৪.
রিমি ক্রমান্বয়ে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলো, আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। গন্তব্য তার ভিন্ন, আমি একদিকে আর সে অন্যদিকে। মিশে গেলো জনবহুল এই শহরের লোকের ভিড়ে, আর দেখা যাচ্ছেনা তাকে। পরবর্তীতে কি আর দেখা হবে..? ঠিকানা, ফোন নাম্বার কিছুই তো বলে যায়নি, আমিও তো বোকার মতো তা নেইনি। আবার কি কোনো প্রকৃতির ইশারায় দেখা হবে নাকি এখানেই শেষ দেখা ..?
একটা উপায় আছে হয়তো, ক্যাম্পাসে গিয়ে ওর ডিপার্টমেন্ট এ খোঁজ নিলে পাওয়া যাবে। মেয়েটির মাঝে একপ্রকার অদ্ভুত মায়া বিরাজমান, যে মায়া বারবার আমাকে তার দিকে টানছে, মায়া টানে নিজেকে জড়িয়েছি, হয়তো ছাড়া পাবোনা কখনো।
মোহাম্মদপুর যেতে হবে, টিউশনি আছে। গ্রামের ওই বড় ভাই জোগাড় করে দিছে টিউশনিটা, ভাইয়ের ব্যাবসায়িক পার্টনারের মেয়ে, এসএসসি কেন্ডিটেট। এই বয়সের মেয়েদের প্রতি যদি আমার একটু আপত্তি আছে, তবুও নিজের বর্তমান অবস্থার কথা চিন্তা করে টিউশনিটা নিয়েছি।
এই বয়সের মেয়েগুলো একটু ফাঁজি টাইপের হয়, জ্বালিয়ে খেতে চায়, এই বয়সের মেয়েগুলো হাত রেহাই পাওয়া খুব কঠিন । উঠতি যৌবন, যৌবনের তাড়নায় কখন আবার কি করে ফেলে। গত একমাস পড়িয়ে আমার স্টুন্ডেটটির মাঝে তেমন কিছুই পাইনি, এখনো পর্যন্ত কন্ট্রোলেই আছে।
বাসে উঠে পড়লাম লোকাল বাস, ভিড়ে গাদাগাদি করে দাড়িয়ে রইলাম। এরই মাঝে আকাশ তুমুল বর্ষণ শুরু করে দিলো। অঝোরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, ৩০ মিনিট এমন বৃষ্টি হলে শহরের রাস্তাগুলো সব তলিয়ে যাবে। বাস মোহাম্মদপুর আসলো, তখনও বৃষ্টি হচ্ছে । একটি টং দোকানের সামনে থাকা প্ল্যাস্টিক টানা দিয়ে বানানো চালার নিচে মাথা গুঁজে আশ্রয় নিলাম। অনেকগুলো মানুষ একত্রে গাদাগাদি করে দাড়িয়ে। বৃষ্টি হলে শহরে চলাচলরত মানুষগুলো বেশ বিপদে পড়ে। কিন্তু আমার মতো ভবঘুরের কথা কি আর বলবো, ওই যে কথায় আছে না.. "নাড়ীর টানে হিমালয় পাড়ি দিতেও রাজী" আর এখানে তো শুধু বৃষ্টি।
ভিড়ের মাঝে ফোন বেজে উঠলো .... ফোন হাতে নিয়ে দেখি স্টুন্ডেট এর মায়ের নাম্বার। শহরের টিউশনি গুলোর এই একটা সমস্যা, আসতে একটু লেট হলেই ফোনের উপর ফোন । একবারের জন্য তাদের মনে হয়না, রাস্তা ঘাটে জ্যাম থাকতে পারে এবং লেট হতে পারে। এ কথা মনে হবে কেনো..? ওনারা তো পড়ানোর বিনিময়ে টাকা দিচ্ছে, যত কষ্টই হউক না কেনো পড়াতে আসতেই হবে। এমনও কিছু ফ্যামেলি আছে কোনোদিন মিস করলে সেদিন এর টাকা হিসেব করে কেটে নেয়, আর কিছু কিছু ফ্যামেলি আছে যাদের টিউশনির টাকা দেবার সময় ও হয়না, এবং টাকাও থাকে না কিন্তু প্রতিদিন'ই ১৫-২০ হাজার টাকার শপিং না করলেও হয়না।
ওসব মানুষগুলোর একটু চিন্তা করা উচিত, একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে বিনা প্রয়োজনে টিউশনি করায় না, তাদের জীবন চলার তাগিদেই টিউশনি করায়। নাহয় এতো কষ্ট করা তাদের প্রয়োজন ছিলো না, যারা টিউশনি করায় তাদের অধিংকাশেই গ্রাম বা মফস্বল থেকে আসা। তাদের বাবার এমন অঢেল টাকা পয়সা নেই যে তারা বাপের টাকায় বসে খাবে। ওরা চিন্তা করে নিজের খরচটা কিভাবে নিজে কমিয়ে রাখতে পারে এবং নিজেই নিজের খরচ বহন করতে পারে, আর সেই জন্যই তারা টিউশনি করায়।
ফোন রিসিভ করলাম , ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে ভেসে আসলো ...
