২.
শাহবাগের মোড় থেকে বাসে উঠলাম ধানমন্ডি - ৩২ যাবো বলে। সিটিং বাস বলে বাসের মধ্যভাগে সিট পেয়েছি, লোকাল হলে হয়তো ঝুলে যেতে হতো। রাজধানীতে পাবলিক বাসগুলোতে সিট খালি না থাকার পর ও যাত্রী উঠিয়ে বাস ভরপুর করে ফেলে, যার ফলে গা ঠেসাঠেসি করে যাতায়াত করতে হয়। এই প্লেস গুলো আবার খুব উপযোগী বিশেষ করে পকেটমার দের জন্য, পছন্দ ও বেশ এমন গাদাগাদি করে যাতায়াত । এমন গাদাগাদি করা প্লেসে খুইয়ে যায় অনেকের পকেট, সবাই ভদ্রলোক কাকেই বা সার্চ করবেন ..? উল্টো গনপিটুনি খেতে হবে। রাজধানীতে ভদ্র লোকের মুখশে লুকায়িত হাজারো ছিনতাইকারী, পকেটমার, এবং আরও অনেক প্রজাতি।
সিটিং বাস ছিলো কিন্তু বাস কন্টাক্টার এর চাহিদা বেশি হওয়ায় বাস ভরপুর। ঠেসাঠেসি করে বাসের ভিতরে দাড়িয়ে আছে অনেকেই, এদের মধ্যে কয়েকজন নারীও রয়েছে । যেহেতু সামনের দিকে বসেছিলাম, নারীদের কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের সিট বিসর্জন দিতে চাইলাম। অষ্টাদশী হবে এমন একটি মেয়েই পাশাপাশি ছিলো, সিট ছেড়ে তাকে বললাম :- আন্টি, আমি দাড়িয়ে যেতে পারবো আপনি বসুন।
মেয়েটি ধমকের সুরে বললো:- মেয়ে দেখলেই কি হিরো হতে মন চায়..?
ওমা! এ কেমন বিচার..? এটা কি হলো, গেলাম সহানুভূতি দেখাতে কিন্তু এখন দেখি হিতে বিপরীত। মেয়েটি তো তেলে-বেগুনে রেগে আগুন।
মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম :- আন্টি, মেয়ে দেখলেই হিরো হতে মন চায় না, আপনি মায়ের জাত বলে আপনাকে বসতে বলেছি অন্যকিছু না।
মেয়েটি আরো রেগে বললো :- আমার প্রতি আপনাকে সহানুভূতি দেখাতে কে বললো..? আমি বুঝিনা কিছু..?
আল্লাহ জানে, আল্লাহ এই মেয়েটিকে কি দিয়ে সৃষ্টি করলো ..? মেয়েটা এমন কেনো ..? এতো সেনসেটিভ হওয়া কি ঠিক..?
এমন মেয়েগুলোই একসময় মস্ত বড় ভুল করে ফেলে এবং সেই ভুলের মাশুল দিতে হয় আজীবন। কখনো কখনো আবার ভুলের মাশুল দিতে হয় অত্মহননের মাধ্যমে।
বাসে থাকা লোকগুলো আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আবার কিছু নারী প্রেমী কি ঘটেছিলো তা না বুঝেই মেয়েটির পক্ষ নিয়ে আমাকে ধমকাতে লাগলো, চিন্তায় ছিলাম কখন আবার গনপিটুনি জোটে আমার কপালে, নাহ ভাগ্য ভালো পিটুনি খেতে হয়নি । এমন সুশীল সমাজের জন্য দেশ আজ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত।
মেয়েটিকে বিরক্তির সুরে বললাম :- আচ্ছা হয়েছে, আপনার বসতে হবে না । আমি দুঃখিত আপনাকে যে বসতে বললাম, সরি।
তর্কে তর্কে বাস ধানমন্ডি এসে পৌছিল, আমি বাস থেকে নেমে গেলাম । লেকের দিকে নির্জন একটি জায়গাতে গিয়ে বসলাম, যদিও লেকের মধ্যে তেমন নির্জন কোনো স্থান নেই । লেকের পানির মাঝে বোটে করে কয়েকটা কপোত-কপোতী ঘুরছে । কেউ কাঁধেতে মাথা রেখে, কেউ জড়িয়ে ধরে আবার কেউ নিজেদের মাঝে দুরুত্ব রেখে।
আচ্ছা সম্পর্কগুলোর গভীরতা কেমন..? কতটুকু নিশ্চয়তা বা এই সম্পর্কগুলোর..?
