ডা জাকির নায়েক সাহেবের মতামত হচ্ছে
“বিনা অযুতে কুরআন স্পর্শ করা জায়েয”
জাকির নায়েক বলেন, “অনেক মুসলমান আছে যারা মনে করেন পবিত্র কুরআন কোন অমুসলিমকে দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে সূরা ওয়াকিয়ার আয়াত নং ৭৭-৮০ কে দলীল হিসেবে পেশ করেন।
ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ (৭৭) فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ (৭৮) لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (৭৯)
“নিশ্চই পবিত্র কুরআন সবচে সম্মানিত, যা অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ নিষিদ্ধ।” (সূরা ওয়াকিয়া-৭৭-৭৯)
এর মর্মার্থ হিসেবে তারা ধরেই নেন যে, পবিত্র কুরআন পবিত্রতা ছাড়া স্পর্শ অননুমোদিত। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। আরবি শব্দ كِتَابٍ مَكْنُونٍ দ্বারা এ পৃথিবীতে ও আমাদের সামনে যে কুরআন রয়েছে তা নির্দেশিত হয়নি, আবার ْمُطَهَّرُونَ দ্বারা কেবল পরিচ্ছন্নতাই বুঝানো হয়নি। প্রকৃত পক্ষে যদি তা-ই হতো তবে যে কোন অমুসলিম মার্কেটে যেত আর ৮০ থেকে ১০০ টাকায় একটি কুরআন খরিদ করতো এবং কুরআনকে মিথ্যা প্রমাণিত করার প্রয়াস পেত। কেননা অর্থ করা হয়ে থাকে যে, অপবিত্র ব্যক্তি এটা স্পর্শ করতে পারবে না। আসলে এখানে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ হচ্ছে, পবিত্র কুরআন ‘লাওহে মাহফুজে’ সংরক্ষিত আছে আর ঐ সংরক্ষিত কুরআনটি ফেরেশতা ব্যতিত অন্য কোন অপবিত্র ও লৌকিক বস্তু কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারবে না”। (লেকচার সমগ্র খ:২ পৃ:৬২৫-৬২৬, সংকলন মো: রফিকুল ইসলাম, পিস পাবলিকেশন ঢাকা)
সঠিক ফতোয়া.
অযু ছাড়া অপবিত্র অবস্থায় ক্রুআন স্পর্শ করা জায়েয নেই
জাকির নায়েক সাহেব ফতোয়া দিয়েছেন যে, অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা বৈধ। তা মূলত ইবনে হাজম জাহেরী ও মাও মওদুদী সাহেবের মতামতকেই তিনি নিজের গবেষণার নামেই চালিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে চার মাযহাবের সকল ইমামদের ফতোয়া এবং সাহাবা ও তাবেয়ীনদের মত হচ্ছে, বিনা অযুতে কুরআন স্পর্শ করা অবৈধ। সূরায়ে ওয়াকিয়া এর উপরোক্ত আয়াতই এ ফতোয়ার মূল দলীল।
উক্ত আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-
لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (৭৯)
অর্থাৎ পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া এ পবিত্র কুরআনকে কেউ স্পর্শ করবে না।
এ আয়াত মূলত যদিও ফেরেশতা ও লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কুরআনের ক্ষেত্রেই অবতীর্ণ বলে আয়াতের শানে নুযুল দ্বারা বুঝা যায়। কিন্তু উসূলে ফিকহের নীতিমালা হচ্ছে-
"العبرة لعمرم اللفظ لا بخصوص السبب"
অর্থাৎ আয়াতে শব্দের ব্যাপকতাই ধর্তব্য হয়, শানে নুযুলের উপর বিধান স্বীমিত থাকেনা। এ কারণে হুকুমটি দুনিয়ার জগতে মানুষের হাতের নাগালে যে কুরআন রয়েছে তার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। কেননা এ আয়াতে দুটি শব্দ লক্ষণীয়।