:- আস-সালামু আলাইকুম, স্যার আমি ফারিয়া
আমার স্টুন্ডেটটির নাম ফারিয়া, রাইফেল'স এ দশমে পড়ে। চঞ্চল কিন্তু ভদ্রও ।
আমি সালামের উত্তরদিয়ে বললাম:- বলো ...?
ফারিয়া বললো:- স্যার, আপনি আজ আসবেন না..?
আমি বললাম :- আসবো, আমি তোমাদের বাসার কাছাকাছি'ই আছি, বৃষ্টির কারনে আটকা পড়েছি।
ফারিয়া বললো:- আচ্ছা স্যার, আম্মু ফোন দিতে বলেছিলো তাই ফোন দিয়েছি।
আমি ফোন রেখে দিলাম, বৃষ্টি কিছুটা কমে আসলো। ব্যাচেলরদের এই বৃষ্টি গায়ে নিলে হবে না, টং দোকানের চালার নিচ থেকে বেরিয়ে ফারিয়াদের বাসার দিকে যেতে লাগলাম, ৭-৮ মিনিট হাঁটার পর ফারিয়াদের বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম, এতক্ষণে আমি ভিজে টইটম্বুর। ফারিয়াদের বাসার কলিং বেল চাপলাম, ফারিয়া এসে দরজা খুলে দিলো এবং ভেজা দেখে বললো:- ওমা ! স্যার আপনিতো পুরাই ভেজে গেলেন , দাড়ান আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি।
মেয়েটি দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো, এবং একটি সাদা রঙের তোয়ালো নিয়ে ফিরে আসলো এবং আমাকে তোয়ালে দিয়ে বললো :- আপনি গা মুছে ঘরে আসুন আমি আসছি।
মেয়েটি ভিতরে চলে গেলো আমি হালকা গা মুছে ভিতরে গিয়ে বসলাম, দেখলাম মেয়েটি আমার চা নিয়ে আসলো, এই প্রথম মেয়েটি আমার জন্য কিছু নিয়ে আসলো, এর কাজের বুয়া বা ওর ছোট ভাই'ই এনে দিতো।
মেয়েটি চা সামনে নিয়ে এসে বললো:- আমি নিজ হাতে বানিয়েছি, ঠান্ডা কেটে যাবে খেয়ে নিন।
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে দেখে আমার চুল থেকে এখনো পানি ঝরছে , মেয়েটি আমাকে বলে:- আপনি গা মুছেন নি ক্যান..?
