somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জাহিদুল হক শোভন
এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

গল্প: ঘুণপোকা

১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তিন বছরের মেয়েকে ফেলে দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার গড়েছিলাম। তবু এই বিশাল শহরের মাঝে আমার জানালার ফাকে একটুও রোদ এসে ধরা দেয়নি। শুধু তার আবছা আলোটা আমাকে দুর থেকে লোভ দেখিয়ে বলে যায় “তিয়ানা আমাকে স্পর্শ করার তোর এতো সখ কেনরে?” আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখে জল চলে আসে এই অনুভুতির শোকে। আমার বুকের ভিতর সেই ছোট বেলা থেকে এক যন্ত্রনা আশির্বাদ হয়ে জন্ম হয়েছে। এই প্রভাতে আমি ছাদের রেলিং ছুয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সাজ সকালের নিরবতায় নিশব্দ কান্নায় ভোরটা কেন যেন উপভোগ করতে ইচ্ছে হলো। কিছুক্ষন পর পর শিতল বাতাস এসে আমাকে ছুয়ে শিহরিত করে তুলছে। এই রকম শিহরিত হয়ে আমি বহুবার হারিয়েছি যখন আদনান আমার পাশে ছিল। আমি এই বিশাল অনুভুতিতে আর এমন গভীরতায় হারাতে চাইনা। গতকাল রাতে একটা সুইসাইড নোট লিখেছি। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি “ হে নীল আকাশ আমাকে তোমার করে নাও। আামি তোমার মত এই বিশাল পৃথিবীর মাঝে অবচরণ করে অপ্রাপ্তি থেকে পূর্ণতার খাতায় নাম উঠিয়ে নিশ্বাস নিতে চাই। আমার বিশ্বাসের প্রতিটা পাতায় যে নীলে/বীষে আবদ্ধ হয়ে আছে।”
.
আদনান আমার প্রথম স্বামী। ওর সাথে আমার পরিচয় হয় যখন সদ্য কলেজ জীবনের গন্ডি পেরিয়ে অনার্সে ভর্তি হই। কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ভালোবাসে বা পছন্দ করে এসব কিছুই অনুধাবন করে বুঝতে পারতাম না। একটা মানুষকে মন থেকে গভীরভাবে কিভাবে ভালবাসতে হয় কিভাবে নিজের মাঝে প্রিয় মানুষটার নাম যত্ন করে রাখতে হয় আদনানের সাথে পরিচয় না হলে এসবের কিছুই উপলব্দি করতে পারতাম না। ছবি আঁকা তার নেশা ছিল। যতবার ওর ছবি আঁকা দেখেছি ততবার অন্তহীন জীবনে একটা মুগ্ধতা আমার মাঝে ছড়িয়ে যেত। যেখানেই যেত ছবি আঁকার নানা উপক্রম তার সাথে থাকতো। ঐবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্র প্রদর্শনীর একটা আয়োজন করা হয়। আমি সেদিনই তার আঁকা প্রথম পাঁচটা ছবি দেখেছিলাম। সে প্রকৃতির ছবি আঁকতো, একটা মানুষ কষ্ট/অভাবে থাকা সত্ত্বেও প্রাণ খুলে কিভাবে হাসতে পারতো সে সব ছবি আকঁতো। তার একটা ছবি আমাকে বেশ আকর্ষিত করেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্থানী পৈশাচিকরা এই সবুজে ঘেরা মানুষের উপর যে নির্মমতা করেছিল তার মধ্যে কত মা, বোনের জীবন নষ্ট হয়েছিল আমার জানা নেই। একটা বাচ্চা তার মৃত মায়ের দুগ্ধ পান করছিল। কি চমৎকার ভাবে ছবিটা এঁকেছিল। বাচ্চাটি তখনও জানে না তার মা এই পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই। শত রঙ এ রাঙ্গানো এই পৃথিবীর মাঝে কত মিথ্যে আলো আমাদের মাঝে মিশ্রিত হয় জন্ম না নিলে বুঝতামই না। ছবিরি নিচে ডিপার্টমেন্ট আর নাম লিখা ছিল। আদনান ছিল একাউন্টস ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। আর আমি ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল একাউন্টস বিভাগের ছাত্র হয়ে কিভাবে এতো সুন্দর করে ছবি আঁকে? একদিন ওর সামনে গিয়ে বলেছিলাম “আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?” ও আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিল। ওর তাকানোর ভাবটা এমন ছিল যে আমি ওর থেকে কিছু মূল্যবান জিনিস চেয়েছি। তার কুকড়ানো চুল ছিল। কত গল্প পড়েছি যারা ছবি আঁকে তারা পাঞ্জাবী পড়ে, কাধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখে। তাদের কেউ কেউ চশমা পড়ে। তাদের চুল কুকড়ানো হয়। কিন্তু ও পাঞ্জাবী আর চশমা পড়তো না। সে হাত ঘড়ির দিকে একটু দেখে আমাকে বলেছিল “ কি বলবেন বলেন তবে এক মিনিটের বেশি নয় ঠিকাছে?” আমি একটু অবাক হয়ে আচ্ছা ঠিকাছে বলে বললাম “না তেমন কিছু বলবো না, শুধু একটা কথা জানতে চাই আপনি হিসাব বিভাগের ছাত্র হয়ে এমন ভয়ানক সুন্দর ছবি আঁকেন কি করে?” সে আমার কথা শুনে একটা হাসি দিয়ে প্রতুত্ত্যর দিল “আপনি চুল বেনী করে রেখেছেন কেন দুপাশে?