মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্বন্ধে বেশীর ভাগ মানুষই যা জানেন না তা হচ্ছে, স্যার একজন অসাধারণ লেখক হতে পারেন, তাঁর লিখা পড়ে সকলে রোমাঞ্চিত হতে পারেন, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তাঁর মত কাঠখোট্টা চরিত্র খুব কমই আছে।
স্যারের একটা সমস্যা হল তিনি ক্লাসের শেডিউল মনে রাখতে পারেন না। ইয়াসমিন ম্যাডাম (স্যারের সহধর্মিনি) সবসময় স্যারকে পথ দেখিয়ে ক্লাসে নিয়ে আসেন। ক্লাসে ঢুকেই স্যার দরজাটা একটু টেনে দেন। আমরা সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই এবং স্যার তাঁর শিক্ষকমূর্তি ধারন করেন।
স্যার আমাদের যে কোর্সটি পড়াতেন তাঁর নাম এলিমেন্টারি কুয়ান্টাম থিওরি। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। স্যার প্রথমদিন ক্লাসে এসেই ব্ল্যাকবোর্ডে খস খস করে একটা কটমটে সমীকরণ লিখলেন। এটা ছিল বিখ্যাত শ্রডিঙ্গার ইকুয়েশন। স্যার বললেন, “আমার এই কোর্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে এই ইকুয়েশন। তোমরা যাতে এটা ভুলতে না পার তাই আমি প্রতিদিন তোমাদের সামনে এটা একবার করে লিখব”। হয়েছিলও তাই। কোর্সের শেষদিন পর্যন্ত স্যার সমীকরণটা লিখতে বিলম্ব করেন নি।
স্যার ক্লাসে মাঝে মাঝে রেগে যেতেন। উনি বোর্ডে লিখতেন আর পড়াতেন আর আমরা অনেকে হাঁ করে বসে থাকতাম। একদিন পড়া শেষে স্যার জিগ্যেস করলেন কারো কোন প্রশ্ন আছে কিনা। আমরা কেউ কোন জবাব দিলাম না। স্যার এবার জিগ্যেস করলেন আমরা কি সব বুঝে গিয়েছি নাকি কিছুই বুঝি নাই। আমরা এবারও কোন জবাব দিলাম না। স্যার এবার রেগে-মেগে বললেন, এমন সহজ বিষয় বুঝতে না পারলে আসলে স্ট্যান্ডার্ড লেভেলের পড়াশুনা আমাদের জন্য না!
ক্লাস টেস্টও কম ঝকমারি না। একদিন হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন পরীক্ষা দাও। আমরা সবাই বজ্রাহতের মত উত্তর করার চেষ্টা করলাম। পরীক্ষা শেষে স্যার বললেন, “ঘাবড়ানোর কিছু নাই তোমরা সবাই দশে দশ পেয়েছ, যাও খাতার উপর দশে দশ লিখে দাও”। আমরা তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
তবে স্যারের ক্লাসে মজাও কম হত না। ইয়াসমিন ম্যাডাম সবসময় ক্লাসের পেছনে বসে থাকতেন। মাঝে মাঝেই নানা ব্যপারে তাদের দুজনের মাঝে বচসা হয়ে যেত, সেটা আসলেই দেখার মত দৃশ্য হত! ম্যাডাম বকে যাচ্ছেন আর স্যার মাঝে মাঝে দুই এক কথার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছেন, আমরা হাসতে হাসতে শেষ!
জাফর স্যারের গুনমুগ্ধের অভাব নাই। আমার মতে তাঁর নিন্দুকের সংখ্যাও আশাতীত রকমের বেশী। কিন্তু কেউ একটা জিনিস বুঝতে চায় না, তিনি কোন দেবতা নন যে তাঁকে দেবজ্ঞানে পূজা করতে হবে, তিনি কিছু ভুল করলে মাতম ফেলতে হবে। ভালো-খারাপ সবকিছু মিলেই তো মানুষ। আর তিনিও একজন মানুষ, একজন মেধাবী বিজ্ঞানী, একজন অসাধারণ লেখক, একজন ভীতিকর শিক্ষক।