না বুঝতেই পারেনি তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। চতুর্থ দিন এক শ্বেতাঙ্গ বিদেশি ও এক বাঙালি বন্ধুসহ হাজির হয় রিহান। সাদা চামড়ার মধ্য বয়সী লোকটা কেমন করে যেন তাকায় ময়নার দিকে, ময়না কুচকে যায় সংকোচে। লোকটা বিদেশি হলেও কথা বলছিল ভাঙা ভাঙা বাংলায়, ময়না সব বুঝতে না পারলেও রিহানের কিছু কথা বুঝেছে। জোসেফ নামক ঐ বিদেশিকে নয়, রিহান তার বাঙালি বন্ধুকে বলছিল- ‘আর বলিস না গ্রামের বোকা সরল মেয়েগুলোকে ঘরের বাইরে আনতে গেলে কত নাটক যে করতে হয়, সই পাতাতে হয়, আলতা রাঙা পা দেখতে হয়, নদীর জলে চোখের পানি ফেলতে হয়, ধান পাকার অপেক্ষা করতে হয় আরো আরো কত কী!! হাউ বোরিং, হাউ ডিসগাসটিং! বিরহের টোপ ফেলে কৃষ্ণ সেজে অপেক্ষা করেছি কত দিন। উফ এই দেড় মাসে কতটা সময় যে নষ্ট হলো আমার!’

রিহানের বন্ধু খিক খিক করে কৃৎসিতভাবে হেসে ওঠে রিহানের কথা শুনে। পাল্টা বলে- ‘দোস্ত এই লাইনে আমি অনেকদিন। মেয়েটা অতিশয় বোকা বলেই তোর বরং কম সময় লেগেছে। মেয়েটার রূপ যথেষ্ট হলেও বুদ্ধির ঘট শূন্য। আর সময় নষ্ট হয়েছে বলছিস কেন? তোদের বেড সিনের ভিডিওতো দেখলাম। মাথা খারাপ করে দেয়ার মতো মাল। রিহানও হাসে, এ জন্যই তো দরটা একটু বেশি, একেবারে ফ্রেশ। প্রায় ভার্জিন বলা যায়, আমি ছাড়া এর টেস্ট কেউ জানে না। নাইনে পড়া নির্বোধ মেয়ে, প্রতিরোধের ক্ষমতা নাই। যেভাবে খুশি সেভাবে তৈরি করে নেয়া যাবে। এই মেয়ের পেছনে যতটা ইনভেস্ট করেছিস তার হাজার গুণ উঠে আসবে দেখিস। বাংলাদেশের চেয়ে অন্য দেশে সেল করাটা আমার জন্য অনেক সুবিধার, রিস্ক ফ্রি থাকা যাবে।’

ময়না এসব কথার কিছুই বোঝেনি, কী হচ্ছে তার সঙ্গে বা রিহান কী করতে চায় তাকে নিয়ে। এক ভাবলেশহীন অনুভূতি নির্বোধ ময়নাকে আরো নির্বোধ করে দেয়। রিহান এসব কী বলছে, কেন বলছে, এই রিহান কে, একে কী সে চিনে! মেঘনার জলে সে সত্যিই কী সে এই রিহানের মুখই দেখেছিল। বোঝে না ময়না, বুঝতে চায়ও না। কেমন একটা অবুঝ কান্না তার গলাটাকে টিপে ধরে। নিঃশ্বাস আটকে আসে তার।

পৃথিবীটা হঠাৎ করেই অনেক বদলে যাচ্ছে, বদলে গেছে ময়নাও। ময়না এখন নিজেকে চেনে বিশের সব ধনকুবেরের লাম্পট্যের চাঁদরে। তবে এও সত্যি, ময়নার চেয়ে রিশা নামটা অনেক বেশি আধুনিক। স্বপ্ন দেখা ময়না এহাত ওহাত ঘুরে ঘুরে আজ সে লাস্যময়ী, হাস্যময়ী রিশা। দুনিয়াজোড়া তার কদর। লন্ডনে এক বিজনেসম্যানের অবসর সঙ্গী হয়ে সামার উদযাপনের সময় এক বাঙালি প্রোডিউসারের সাথে পরিচয় হয় তার। মারুফ জাহিদ নামক ওই প্রোডিউসারের নিজস্ব প্রোডাকশন হাউজ আছে, রিশা তার মোহিনী রূপে মুগ্ধ করেছে মারুফ জাহিদকে। মানুষকে অন্ধমোহে বশ করার মন্ত্র আজ রিশার জানা। এই আলাভোলা প্রোডিউসারের হাত ধরেই ময়না আবার ফিরে আসে বাংলাদেশে।

প্রায় এক যুগ পর। এবার সে ময়না নয়, রিশা। ময়নার ইতিহাস হারাবার ইতিহাস আর রিশার ইতিহাস প্রাপ্তির ইতিহাস। টিভিতে প্রথম যখন তার অভিষেক ঘটে এক পারফিউমের বিজ্ঞাপনে। তখনই রিশা নামক এক নতুন মৌতাতে বিমোহিত হয় তরুণ প্রজন্ম। বিজ্ঞাপনটা প্রচারিত হওয়ার পর তার পরিবার পরিজনদের কেউ কেউ অনেকটা সন্দেহ আর সংশয় নিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল প্রথম কয়েকদিন। রিশা কঠোরভাবে সব পারিবারিক বন্ধনকে অস্বীকার করেছে। কারণ সে রিশা, কোনোক্রমেই ময়না নয়।

সূর্য ডুবে যাচ্ছে, যদিও প্রয়োজন নেই তবুও রিশা আবার চোখে পরে তার মোটা ফ্রেমের সানগ্লাস রিশা অপেক্ষা করছে কিছু একটার জন্য। তার পায়ের মাটিটা আর একটু শক্ত হোক, মুখোমুখি দাঁড়াবে সে ঢাকার বিজনেস ম্যাগনেট রিহান চৌধুরীর সামনে। সেদিন তার চোখে মোটা সানগ্লাসই থাকবে, নারকেল পাতার চশমা নয়।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×