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। হুট করে কেন এই কথা বললো? তারপর ইতস্তত হয়ে বললাম “আমি এইভাবেই রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। চুল খোলা বা খোপা করে রাখলে বার বার চুল ঠিক করতে হয়” সে হাসতে থাকে। এরপর আমি আর কিছু বলিনি। আমার চুপ থাকা দেখে সে আামার দিকে কিছু্ক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো “ আপনি যে কতবড় বোকা মেয়ে তা কি জানেন?” আমি মাথা নেড়ে না সূচক ইশারা দেই। আমার আর একটুও কথা বলার ইচ্ছা হচ্ছিল না। কেমন জানি অসস্থি লাগছিল। তারপর সে আবার বলতে লাগলো “এই শহরের বেশির ভাগই মানুষ নিজের ভালোটা/ সুন্দরটা দেখতে পায় না। আপনি হয়তো কখনো নিজেকে খেয়াল করে দেখেননি বা কেউ আপনাকে বলেনি। আপনি কি জানেন চুল বেনী করা থেকেও চুল খোলা রাখলে আপনাকে কেমন দেখাবে?” আমি উদ্ভেগপূর্ণের সহিত চুপ করে রইলাম। তার এই অপ্রসাঙ্গিক কথাবার্তা একটুও মনোহর লাগছিল না। এরপর আমি আর কথা না বলে চলে আসছিলাম তখন সে আমাকে থামিয়ে বলে “ শুনুন শুনুন স্যরি একটু বেশি বলে ফেলেছি। ছবি আঁকা আমার এক ধরণের সখ।” তারপর কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে “একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না। আপনার চেহারায় কি যেন একটা নেই।” আমি বলতে চেয়েছিলাম কি নেই? কিন্তু তা বলার ইচ্ছা জাগেনি। আমি প্রতুত্ত্যর না দিয়েই পা চালাই। এরপর ওর সাথে আমার আর কথা হয়নি। ঠিক সাত দিন পরে আদনান আমার ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছিল। আমি ওকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি সে আমাকে ডাক দিয়ে বলে “ আরে আরে এইযে দাঁড়ান, কোথায় যাচ্ছেন? আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আপনাকে বলেছিলাম না আপনার চেহারায় কি যেন একটা নেই। এটা দেখুন তো।” ও আমার হাতে একটা আঁকা ছবি দেয়। আমি খুব ভালো করেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলাম বাকরুদ্ধ হয়ে। বৃষ্টির মধ্যে চোখ বন্ধ করে দু হাত মেলে আকাশের দিকে মুখ করে বৃষ্টিকে অনুভব করা আমি। আমার বাকরুদ্ধ অবস্থা দেখে সে বলেছিল“ আপনার গালে একটা তিল থাকার দরকার ছিল। এই একটা জিনিসই আপনার চেহারায় নেই। এই ছবিটায় আমি তিল দিয়েছি। আচ্ছা যাই কেমন।”
.
সেদিনের পর থেকেই একটা নিরবতার আলো আমার নিদ্রার মাঝে উপস্থিত হয়। আমি ঘুমোতে পারি না। অন্ধকার ঘরে আশ্রয় খুঁজি আমার নিদ্রা থেকে নিরবতার আলোকে বের করতে। দুর্বার গতিতে দিন অতিক্রম হতে থাকে। একদিন আমি তাকে জানাই “এরপর আপনি যত ছবি আঁকবেন আমাকে দিবেন।” সে ঠিকি আমাকে তার আঁকা ছবি দিত। যত দিন পার হতো এই আঁকা ছবির প্রতি তত দূর্বল হয়ে পড়তাম। ছবি দিতে দেরি হলে বলতাম“ এতো অপেক্ষা করতে ভাল্লাগেনা। এখানে আমাকে ছন্নছড়া/উন্মাদ বললেও ভুল হবে না। একটা মানুষ কি করে আঁকা ছবির প্রতি দূর্বল হয় তা হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না। আঁকা ছবির প্রতি ভালো লাগা থেকে আদনানকে ভালো লাগার জায়গায় নিতে আমার মন একটুও কার্পন্যবোধ করেনি। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে একজন মেয়ে হয়ে আমি নিজেই একজন ছেলের নিকট আমার ভালো লাগার কথা জানাই। তারপর থেকেই অনুধাবন করেছিলাম কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। ভালো লাগার জন্য যে কোন একটা কারণ/গুন থাকে। সেই বিষয়টার প্রতি ভালো লাগা তৈরি হলে আস্তে আস্তে মানুষ্টার প্রতিও ভালোলাগা তৈরি হয়।
.
