somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বঙ্গবন্ধু হত্যা : সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা

২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০:০০আপডেট : ২৪ আগস্ট, ২০১৫ ০২:২৩:৫৯

মে. জে. (অব.) এটিএম আবদুল ওয়াহ্‌হাব

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে আমি চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলাম। ওই দিন সকাল ৭টায় রেডিও খুললেই শরিফুল হক ডালিমের কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাই। তিনি বলতে থাকেন, 'স্বৈরশাসক শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।' সঙ্গে সঙ্গে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তার টেলিফোন ব্যস্ত পাই। আমি টেলিফোন অ্যাক্সচেঞ্জে টেলিফোন করলে তারা জানায় ব্রিগেড কমান্ডার ঢাকার খবর জানেন। আমি তখনই আমার ইউনিটের কোয়ার্টার গার্ড ও সৈনিকদের সতর্ক করি এবং অফিসে চলে আসি। একটি স্কট নিয়ে ব্রিগেড হেডকোর্টার্সে আসি। সেখানে দেখি ব্রিগেড কমান্ডার একা পিএ'র রুম থেকে ডিজিএফআই ডিজি ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করছেন। ব্রিগেড কমান্ডার বলছেন, সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর টেলিফোন বিচ্ছিন্ন। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাসায় অবস্থান করছেন না। আরও বলতে শুনি জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।

সেনা বাহিনীর কোনো ইউনিট মুভ করলে জিএস ব্রাঞ্চের অনুমতি লাগে। সেনা সদর তথা এমও ডাইরেক্টর, এমআই ডাইরেক্টর, ট্রেনিং ডাইরেক্টরের অজান্তে কোনো ইউনিট মুভ করতে পারে না। তার ওপরে ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারিসহ মুভ। প্রথম বেঙ্গল ক্যাভেলরি ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ডে দায়িত্ব পালন করে। এই ইউনিটের নেতৃত্ব দেয় যথাক্রমে মেজর ফারুক ও মেজর রশীদ। এই দুটি ইউনিট ৪৬ ব্রিগেডের অধীন। ৪৬ ব্রিগেডও ইউনিটদ্বয়ের মুভ সম্পর্কে কিছুই জানত না। ডিজিএফআই এই মুভ সম্পর্কে কিছুই জানত না। এখন প্রশ্ন হলো, এসব ইউনিটের কর্মরত অধিনায়ক কারা ছিলেন, তাদের কী দায়িত্ব ছিল এবং তারা ব্যর্থ হলেন কেন? এসব ইউনিটের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের দেশবাসী জানেন। কোনো ইউনিট ঊর্ধ্বতন অথরিটির লিখিত আদেশ ছাড়া যেন মুভ করতে এবং গুলি চালাতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা ছিল ওই অধিনায়কদের। ইউনিটদ্বয় বেরিয়ে বর্তমান হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জড়ো হয়। সেখানে তারা টার্গেট ঠিক করে ও রিগ্রুপিং করে। ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসা ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এরপরও সেনা সদর বা ডিজিএফআই কিছুই বুঝতে পারল না।