আমি বললাম: মুছলাম তো,
মেয়েটি বললো :- হইছে, আর বলতে হবে না, দেখি তোয়ালেটা দেন তো...।
মেয়েটি আমার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে, আমার মাথা কাছে টেনে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে দিতে লাগলো।
এ যেন পরম মমতার সহিত প্রিয়জন প্রিয়জনের সেবা করতেছে। মা অসুস্থ হওয়ার আগে আমার গোসলের পর এবং বৃষ্টিতে কখনো বাইরে থাকলে ঘরে ফেরার পর আঁচল দিয়ে মাথার পানি ঝরে দিতো । মা কে আজ ভীষণ মনে পড়ছে, জানিনা কবে আবার মায়ের দেখা পাবো। কাল বাবা ফোন দিয়েছিলো মা নাকি খুব অসুস্থ, আমাকে দেখতে চেয়েছে যেন বাড়ি ফিরি। হাতে তেমন টাকা-কড়ি ও নেই, যে বাড়ি ফিরবো। তাছাড়া বাড়িওয়ালা চাচার ভাড়াটা ও এখনো দেওয়া হয়নি। আজ যদি ফারিয়ার বাসা থেকে টিউশনির টাকাটা দেয় তাহলে বাড়িওয়ালা চাচার টাকাটা পরিশোধ করে না হয় দুদিনের জন্য বাড়ি যাবো, মাকে দেখার জন্য।
ফারিয়া আমার চুল পানি ঝারাচ্ছে, আর বলছে এমন অগোছালো ভাবে চললে জীবন চলবে কি করে..? একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে শিখুন।
আমি কি এতটাই অগোছালো, যে পিচ্ছি মেয়েটা আমাকে গুছিয়ে চলতে বলেছে , ভবঘুরে টাইপের চলাফেরা হয়তো কোনো মেয়ের'ই পছন্দ নয়, তারা চায় মানুষগুলো একটু সুন্দর ভাবে বাঁচুক। আজকের দিনটি কেমন যাচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছি না, রিমির সাথে দেখা একসাথে বোটে ছড়া, আমার কাঁধে রিমির মাথা রাখা, বাড়িওয়ালা চাচার বকবকানি, বাসের ঐ মেয়েটার সাথে ঝগড়া আবার ফারিয়ার পরম মমতা ।
চুলের পানি ঝরানো শেষে ফারিয়া আমার হাতে চায়ের তুলে দিলো নিচের দিকে তাকিয়ে, আমি চা হাতে নিয়ে বললাম :- পড়তে বসো,
মেয়েটি পড়তো বসলো, কিন্তু তার মন আজ পড়ার টেবিলে নেই, কেমন যেনো সংকোচ বোধ করতে লাগলো মেয়েটি, চোখ জোড়া নিচের দিকে তাকিয়ে, মাঝে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাচ্ছে, মেয়েটির চোখে অন্যকিছু দেখতে পেলাম।
মেয়েটি কি কিছু বলতে চায়, কিন্তু কি বলতে চায় ...? মেয়েটির চোখে একপ্রকার প্রেমের চাহনি দেখতে পেলাম, মেয়েটি কি কারো প্রেমে পড়েছে নাকি...?
মেয়েটিকে বলললাম:- ফারিয়া কোনো সমস্যা ফিল করছো...?
ফারিয়া বললো :- না স্যার, কিছুনা
মেয়েটি আড়াল করতে চাইছে তার মনের কথাগুলো, হয়তো ভয়ে নয়তো লজ্জায়। কিন্তু এই বয়সী ছেলেদের আল্লাহ একটা ক্ষমতা দিয়েছে যে তারা কোনো মেয়ের চোখ দেখলেই বলে দিতে পারে তার চোখের ভাষা।
মেয়েটি পড়ছে, যদিও তা আনমনে, মেয়েটির মনে বাস করছে অনেক কিছু, জানা অজানা অনেক স্বপ্ন। উঠতি বয়সে এমন'ই হয় যাকে দেখে যার সাথে একটু মেশে তাকেই ভালোলাগে এবং এই ভালোলাগা থেকে অনেক সময় মস্তবড় ভুল করে ফেলে।
আমার মনও এখন আর ফারিয়ার ঘরে নেই, আমার মন ভাবতে লাগলো আজ ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো, রিমির মতো একটি মায়াবী কন্যার হঠাৎ করে আমার জীবনে আসা, অনেক রোমাঞ্চকর কিছু সময় কাটানো, সত্যি অসাধারণ কিছু মূহুর্ত ছিলো। এখন আবার ফারিয়ার এমন স্নেহ অবাক করার মতো, যে মেয়েটি কথা বলতে সংকোচ করতো সে মেয়েটি কাছে টেনে এভাবে আমার চুলেন পানি ঝরিয়ে দেওয়া।
নিরবতা ভেঙ্গে ফারিয়া বললো:- স্যার..