রাতের বেলা এই ব্যস্ত শহরকে নিরবতা গ্রাস করে। আমি যে শহরটায় দুতলা বাড়ির ছাদে এই সাজ সকালে বিরাজ করছি সেটা ইতালির একটা ছোট শহর সিরোলো। পাহারের মাঝেই অবস্থান এই শহরের। সবুজ পাহারে ঘেরা এই শহরের সমুদ্র সৈকত আমাকে কেমন যেন কাছে টানে। ইচ্ছে করে পৃথিবীর তৈরি করা নিয়ম আর সময়কে অবজ্ঞা করে এই নীল সমুদ্রের মাঝে নিজেকে তলিয়ে দিতে। কিন্তু আমি পারি না। আমার মাঝে বেড়ে উঠা আরেকটা জীবনের জন্য। আমি আট মাসের অন্তসত্তা। নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলেও আমার মাঝে যে জীবনটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে সে আমাকে বাধা দেয় আকড়ে ধরে। আমার মেয়ে এখন কি করছে, কেমন আছে, সে কি আমার জন্য কাদে তার কিছুই আমি জানি না। এই পৃথিবীর দু পায়ে দৈত্য/মানুষকে চেনা যায় না, বুঝা যায় না। তারা মুখোশ পড়ে মিশে থাকে মানুষের অনুভুতির দেয়ালে। আমি রুমে চলে যাই। জানালার ফাক দিয়ে শো শো করে এই পাহারের বাতাসের শব্দটা ধেয়ে আসে। ইদানিং এই শহরের সমস্ত কিছুতেই আমার স্ব শরীরে এক বিষন্নতা ছুয়ে যায়। ইচ্ছে করে সমস্ত কিছু ফেলে দিয়ে আমার নিজ শহরে পারি দেই। যে শহরের বাতাস কতদিন আমি গ্রহণ করি না। বৃষ্টিতে ভিজি না। কুয়াশাচ্ছন্ন পথে খালি পায়ে হাটি না। এসব ভাবতেই আমার শরীরটা ঝিম মেরে যায়। মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার বাবা থেকেও নেই। বাবার স্নেহ/ ভালোবাসা সবটুকুই আমার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমি যখন একটু একটু হাটতে পারি তখন নাকি বাবা, মাকে আর আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। বাবা মাকে কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিল কোথায় গিয়েছিল কেউ জানতাম না। আমার মা কি এক যন্ত্রনার মাঝে আমাকে একটু একটু করে বড় করেছে তা একমাত্র আমিই উপলব্দি করতে পারি। যখন আমি এস. এস. সি পাস করে কলেজে এডমিট হয়েছি তখন মার কাছে একটা চিঠি আসে। বাবার চিঠি। সেখানের একটা লাইন মায়ের মনকে কোন অনুভুতিতে নিয়ে গিয়েছিল তা আমি এখনো অনুধাবন করে বুঝতে পারিনি। নিশব্দ কান্নায় মা আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি বলতে লাগলাম “কি হয়েছে তোমার?” মা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেছিল “আমি তোর বাবার পছন্দের ছিলাম নারে। মানুষটা আমাকে বললেই পারতো। বিয়ের আগে কখনো প্রেমে জড়াইনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিয়ের পরেই প্রেম করবো। কিন্তু দেখ যেই মানুষটাকে বিয়ের পর মন উজাড় করে নিজের করে নিয়েছিলাম আজ এতো বছর পর সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছে। বিশ্বাস কর তবুও মানুষটার প্রতি কেন যেন আমার একটুও ঘৃনাবোধ তৈরি হয়নি একটুও না।” আমি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকি। মাকে শান্তনা দেওয়ার মত কোন শব্দই আমার জানা ছিল না। এই পূর্ণতার পৃথিবীতে কারো কারো জীবনে অপূর্ণতার জায়গা হয়।
.