এগুলো কি সাময়িক মোহ নাকি সত্যিকারের ভালোবাসা...? এর উত্তর খোঁজা আমার মতো ভবঘূরের জন্য প্রয়োজন বোধ করছিনা ।
হেডফোন বের করে কানে লাগিয়ে বাদাম ওয়ালা কে ডেকে পাঁচ টাকার বাদাম নিলাম। ব্যাচেলরদের বাহিরে ঘুরার সময়কার নাস্তা বাদামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যদি ও বন্ধু-বান্ধবের ট্রিটে মাঝে মাঝে ভালো খাবার জোটে। ব্যাচেলরদের খাবারের মেনুটা আবার অন্যরকম, বেশির ভাগ সময়'ই খাবার মেনু থাকে... ডিম আর আলুভর্তা, ডালতো প্রতিদনকার'ই মেনুতে স্থান পায়। ব্যাচেলরদের ভাগ্যের দিনটি হলো বিশেষ করে শুক্রবার, এইদিনে ব্যাচেলরদের খাবার মেনুতে একটু পরিবর্তন আসে, বড় মাছ বা মাংস যোগ হয় শুক্রবারে খাবারের মেনুতে।
বাদাম চিবুতে চিবুতে জুনায়েদ ইভান এর ছারপোকা গানটি শুনতে লাগলাম।
অ্যাশেজের গানের লিরিক্সগুলো অধিকাংশই ব্যাচেলরদের জীবনের সাথে মিলে যায়, ব্যাচেলরদের অবসরের সঙ্গী ব্যান্ড সঙ্গীত গুলো এবং নিকোটিনের মুগ্ধ ছোঁয়া।
হেডফোনে বাজছে ...
" কি জলে ভেজাও তুমি রাগগুলো চোখে
মেঘ ঠোটে করে আমায় ভূল আবেগ দিলে "
গানটি শেষ হয়ে এসেছিলো তাই কথাগুলো কয়েকবার বাজবে, দুইবার কথাগুলো শেষ হওয়ার পর হঠাৎ কাঁধে মৃদু নরম স্পর্শ, আচমকা হওয়াতে একটু চমকে উঠলাম। ভাবলাম হয়তো পথশিশু, কিছু পাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে এসেছে, এবং ডাকছিলো, কিন্তু ফুল ভলিউমে গান শুনার কারনে হয়তো তার ডাক শুনতে পাইনি। লেকে অনেক শিশু বাস করে, অনেক মেধাবী তারা, কিন্তু সামর্থ্য এবং সঠিক পরিচর্যার মেধাগুলো হারাচ্ছে আমাদের থেকে, ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে তারা মাদক এবং ছিনতাই এর মাঝে। হারিয়ে যায় মেধা, জম্ম নেয় সমাজের কীট। আমাদের প্রয়োজন ভাসমান শিশুদের কে পড়াশুনার বন্দোবস্ত করে দেওয়া। অবাক লাগে আমাদের শাসনব্যবস্থা এখনো তাদের জন্য কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি বলে। আবার গর্ব হয় দেশমাতার কিছু নিঃস্বার্থ প্রাণের অগাধ ভালোবাসা দেখে, তাদের স্ব-উদ্যোগে দেশে আজ প্রতিষ্ঠিত অনেক গুলে ভাসমান শিশুদের জন্য স্কুল, যেখানে তারা নিজের সময়, শ্রম, বুদ্ধি এবং পকেট খরচের বাঁচানো টাকা ব্যয় করে পড়াশুনা করায় ভাসমান শিশুদের। লেকেও মাঝে মাঝে দেখা যায় অনেকেই বাচ্ছাগুলো অক্ষর জ্ঞান দিচ্ছে এবং শিশুগুলোও সাদরে তা গ্রহন করছে । এসব দৃশ্যগুলো যখন দেখা যায় এবং মনের অনুভব করা যায় তখন নিমিষেই মন ভালো হয়ে যায় ।
কাঁধে স্পর্শ করা হাতটি তো তেমন অনুভব হলো না, বাচ্ছাদের হাত হলেতো আকৃতি ছোট এবং হালকা হতো, কিন্তু হাতটি একটি পরিপক্ক হাতের ন্যায়, তবে ভীষণ মৃদু। পিছনে ফিরে তাকালাম...