এক. ( لَا يَمَسُّ ) স্পর্শ করা যাবে না। দুই. ( إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ ) একমাত্র পবিত্ররা ছাড়া। দুটি শব্দই ব্যাপক। শুধু ফেরেশতার ক্ষেত্রে হুকুমটি সীমাব্ধ থাকলে শব্দটি এভাবে বর্ণিত হতো না; বরং لا يصل اليه এবং الا الملائكة অর্থাৎ ফেরেশতা ছাড়া লাওহে মাহফুজে অন্য কেউ পৌছতে পারবে না, এভাবে বর্ণিত হতো। কিন্তু এভাবে শব্দ বিন্যাস না করে উক্ত আয়াতে ‘পবিত্রতা ছাড়া স্পর্শ করবে না’ এমন বাক্য প্রয়োগ করে আল্লাহ তায়ালা যে কোন অপবিত্র মানুষের জন্য এ দুনিয়ার কুরআননের কপি যে স্পর্শ করা অবৈধ, তা বুঝিয়েছেন। এটাই সাহাবা, তাবেয়ীন ও চার মাযহাবের ইমামদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। ব্যতিক্রম শুধু ইবনে হাজম ও আবুল আলা মওদুদী সাহেব। তাদের যুক্তি হলো, কুরআন পড়া, যিকির করা নেক কাজ, তা যেমন বিনা অযুতে করা যায়। কুরআন স্পর্শ করাও ভাল কাজ তাই অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবে না কেন? (বিস্তারিত জানতে পড়–ন মুহাল্লা "محلى لابن حزم" মাসআলা নং১১৬)
কিন্তু এ যুক্তি যে একেবারেই ভুল তা স্পষ্ট। কারণ এ যুক্তি হিসাবে একথাও বলা যেতে পারে যে, নামায পড়াও তো ভাল কাজ, তাহলে অযু ছাড়া নামায পড়া অবৈধ হবে কেন?
মাও. মওদুদী সাহেবও স্ববিস্তারে তার তাফহীমুল কুরআনে পরিস্কারভাবে লিখেছেন যে, উক্ত আয়াত দ্বারা অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করতে পারবে না একথা প্রমাণিত হয় না। অথচ চার মাযহাবের সকল ইমামগণের মতামত হলো, অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবে না। (তাফহীমুল কুরআন খ: ৫, পৃ:২৯২)
অধিকন্তু ডা. জাকির নায়েক একটি উদ্ভট উক্তি করেছেন। যার সারসংক্ষেপ হলো, অমুসলিমরা এমনিতেই অপবিত্র। যদি অপবিত্র অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা না যায়, তাহলে কোন অমুসলিম ব্যক্তি ৮০-১০০ টাকা দিয়ে কুরআনের একটি কপি ক্রয় করে হাতে নিলে আয়াতের মর্ম ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে। তাই এ অর্থ করা যাবে না।
কতবড় অজ্ঞ লোকের পক্ষে এ কথাটি বলা সম্ভব তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আয়াতের প্রকৃত মর্ম হচ্ছে, অপবিত্র লোক কুরআন স্পর্শ করতে গেলে যে অক্ষম হয়ে যাবে বা তার হাত বিকল হয়ে পড়বে, কখনো সে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না, এমনটি নয়; বরং এটা ডা. জাকির নায়েকের এ আয়াত নিয়ে উপহাস বা ধৃষ্টতা। এ কথা সকলেই বুঝে যে, অপবিত্র লোক কুরআন স্পর্শ করতে পারবে না। এর অর্থ হচ্ছে, স্পর্শ করা নিষেধ বা অবৈধ। এটা কি কোন দলীল দ্বারা বুঝানোর প্রয়োজন আছে? এমন হাস্যকর উক্তি ডা. সাহেবের মত একজন ডাক্তারী বিদ্যায় অভিজ্ঞ লোকও যে করতে পারে চিন্তাও করা যায় না।
সারকথা, জাকির নায়েকের উক্ত ফতোয়া সাহাবা ও তাবেয়ীন এবং মুজতাহিদ ইমামগণ যথা চার মাযহাবের ইমামদের সিদ্ধান্তের পরিপন্থি এবং তার ফতোয়া মূলত লা-মাযহাবীদের প্রবর্তক ইবনে হাজম জাহেরী ও জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী সাহেবের স্পষ্ট উকালতী।
এ ধরনের বহু ফিকহী বিষয়ে তিনি মওদুদী সাহেব ও লা-মাযহাবীদের উকালতী করেই যাচ্ছেন। (তুহফাতুল আল মাঈ শরহে তিরমিযী:১/৫১-৫২)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:২২