আদনানকে আমার ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলাম কিন্তু সে কোন গুরুত্ব না দিয়ে আমাকে একটা উপেক্ষার মাঝে ফেলে রেখেছিল। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। এই যান্ত্রিক শহরে বেড়ে উঠা দালান কোঠার মাঝে নিজেকে জরাজীর্নের মাঝে আবদ্ধ করেছিলাম। মধ্য রাতে অন্ধকার ঘরে অবহেলার শব্দগুলো আমাকে ঠিক মত ঘুমাতে দিত না। এই অবহেলার শব্দগুলো দ্বিতীয়বার আর কাউকে ভালো লাগাতে আমাকে সাহস দেয়নি। বছর পাল্টাতে থাকে। অনার্স কমপ্লিট করার কয়েক মাস আগে একদিন সে হুট করেই আমার সামনে এসে বলে “আমাকে বিয়ে করবে?” মেঘলা আকাশের মত আমার চেহারায় একটা ছাপ তৈরি করে চুপ করে ছিলাম। আমি কোন পাত্তা না দিয়েই যেই পা বাড়ালাম তখন সে বললো “আমি যে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি তার প্রতিশোধ নিবে না? আমি তোমাকে অনেক কাঁদিয়েছি, তুমি আমাকে বিয়ে করে সারাজীবন কাঁদাইয়ো কেমন?” আমি ওর দিকে ফিরে তাকাই। আমার চোখে জল চলে আসে। রাগে অভিমানে তার গালে একটা চড় মেরেছিলাম। বিয়ের পর নিজের মত করে নিজ হাতে সংসারটা সাজিয়েছিলাম। এই পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আমার জানালায় হাজির হয়েছিল। অনুভুতির গভীরে কতশতবার হারিয়ে নির্ভুল শব্দ বুনেছিলাম। আদনানকে বিয়ে করার তিন বছর পর আমার মেয়ে হয়। সারাদিন সে অফিসে থাকতো। অফিস থেকে কখন বাড়ি ফিরবে তার জন্য সারাটা দিন মুখিয়ে থাকতাম। আমার মেয়ের যখন দু বছর বয়স তখন সে চাকরির কারনে ফ্রান্সে গমন করে। আমার মনে একাকীত্ব ভর করে। প্রথম প্রথম খোঁজ নিলেও পরে সেটা কমতে থাকে। আমার কিছু ভালো লাগতো না। একদিন সে বলে “আমি জানি আমার প্রতি তোমার খুব রাগ। সারাটা দিন ব্যস্ত থাকতে হয়। আমার বস “জ্যাক অলিভার” বেটা আমাকে হাতছাড়া করতে চায় না।” আমি চুপ করে থাকি। সে আমাকে ফ্রান্সের প্যারিস শহরের গল্প শোনায়। বলে “ এখানে শীন নামে একটা নদী আছে। হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে। কি চমৎকার দেখতে শহরটা বুঝলা তিয়ানা। তুমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। এই নদীকে অনেকে রোমান্টিক নদী বলেও ডাকে। তার অবশ্য একটা কারণ আছে। গতকাল আমার বস জ্যাক আর তার বউ জেসিকার সাথে আসছিলাম। এই নদীর ব্রীজের উপর কোটি তালা আছে। জ্যাক আর জেসিকার মত অনেকে তালায় তাদের নাম লিখে নদীতে চাবিটা ফেলে দেয়। কারণ তারা বিশ্বাস করে, চাবি ছাড়া এই তালার মতই প্রেমিক প্রেমিকারা যুগলবন্দী রয়ে যাবে যতদিন বেঁচে থাকবে।” সে আমাকে কথা দেয় দেশে ফিরে সেই শহরের সমস্ত গল্প আমাকে শোনাবে। এদিকে তার ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। একাকীত্বটা আমাকে আরো গ্রাস করে। এই একাকীত্বটা দুর করতে আমার মেয়ের মাঝে সারাটা দিন ডুবে থাকতাম।
.
ফ্রেব্রুয়ারী মাসে বই মেলায় গিয়ে কয়েকটা বই কিনেছিলাম। বই পড়ার প্রতি আমার একধরনের নেশা ছিল। সারাটাদিন কেমন যেন একটা উদাসীনতার মাঝে কাটতো। আমার মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে রাতে গল্প উপন্যাস পড়ার মাঝে মগ্ন হয়ে যেতাম। সেবার ইকবাল আহমেদ এর একটা উপন্যাসের বই কিনেছিলাম। উপন্যাসটার নাম ছিল গাংচিল। কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে আমাকে নিয়েগিয়েছিল বইটা। আমার সমস্ত উদাসীনতা একাকীত্ব ক্ষানিক সময় যতক্ষন পড়তে থাকতাম ততক্ষন উদাও হয়ে যেত। উপন্যাসটা মূলত একজন বাবাকে নিয়ে লেখা। পড়ার সময় কতবার আমার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে জানা নেই কিন্তু লেখাটার প্রতি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। উপন্যাসটা পড়ার পর লেখকের নিকট আমার একটা চিঠি লেখার ইচ্ছা হয়েছিল। লিখবো না লিখবো না করেও লেখক পরিচয় থেকে ঠিকানাটা নিয়ে চিঠি লিখেছিলাম।
.