:- এ'কি ! আপনি..?
ভীষণ অবাক হলাম আমি, সকালের সেই শ্যামবর্ণের মেয়েটি, যে কবিতা আবৃত্তি করতে শাড়ী পরে ক্যাম্পাসে গিয়েছিলো এবং আমার টিএসসিতে যাওয়ার পথে দেখা হয়েছিলো। মেয়েটি এখন খয়েরি রঙের থ্রী-পিছ পরে এসেছে কপালের ঠিক মধ্যভাগে একটি কালোটিপ, ঠোটে গোলাপী রঙের লিপিস্টিক গাড়ো করে লাগানো। গোধুলির আবচা আলোতে মেয়েটিকে দারুণ দেখাচ্ছিলো।
মেয়েটি বলে উঠলো :- এই, হইছে কি আপনার..? আমাকে ফলো করতেছেন কেনো...?
হায় আল্লাহ ! এ কেমন বিচার তোমার..? বাসে একটি মেয়েকে নিজের আসন ছেড়ে বসতে বললাম, মেয়েটির উল্টো কথা শুনতে হলো সাথে সুশীলদেরও। এরপর আসলাম লেকে সেখানে ও বুঝি উল্টো কথা শুনতে হবে ..? সবকিছুর জন্য'ই কি দায়ী ব্যাচেলর লাইফ ..?
মেয়েটি সকালে আমাকে ডেকেছে, আমাকে নাকি তার পরিচিতজনের ন্যায় লাগে, এখন এসেও আমার কাঁধে সে হাত রেখেছে, আর এখন আমাকে উল্টো বলে আমি নাকি তাকে ফলো করি। অথচ মেয়েটিকে আমি চেনিনা, সকালেই প্রথম দেখেছি আর এখন দ্বিতীয় বার।
মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম:- এই যে, আপু আমি আপনাকে কখন ফলো করলাম..? আমি আপনাকে চেনি'ইনা ফলো করবো কেনো..?
মেয়েটি বললো :- আর ঢং করতে হবে না, এখন যা বলছি তা শুনেন নইলে লোক ডাকবো আর বলবো আমাকে টিজ করেছেন । তারপর কি হতে পারে ব্যাপারটা নিজেই বুঝে নিন।
এ কি হচ্ছে আজ, মেয়েটি আমাকে টিজ করছে আর আমাকে ধমক দেয় কথা না শুনলে লোক ডাকবে। কি আর করা গনপিটুনী খাওয়ার ভয়ে মেয়েটির কথা শুনতে রাজী হলাম।
মেয়েটিকে বললাম :- জ্বী আপু, বলুন নিরিহ আমাকে কি করতে হবে ..?
মেয়েটি বললো :- আমাকে আপু বলবে না
আমি বললাম :- তো কি বলে ডাকবো...?