প্রত্যেক অধিনায়কের অভিজ্ঞতা অপর্যাপ্ত ছিল; যেমন সেনাপ্রধান/উপ-সেনাপ্রধান, যুদ্ধ শুরুর আগে ছিলেন মেজর পদমর্যাদায়। দেশ স্বাধীনের পর কোনোরকম কমান্ড বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই মেজর জেনারেল র‌্যাংকে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার ও কর্নেল পদে হাতেগোনা দুই-তিনজন মাত্র বাঙালি ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে বন্দী অবস্থার অফিসার-সৈনিকরা ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দুই-তিন বছর জেল খেটে তারা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন। বাংলাদেশে ফিরে দেখলেন মুক্তিযোদ্ধারা দুই বছরের সিনিয়রিটি পেয়েছেন। এতে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা মানসিকভাবে নিজেদের ছোট ভাবতে থাকেন। দুই-এক বছর চাকরি করার পর যখন দেখল তাদের অবস্থান দৃঢ় তখন তারা বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন কামনা করে ও সুযোগ খুঁজতে থাকে। তারা একটা বড় সুযোগ পেয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান একই কোর্সের হলেও মেধা তালিকা মোতাবেক মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর চেয়ে সিনিয়র ছিলেন। অথচ সেনাপ্রধান হলেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। অন্যদিকে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর সেনাপ্রধান হওয়া মেনে নেননি। সেনাবাহিনীতে সিনিয়র কেউ অতিক্রান্ত হলে তাদের অবসর দেওয়া হয় কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। উপপ্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিশেষ কোনো ডিউটি ছিল না। তিনি পাকিস্তান ফেরত সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে অফিসে দেনদরবার করতেন। জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখন পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন অফিসাররা রাতারাতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। এখন জিয়াকে না হলেও তাদের চলে! তাদের ভিত এখন শক্ত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ একটা গৌরবের ব্যাপার। পাকিস্তান ফেরতরা এই গৌরবকে ধূলিসাৎ করতে চায়। উইকিলিকসে বাংলাদেশ পুস্তকে দেখলাম একজন পাকিস্তান ফেরত মেজর পরে জেনারেল যিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন তিনিও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চান না, তিনি চান বিএনপিকে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যুদ্ধকালীন সময় জুনিয়র নেতৃত্ব তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেননি। তারা তার বিরোধিতা করেছেন। অপরপক্ষে সিনিয়র নেতৃত্ব মোশতাক আহমদ তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব মনেপ্রাণে মেনে নেননি। তিনি কলকাতায় বসে আমেরিকান কনসুলেটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে তৎপর ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর জুনিয়র নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরে। জুনিয়র নেতৃত্ব ও মোশতাক আহমদ বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে কানভারি করেন। মোশতাক আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ চাননি যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসুক। ছাত্রজীবনে শরিফুল হক ডালিম মোনায়েম খানের ছাত্রদল এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট) করত। দেশ স্বাধীনের পরে পূর্বশত্রুতার কারণে কুমিল্লার এক আওয়ামী লীগের এমপির বাড়ির জানালা দিয়ে স্টেনগান রেখে তাকে বন্দী ও নির্যাতন করে। এটা একটা গুরুতর অপরাধ ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডালিমকে আর্মি এক্যাট-১৬ ধারা মতে চাকরি থেকে বিদায় দেওয়া হয়। ওই সময় একদিন মেজর নূরের অফিসে আমি অবস্থান করছিলাম। মেজর নূর এমও ডাইরেক্টে কর্মরত ছিল। সে কুমিল্লায় মেজর ডালিমের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করছিল। আমি সেই আলাপ শুনি। মেজর নূর মেজর ডালিমকে বলে যে, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাদের সঙ্গে আছেন। তাদের কোনো ভয় নেই। মেজর নূরকে পরে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৫ আগস্ট এই মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার রশীদ, মেজর রাশেদ চৌধুরী ও অন্যরা বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণ করেন। তারা সবাই শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চাকরি থেকে বহিষ্কৃত ছিল। ক্যাপ্টেন ডালিম ও ক্যাপ্টেন নূর দুজনই পর্যায়ক্রমে কর্নেল এমএজি ওসমানীর এডিসি ছিল ও তার প্রিয়ভাজন ছিল। একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নৈতিকতার অবমাননা হবে। একজন ক্যাপ্টেন যুদ্ধের সময় নিজে নিজ পায়ে গুলি করে আহত হয়ে হাসপাতালে কালযাপন করেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থাকেন। এ একটি কোর্ট মার্শাল অপরাধ। তাকে কর্নেল ওসমানী বীরউত্তম খেতাব প্রদান করেন। ১৫ আগস্ট ওই অফিসার ঢাকায় একটা পদাতিক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন। তখন ব্রিগেড কমান্ডার তাকে তার ব্যাটালিয়নকে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। তখন তিনি বলেন, তার ডায়রিয়া হয়েছে। তিনি এ কাজ করতে পারবেন না। আর্মির আইন অত্যন্ত কঠিন, দুর্বল নেতৃত্বের কারণে এগুলোর প্রয়োগ হয়নি। মেজর ডালিম ও মেজর নূরকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা উচিত ছিল। তা না করে আর্মি এক্যাট-১৬ মাধ্যমে একটিমাত্র পত্র দিয়ে বিদায় দেওয়া হয়। বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সাহস পেত না। যাদের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয় তাদের শাস্তি প্রদান কঠিন হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের বন্ধু হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকায় নিযুক্ত সিআইএ স্টেশন চিফ মার্কস ফিলিফসের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডে মদদ জুগিয়েছিলেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও সংসদ সংদস্য।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:০১
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×