প্রিয়,
ইকবাল আহমেদ।
.
এবারই প্রথম আপনার উপন্যাস পড়েছি যেটার নাম ছিল গাংচিল। আপনার লেখার হাত যে একেবারে নিখুত সেটার ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। আপনার লেখা যতটা আমাকে শিক্ত করেছে তারচেয়ে দ্বিগুন আপনার লেখার প্রতি বিরক্ত হয়েছি। আপনি আামাকে চিনবেন না। উপন্যাসে একজন বাবাকে নিয়ে অনেক অনুভুতি তুলে ধরতে আপনার কমতি ছিলনা। কিন্তু আপনি কি জানেন এই শহরের ভোরের আলো একজন বাবাকে ছাড়াও দেখা যায়? বাবাকে ছাড়াও আকাশে আলোড়ন ছড়িয়ে প্রশান্ত কল্পনার ঘর বুনা যায়। বাবা কি? একজন মেয়ের নিকট তার বাবা বা একজন স্ত্রীর নিকট তার স্বামী কতটা গুরুত্বপূর্ণ সব বাবারা কি সেটা জানে? বুঝে? বাবার আদর, ভালোবাসা কি আমি এর কিছুই জানি না। ছোট বেলা থেকেই বাবাকে স্ব নয়নে দেখিনি। একজন সন্তানের নিকট শৈশব কালে বাবার অস্তিত্বটা বা আলোচ্ছটা নয়নে নয়নে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে তার একটুও আমি পাইনি। আমার বয়সি অন্য ছেলে মেয়েরা যখন তাদের বাবার সাথে হাসতো, কথা বলতো, মেলায় যেতো আমার খুব লোভ হতো হিংসা হতো। সবাই পারলেও আমি পারতাম না। তবুও দেখুন দিব্ব্যি আমি বেশ আছি। আপনি হয়তো আমার চিঠি পেড়ে বিরক্ত হচ্ছেন বা আমাকে পাগল ভাবতে পারেন। আপনাকে হয়তো আমার এমন চিঠি লিখা উচিৎ হয়নি। তার জন্য আমি মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। ভালো থাকবেন ইকবাল সাহেব।
.
ইতালির সিরোলো শহরে আমি আর দু মাসের মত আছি। যতদিন থাকবো এই সময়টা আমার একান্ত ব্যক্তিগত।এই শহরে যত অনুভুতির পাহাড় বুনেছিলাম এই সময়টুকুর মধ্যে সবটুকুই অন্ধকারের প্রতীক্ষায় দিন পেরোনোর মাঝে সন্ধ্যার স্তব্ধতাটায় বিলীন করে দিয়ে যাব এই শহরেই। দরজার কলিং বেলের শব্দ শুনেই আমি বললাম “দরজা খোলা আছে ভিতরে এসো।” এমেলিয়া ভিতরে এসে আমার হাত ছুয়ে বলে “ঘুম ভালো হয়েছে? কখন উঠেছো মেয়ে?” আমি মাথা নেড়ে বুঝাই একটুও ভালো হয়নি এমেলিয়া।” সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে “ঈশ্বর তোমার সহায়ক হোক। তোমার কিছুই হবে না। তুমি একদম স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সর্বদা ঈশ্বরকে স্বরন করো বুঝলে মেয়ে” আমি চুপ করে থাকি। এমেলিয়া আমার জন্য সকালের নাস্তা আনতে চলে যায়। ওর সাথে আমার যত কথা হয়েছে ইতালীয় ভাষায় হয়েছে। বিয়ের সাত বছর পার হওয়ার পরও এমেলিয়ার সংসারে কোন সন্তান আসেনি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার সন্তান জন্ম হওয়ার পরই এমেলিয়াকে দিয়ে দিব। অবশ্য তাকে বলেছি “জন্ম দেওয়ার পর ওকে তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও। একটা বারের জন্যও তুমি ওকে আমাকে দেখাবে না।” এমেলিয়া বলেছিল “ ওর প্রতি তোমার এতো অভিমান কেন?” আমি কিছু বলতে পারিনি। অনেকক্ষন পরে ইতস্তত হয়ে বলেছিলাম “আমার বাচ্চাটার প্রতি কোন অভিমান রাগ নেই। ওকে আমি মন থেকেই দোয়া করি যতদিন এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে ততদিন যেন ওর ঝামেলা না হয়। তুমি আমার বাচ্চাটাকে অনেক ভালোবাসবে।
.