আমি সাড়া দিয়ে বললাম :- কিছু বুঝতে সমস্যা..?
ফারিয়া আগ্রহ নিয়ে বললো:- কিছু ভাবছেন ..?
আমি বললাম :- নাহ
ফারিয়া বললো :- একটা কথা জিজ্ঞেস করবো...?
আমি বললাম :- বলো
ফারিয়া বললো:- আপনার গার্লফ্রেন্ড অাছে..?
মেয়েটির প্রশ্ন শুনে আমি হতবাক, মেয়েটি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করলো কেনো ..?
আমাকে কি ভালোলাগে মেয়েটির..? পূর্বে বলা কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো .. "এমন অগোছালো ভাবে চললে জীবন চলবে কি করে..? একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে শিখুন"
মেয়েটি এখন আবেগের ঘোরে বাস করছে, বয়সটা'ই এখন আবেগের।
আমি ফারিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললাম :- নাহ
ফারিয়া যেনো হাতের মুঠোয় চাঁদ পেলো এমন হাসি দিয়ে বললো :- আচ্ছা
আমি ফারিয়া কে বললাম :- তোমার আম্মু কি বাসায় আছে..?
মেয়েটি ভয় পেয়ে গেলো, যদি আমি আবার তার উদ্ভট প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে ওর মায়ের নিকট অভিযোগ করি,
ফারিয়া ভয়ার্ত কন্ঠে বললো :- জ্বী স্যার , আম্মু বাসায়
আমি বললাম :- তোমার আম্মুকে যদি একটু ডাকতে
ফারিয়া আরো ভয় পেয়ে গেলো এবং বললো :- স্যার যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমাকে বলেন।
আমি ফারিয়া কে বললাম :- আসলে বাড়িওয়ালা চাচা ভাড়া টা চাইচে কয়েকবার ...
আমার কথা সেখানেই থামিয়ে ফারিয়া বললো :- এক মিনিট স্যার আমি আসছি..
মেয়েটি যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো উচ্ছাসিত মনে ভিতরে গেলো এবং মিনেট দুয়েক পর একটি খাম হাতে ফিরে এসে বললো:- এই নিন স্যার
আমি ফারিয়া কে বললাম :- একটু বাড়িতে যেতে হবে দুদিনের জন্য মা অসুস্থ, তোমার আম্মুকে বলিও পরশু আসবো না।
ফারিয়া বললো : - আচ্ছা স্যার।
খামটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ফারিয়াদের বাসা থেকে, বাসায় পৌঁছে বাড়িওয়ালা চাচা কে আজ'ই ভাড়াটা দিয়ে দিবো, এবং কাল সকালে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিবো, মাকে দেখবার জন্য।
বাইরে এখনো টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে, ফারিয়ার কথা গুলো এখনো কানে বাজছে ..
এতটাই অগোছালো বুঝি আমি, নিজেকে গোছাতে আর কতটা সময় লাগবে..?
মধ্যবিত্ত পরিবারে জম্ম, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের তেমন চাহিদা থাকতে নেই, তারা বড় সংযমী । নিজেকে গুছিয়ে নিতে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের অনেক সময় লেগে যায়।
রিমির কথাও মনে পড়ছে, মেয়েটি কে ..? কি'বা তার পরিচয়..? কেনোই বা সে এভাবে আমার জীবনে পদাপর্ণ করলো, আর কেনোইবা তার ইচ্ছেগুলোকে আমি সায় দিচ্ছি ..?
প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা নেই আমার , উত্তর জানা হবে কিনা তা ও হয়তো আর জানা হবে না।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ৩:৫০