মেয়েটি বললো :- আমার নাম ধরে, রিমি বলে আর আমি তোমাকে হিমেল বলে ডাকবো।
একটি অপরিচিতা মেয়ে, সকালেই প্রথম দেখা আর প্রথম দেখা থেকেই কেমন অদ্ভুত কথা বার্তা বলে, চেনা নেই জানা নেই এমন একজন কে বলে নাম বলে ডাকতে এবং সে ও নাম বলে ডাকবে, ভীষণ অবাক হচ্ছিলাম আমি। মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়ে নিজেই মানুষিক রোগী হয়ে গেলো কিনা ..? নাকি আমি ঘোরের মাঝে আছি. ?
মেয়েটিকে বললাম :- আচ্ছা, রিমি বলে ডাকবো, তো এখন বলুন কি করতে হবে ..?
মেয়েটি বললো :- চুপচাপ আমার সাথে চলো
আমি বললাম :- কই যামু..?
মেয়েটি বললো :- চুপচাপ চলো, কথা বললে চিৎকার করবো
হায় আল্লাহ! এ কোন বিপাকে পড়লাম, মেয়েটি আমাকে কিডন্যাপ করছে নাতো ..? কিছু বলতে পারছি না, যদি চিৎকার করে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে চললাম মেয়েটির সাথে ।
মেয়েটি বললো :- লেকের পানিতে বোটে করে ঘুরবো, চলুন
আমি বললাম :- আমার নিকট তো এত টাকা নেই
মেয়েটি বললো :- টাকার কথা তো আপনাকে বলি নাই, ঘুরতে বলছি ঘুরবেন।
মেয়েটি কাউন্টারে গিয়ে একটি বোট ভাড়া নিলো, এবং আমাকে বললো উঠুন। মেয়েটিকে প্রথম দেখার পর'ই ওর প্রতি একপ্রকার মায়া জম্মেছিলো, এবং এখনকার আচরণে মায়ার পরিমান আরও বেড়ে গেলো। নিজে থেকেই বোটে উঠলাম। দুজনেই ধীরগতিতে প্যাডেল চালাচ্ছি , বোট ধীরগতিতে এগুচ্ছে মেয়েটি নরম সুরে বললো :- তোমার কাঁধে কি মাথা রাখতে পারি..?
কি বলবো আমি তা জানা নেই আমার, সকালেই প্রথম দেখা আর বিকেলেই বলে কাঁধে মাথার কথা, মেয়েটি কি কোন প্রকার ভূল করছে না তো...?
তার জীবনে আসা কোন মানুষ হিসেবে ভাবছে না তো..?
মানুষ যখন ডিপ্রেশনে ভোগে তখন, কিছু কিছু সময় এমন ভুল করে থাকে। মেয়েটি অামার উত্তর না শুনেই কাঁধেতে মাথা রাখলো, পরম তুষ্টতার সাথে, এ যেনো বহুবছরের চেনা কারো সাথে সে সময় কাটাচ্ছে । গোধুলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে কিন্তু তার বোট ছাড়িবার কোনো লক্ষণ নেই।
আমি মেয়েটিকে বললাম:- আমার সন্ধ্যায় টিউশনি আছে যেতে হবে তো
মেয়েটি বললো :- আজ না গেলে কি হয় না..?
আমি বললাম :- গ্যাপ দিলে হয়তো টিউশনিটা টিকবে না, তখন অনেক সমস্যার সম্মুখিন হতে হবে।
মেয়েটি চুপ করে রইলো, বোট ছেড়ে যেতে আমার ও ইচ্ছে করছে না কিন্তু আর করার, স্বার্থপর এই শহরে ব্যাচেলরদের সুখ করতে নেই, জীবন পরিচালনার তাগিদে তাদের সংগ্রাম করতে হয় অবিরত।
(অসমাপ্ত)
গতপর্ব
http://www.somewhereinblog.net/blog/ifatrayhan/30241220
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:৪৩