ইকবাল আহমেদকে চিঠি দেওয়ার এক সপ্তাহ পর আমার কাছে চিঠির প্রতুত্ত্যর আসে। আমার কাছে যে চিঠির রিপ্লায় আসবে সেটার আশা আমি ঘুনাক্ষরেও করিনি। তাতে লিখা ছিল…
.
প্রিয় তিয়ানা।
.
আমার বরাবরে এমন একটা চিঠি আসবে সত্যিই আমার ধারনা ছিলনা। আপনার চিঠিটা পড়ে আমি অনেকটা পুলকিত হয়েছি। এমন চিঠি আজকাল কেউ লিখে? আমার জানা নেই। আমার লেখা পড়ে আপনি বিরক্তবোধ হয়েছেন সেটা আমার লেখার ব্যর্থতা। আপনাকে প্রতুত্ত্যর দেওয়ার আমার কোন ইচ্ছা জাগেনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার মনে হলো বাবাদের নিয়ে আপনার অনেক ক্ষোভ আছে। এই ক্ষোভটা কেন, কিসের জন্য তা জানতে কেন যেন ইচ্ছা হয়েছে। আপনি কি খুব একা? আপনার কি অনেক কষ্ট? আমি ইতালির সিরোলো শহরে থাকি। প্রতি বছরে আমি বাংলাদেশে আসি এই সময়টায়। ফেব্রুয়ারী মাস পুরোটা সময় থাকি যতদিন বই মেলা থাকে। নিজের বই যখন স্ব চোখে কাউকে কিনতে দেখি কি যে ভালো লাগে আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না। এই লেখালেখির জন্য জীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণীর সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। বাবার কাঁধটা না অনেক অনেক বেশি চওড়া হয় জানেন। যদি চওড়া না হতো তাহলে কি করে এতো এতো দায়িত্ব/ দায়ভার ঐ কাঁধে বহন করে বয়ে বেড়ায়? এতো এতো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অনবরত চলতে থাকে তবুও সংসারের কাউকে বুঝতে দেয়না। বাবারা হচ্ছে সংসারের জন্য একটা বটগাছ। তার ডালপালা, পাতা দিয়ে সংসারটাকে বাহিরের রোদ থেকে সুরক্ষা করে ছায়ার মাঝে রাখে। অবশ্য একজন সন্তানের কাছে বাবা যে কত দামী যার বাবা নেই সে কিছুই অনুভব করতে পারবে না। ভালো থাকুন তিয়ানা। আশা করি আপনার কষ্টগুলো একদিন মুছে যাবে।
.
ইকবাল আহমেদের চিঠি পড়ে কোন মিথ্যে স্পন্দের বা ধূসর রঙ্গিন সময়ের আভা পাইনি। অবশ্য একজন সন্তানের নিকট বাবার গুরুত্ব কতটা বিশাল আমি বুঝিনা। এর কয়েকদিন পরেই ইকবাল আহমেদের নিকট চিঠি লিখি। আমি তাকে জানাই “আমার স্বামী, মেয়ে আছে। বাবাদের স্থানটা কোন পর্যায়ে নিয়ে স্থায়ীত্ব করতে হয় আমার জানা নেই।” তার লেখার প্রসংশা করি। আমার শৈশব জীবনের কথা লিখি তার নিকট। এরপর সে আবার আমার কাছে চিঠি লিখে। আমিও লিখতে থাকি। একটা ভালো বন্ধুত্ব হতে আমাদের বেশি সময় লাগেনি। ইতালি যাওয়ার আগে সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি নিষেধ করতে পারিনি। ইতালি যাওয়ার পরও ইকবাল সাহেব আমাকে চিঠি লিখে গেছে। কিন্তু ওকে আমি একজন ভালো বন্ধু ছাড়া আর কিছিই ভাবিনি। একজন মেয়ের বিয়ের পরও কি কেউ বন্ধু হতে পারে না? এই অধিকারটা নিশ্চয় সবার আছে। তবে বন্ধুত্বটা যেন বন্ধুত্বের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে সেদিক দিয়ে আমি খুব স্বজাগ থেকিছি। কিন্তু একটা সময় আমি উপলব্দি করলাম ইকবাল সাহেব আমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে। আমি চিঠি লিখার মাত্রা কমাতে থাকি। কিন্তু আমি তাকে ফোন নাম্বার কখনো দেইনি। ওর সাথে আমার চিঠিতেই কথা হতো। একটা পর্যায়ে আমি আর তার নিকট চিঠি লিখিনি বা চিঠির প্রতুত্ত্যর দেইনি। কারো সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই। কয়েকটা মাস অতিক্রম হয়। আকাশের মেঘ গুলো সরে যায় ক্রমাগত। একদিন হুট করেই আামার আাকাশ টা থমকে যায়। আমার দেয়ালের চারপাশের আলোটা অন্ধকার কালো ছায়ার রুপ নেয়। অপ্রাপ্তির যন্ত্রনা আামাকে ঘিরে ধরে। অনুভুতি গুলো ফ্যাকাশে হয়ে জমাট বাধে আমার হৃদয় স্পর্শ করার কান্নায়। আদনানের এক্সিডেন্টের খবর আসে। পুরো জগৎটা যেন কেপে ওঠে। আমি আমার মেয়েকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকি। আমার গড়ে তোলা পথটা একটা শূণ্যতার মাঝে ভর করে। তারপরের দিনই আদনানের মৃত দেহ দেশে আসে। ওরে জড়িয়ে ধরে আমি চিৎকার করে বলতে থাকি “এই আদনান তুমি না বলেছিলে দেশে ফিরে ফ্রান্সের শহরের গল্প শোনাবে। উঠ প্লিজ। প্লিজ উঠো। আমাকে এইভাবে ফেলে যেতে পারো না। তুমি না বলেছিলে বিয়ের পর তোমাকে সারাজীবন কাঁদাতে। আমার যে অনেক হিসেব নিকেশ বাকি তোমার সাথে। যে কষ্ট গুলো তুমি আমাকে দিয়েছো প্রত্যেকটা যে আমি বুঝে নিতে চাই। আদনান উঠো না তুমি। আমার কথা কি তোমার কানে যায় না?
