ফাকরুল ভাই গ্যালগ্যাল করে হাসেন আমাকে দেখে। আমি একটু রুষ্ট হই।
"হাসেন ক্যান?" আমি কাঁপা কাঁপা হাতে গেলাস তুলে নিয়ে চুমুক দেই। "কুর্তা পরার শখ হয় না আমার? এই যে দ্যাখেন ... অ আ ক খ ল্যাখা, ভা-ভাষার মাসে কিনলাম, কিনে পড়লাম ... আর এই যে দ্যাখেন সালোয়ার, এক পায়া সবুজ আর এক পায়া লাল ... স্বাধীনতার মাসে কিনলাম ...।"
ফাকরুল ভাই তবুও হাসেন। আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়।
"আমি হাসি পুরানো কথা স্মরণ করে।" নিষ্কম্প গলায় বলেন ফাকরুল ভাই। "আমার পুরানো দিনের বান্ধবী খুররমার কথা মনে করে হাসি।"
"খুররমা?" আমি মুখ বিকৃত করি। "এইটা ক্যামন বিশ্রী নাম?"
"খুবই বিশ্রী।" ফাকরুল ভাই চুমুক দেন রামে। "খুররমা নিজেও বড় অপছন্দ করতো এই নাম। তাই তো ও এইটাকে ছোট করে নিয়েছিলো ... রমা!"
"হুমম।" আমি মাথা দোলাই। "রমা চলে!"
ফাকরুল ভাই মাথা ঝাঁকান বিমর্ষ মুখে। "চলে আর কি। খুররমা, সংক্ষেপে রমা, পড়াশোনা করেছে একেবারে স্বস্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, মণিপুরী নাচে, আবৃত্তি করে, শিল্পসংস্কৃতি চুঁইয়ে পড়তো একেবারে। ওর একটা বয়ফ্রেন্ড ছিলো, আসল নাম ভুলে গেছি, রমার পায়ে পায়ে ঘুরতো বলে সবাই বলতো রমাপদ ... ঐ রমাপদের সূত্র ধরেই রমা সাথে আমার খাতির। একদিন রমাপদ সত্যি সত্যি রমার পদ লাভ করে, মানে, লাথি খায়, আর আমি ওর পদে অধিষ্ঠিত হই, মানে, রমার বয়ফ্রেন্ডগিরির দায় চাপে আমার কাঁধে।"
"এতে হাসির কী আছে?" আমি চোখ সরু করে বলি।
"হে হে, একদিন ঠুস করে আমাদের প্রেম ভেস্তে গেলো।" ফাকরুল ভাই হাসেন গ্যালগ্যাল করে।
"এতেই বা হাসির কী হলো?" আমি দমি না।
ফাকরুল ভাই দম ন্যান। "আরে, একদিন পয়লা বৈশাখের আগের রাতে ফোন দিলো আমাকে, তারপর এমন এক উদ্ভট আব্দার ধরলো, আমি তো শুনে হতবাক। বলে, আমাকে রমনার বটমূলে যেতে হবে সাত সকালে, ওর গান শুনতে হবে বসে বসে, পান্তা দিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা খেতে হবে, তারপর ওকে নিয়ে রোদ মাথায় করে টো টো করে কোথায় কোথায় যেতে হবে, দুপুরে কোথাও খেয়েদেয়ে শেষে আবৃত্তি শুনতে হবে বিকালে ঘন্টাখানেক। আমি তো শুনেই ঘায়েল। সবশেষে আমাকে বললো, কুর্তাপায়জামা পরে যেতে। আমি মিনমিন করে রাজি হলাম সবকিছুতেই, সবার শেষে রমা এক অদ্ভূত অনুরোধ করলো। শুনে তো আমি তাজ্জব! বলে কী মেয়ে? স্বস্তি নিকেতন থেকে পড়েশুনে এসে এ কী বলে? লজ্জায় আমার দুই কান লাল হয়ে গেলো, কিন্তু প্রেমিকার অনুরোধ ফেলি কী করে?"
আমি দুই চুমুক গিলে বলি, "কী অনুরোধ?"
ফাকরুল ভাই বলেন, "শোন না। তো, ভেবেছিলাম ভোরে উঠবো, কিন্তু আমার ঘুমও সেইরকম ঘন, সূর্য অনেকখানি চড়ে ওঠার পর লাফিয়ে উঠেছি, উঠে ঘড়ি দেখে বুঝলাম, রমার গান নিশ্চিত মিস করেছি। কোনমতে যে পাজামা পরে ঘুমিয়েছিলাম, তার উপরেই বড় ভাইয়ের একটা ময়লা কুর্তা চাপিয়ে ... শেষে রমা যে অনুরোধ করেছিলো, সেটা রাখার পণ করে বগলে একটা খাম নিয়ে বেরোলাম।"
"কিসের খাম?" আমি শুধাই।
"শোন না।" ফাকরুল ভাই মুখ বিকৃত করেন। "বটতলায় পৌঁছে দেখি রমা এক কোণে দাঁড়িয়ে, ভয়ঙ্কর ক্ষ্যাপা, আমাকে দেখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে কি ... কী হলো, এতো দেরি কেন? আমি হাত জোড় করে বললাম, রাস্তায় বড় জ্যাম! রমা তখন বলে, আমি আর কী কী বলেছিলাম মনে আছে? আমি বললাম, এই দ্যাখো, কুর্তা পরে এসেছি, আর দ্যাখো, তলে কিন্তু জিনসের প্যান্ট না, পাজামা ... আর এই দ্যাখো, তুমি চটি পড়ে আসতে বলেছিলে, সময় পাইনি, সাথে নিয়ে এসেছি, এখন কোথাও বসে পড়ে নেবো ... । বলে খাম থেকে রসময় বাবু আর সুখময় বাবুর লেখা গোটা চারেক চটি বার করে ওকে দেখালাম। রমা কী বুঝলো কে জানে, ধপ করে চোখ উলটে একেবারে ফিট হয়ে পড়লো। আমি হাঁহাঁকরে ধরলাম ওকে, ঐ চটি দিয়েই বাতাস করে জ্ঞান ফেরালাম ... কিন্তু কী অকৃতজ্ঞ মেয়ে, ফিট থেকে উঠে আমাকে কষে একটা চড় মেরে হনহনিয়ে কোথায় চলে গেলো। পরে ফোন করে এই গুন্ডামির কৈফিয়ৎ চাইলাম, বলে আমি নাকি অ্যাতো বড় অসভ্য, পণের্া পত্রিকা নিয়ে ঘোরাফেরা করি ... যখন বললাম, আরে তুমিই তো আমাকে চটি পড়ে আসতে বললে, তখন বলে কি, আমাকে নাকি চটি পরে আসতে বলেছিলো কুর্তাপাজামার সাথে, মোটেও চটি পড়ে আসতে বলেনি, আমি ব-এ শূন্য র আর ড-এ শূন্য ড় এর তফাৎ বুঝি না, আমার মতো বর্বরের সাথে সম্পর্ক রাখার কোন ঠ্যাকা পরেনি ... উঁহু ভুল বললাম ... ঠ্যাকা পড়েনি ওর ... এই বলে ফোন রেখে দিলো ঠাস করে। কয়েকদিন বাদে দেখি আবার রমাপদের সাথে ঘুরছে।"
আমি গ্যালগ্যাল করে হাসলাম। "হে হে হে, শেষ পর্যন্তচটি নিয়ে ধরা খেলেন, তা-ও বান্ধবীর হাতে?"
ফাকরুল ভাই লাজুক হাসেন।