.
রাত গুলো আমার কাছে ভয়ানক হতে থাকে। গভীর রাতে আদনানের স্মৃতিগুলো আমার চোখকে যন্ত্রণাকাতর করতে একটুও কার্পন্যবোধ করেনি। আমার দিন সময় কিভাবে কেটেছে এগুলোর কিছুই অনুধাবন করতে পারিনা। আমি রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে উপরে যিনি একজন সব কিছু দেখছেন, জানেন, তার নিকট চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলি “সে ছোট বেলা থেকেই একটা একটা আলো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো। আলোটা কেড়েই যদি নিবে তাহলে আলোটা খানিকের জন্য দিয়ে কি বুঝাতে চেয়েছো তুমি? কি পরীক্ষা নিতে চাও তুমি?
.
এমেলিয়া সকালের নাস্তা আমার জন্য নিয়ে এসে বলে “খেয়ে নাও মেয়ে? আমি তাকে বলি “পৃথিবীর মানুষগুলো এমন কেন বলতে পারো? একটা কিছু পাবার জন্য অন্য আরেকটা জিনিসকে ধংস করে ফেলে।” এমেলিয়া আমার কথায় কিছু বুঝলো কিনা আমি জানি না। তার চুপ থাকা দেখে বলি “আমাকে একটু সামনের পাহাড়টায় নিয়ে যাবে? অনেকদিন পাহাড় খুব কাছ থেকে দেখিনা।” এমেলিয়া বিকেলের দিকে নিয়ে যাবে বলে আমাকে কথা দেয়।
.
আদনান মারা যাবার পরের বছরই ফেব্রুয়ারী মাসে যথানিয়মে ইকবাল বাংলাদেশে আসে। এসেই ঠিকানা অনুযায়ী সে আমার বাড়িতে এসে দেখা করে। আমি তাকে সব খুলে বলি। দিন সময় পার হতে থাকে। ইকবাল আমাকে যতটা পেরেছে উদাসীনতা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেছে। জীবনের তীরটায় শত বাধা আসলেও তার থেকে আলোটাকে আবার কিভাবে জ্বালিয়ে তুলতে হয় সে সব গল্প শোনায়। আমি তাকে জানাই “জীবনটা তোমাদের গল্প উপন্যাসের মত না ইকবাল। জীবনটা রঙ্গিন মলাট নয় যে চাইলেই রঙ পরিবর্তন করা যাবে। আমি তাকে ফিরিয়ে দেই। কিন্তু একটা সময় আমার জীবনের সুর গুলোকে যত্ন নেওয়া, প্রতিটা ভোরকে একটা অবিরাম নতুন স্বপ্নে অবচরন করা, তার এই দায়িত্বগুলোকে আমাকে প্রেরনা জাগায় জীবনটাকে আবার নতুন উদ্যমে মনের ইন্দ্রজাল জাগ্রত করে স্বপ্ন বুনতে। কিন্তু তাকে আমি জানাই হয়তো নতুন করে স্বপ্ন বুনা যায় তবে যে স্বপ্নটায় একটা স্বতেজ প্রাণ ছিল সেটার মত কখনো ফিরে আসবে না। এরকয়েক মাস পরেই ইকবালের সহিত পথ চলতে একটা নতুন জীবন গড়াতে পদচারন করি। আমার মেয়েকে তার নানু জোর করে রেখে দিয়েছিল। আমি এই ইতালির সিরোলো পাহাড়ের শহরে চলে আসি। আমার পথ গুলো সময়ের হাত ধরে যেন বদলাতে শুরু করলো। চারপাশের দেয়ালে পরাজয়ের গন্ধ দুর হতে থাকে। কিন্তু বিধাতা কেন যেন আমার কপালে সুখটা বেশিদিন রাখেনি। যখন আমি পাঁচ মাসের অন্তসত্তা তখন ইকবালকেও বিধাতা নিজের আপন করে নেয়। আর আমার ঘরে আলোর লোভ দেখিয়ে আলোটা কেড়ে নিয়ে অন্ধকারটা ঠেলে দেয়। আমি পুনরায় আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্না করতে করতে বিধাতেকে বলি “ তুমি আমার সাথে খুব মজার খেলা খেলছো। এই খেলার শেষটা কোথায় আমিও দেখে নিব।”
.
বাচ্চা জন্ম দেওয়ার তিন দিন পরেই আমি আমার নিজ শহরে চলে আসি। আসার সময় আমার বাচ্চাটাকে একটাবারের জন্যও দেখিনি। এমেলিয়াকে শুধু এইটুকু বলেছিলাম “আমার বাচ্চাটাকে অনেক ভালোবাসা দিও” দেশে ফিরেই আমি একটা পরিচিত গন্ধ অনুভব করছি। আদনানেরর গন্ধ। আমার মনে হয় এই শহরের প্রতিটা জায়গায় আদনান বিস্তৃত হয়ে আছে। আমি প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেই। এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই আমি সোজা আদনানের কবরে যাই। তার কবরের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কান্না করতে করতে বললাম “তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তোমার তিয়ানা ঠকেছে আদনান ঠকেছে। তোমার কাছ থেকে আমাকে যে আলাদা করেছে, আমার মেয়েকে আলাদা করেছে তাকে আমি ছাড়িনি। আমি জানতাম না, ইকবাল আমাকে তার করে নেওয়ার জন্য এমন একটা খেলা খেলবে। তোমাকে হত্যা করবে। সে সব কিছু করে আমার কাছে এমন ভাব ধরেছিল যে সে কিছুই জানে না। দোষটা আমারই ছিল যদি না আমি তাকে চিঠি লিখতাম, আর যদি না তার সাথে আমার পরিচয় হতো। চারমাসের অন্তসত্তা হয়ে যখন একদিন ওর পার্সোনাল ডায়েরী আমার হাতে পড়ে তখনি আমি সব কিছু জানতে পারি। পুরো জগৎটা আরেকবার কেঁপে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাই। নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল। তীব্র ঘৃনা জন্মায় ওর প্রতি আমার। কার সাথে আমি দ্বিতীয় সংসার গড়েছি? এইটুকু বলে আমি আরো জোরে জোরে কান্না করতে লাগলাম। তারপর আবার বলতে লাগলাম “মানুষ এতো ছদ্মবেশী হয়ে কি করে থাকে বলোতো? যেদিন জানতে পারলাম সেদিন রাতে আমি একটুও ঘুমাইনি। তারপরের দিনই পাহাড় দেখার অভিনয় করে সেই সিরোলো শহরের সবচেয়ে বড় পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কাছে বায়না করি। পাহাড়ের খুব কাছ থেকে তাকে আমি ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলাম, যা ওখানের মানুষেরা মনে করেছিল পা পিছলে পরে গেছে। আমার ভিতরে যে বাচ্চাটি আস্তে আস্তে বড় হয়েছে তার তো কোন দোষ নেই। সে যদি আমার কাছে থাকতো বিশ্বাস করো আমি একটুও নিশ্বাস নিতে পারতাম না। তাকে দেখলেই জানোয়ারটার কথা মনে পড়বে। আমি তাকে ভুলতে চাই। এইটুকু বলে আমি আবার চুপ করে রইলাম। চোখের পানি মুছে আবার বলতে লাগলাম “দুইটা বিষের বোতল কিনেছি। আমি যদি তোমার কাছে আসতে চাই আমাকে কি ফিরিয়ে দিবে? বাসায় যাবো। আমার মেয়েটাকে অনেকদিন দেখিনা। ওকে একটা বার দেখবো। জড়িয়ে নিব। আমার প্রতি ও হয়তো ঘৃনা জন্মিয়েছে। অনুভুতি গুলো পচে শোকের রুপ ধারন করেছে। নীল ধ্রুবতারার অপেক্ষার প্রহর কাটেনি আমার অগোছালো সন্ধ্যায়। আলো আর অন্ধকারে প্রিয় মুখ গুলো মধ্যরাতে পৈশাচিক ছায়ায় ঘিরে ধরে। তুমি অপেক্ষা করো আমি খুব জলদি তোমার নিকট আসছি…
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৩
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×