শাহবাগে মোড়ের গণজমায়েত বিষয়ে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ আপাতত লিখে রাখি
অরাজনৈতিক এই সম্মেলনের কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক চরিত্রহীনতা, সমেবেত মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহন প্রচলিত রাজনীতির প্রতি এক ধরণের অনাস্থার প্রকাশ। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে শাহবাগের মোড়ের জমায়েত বাড়তি কিছু অসুবিধা তৈরি করলেও সাধারণ মানুষ মানিয়ে নিচ্ছে। সাময়িক অসুবিধার সাথে আপোষ করে নিচ্ছে ক্রমাগত আপোষে জীবনযাপন করা মানুষেরা।
দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ এটাকে কভারেজ করতে আসা মিডিয়া বিষয়ে, কর্পোরেট মিডিয়ায় এক ধরণের সুশীল দেশোদ্ধারী এনজিও চরিত্র থাকে, সে চরিত্রে নারীর ক্ষমতায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিক্রয়যোগ্য ধারণা। মিডিয়া কভারেজে নারীকে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিদ্রোহের ভরকেন্দ্র হিসেবে, তাদের শ্লোগানে উত্তাল হাত আর ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ চেহারা নিয়মিত গণমাধ্যমে উপস্থাপিত হচ্ছে। নারী দীর্ঘ দিনের নিষ্পেষণের পরে পুনরায় সম্পূর্ণ সত্ত্বা নিয়ে এই আন্দোলনে উপস্থিত। বৈদেশে থাকা লোকজন নারীমুক্তির সংবেদ পাচ্ছে এই মিডিয়া কভারেজ দেখে, যদিও আফগানিস্তানে গণতন্ত্র আর নারী মুক্তির মিডিয়াবাজীর সাথে শাহবাগ মোড়ের নারীর ক্ষমতায়নের মিডিয়াবাজীর তেমন স্পষ্ট তফাত নেই, দুটোই বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে এখানে আসছে।
তৃতীয় পর্যবেক্ষণ হলো ইমরান ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অবস্থান রাখলেও তার কল্যানে আওয়ামী লীগের উদগ্রীব মুখের ভেতরে সে একটা জলন্ত ডিনামাইট ঢুকিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিপন্ন বিস্ময়ে দেখছে ডিনামাইটের সলতে জ্বলছে কিন্তু ইতঃকরনীয় ঠিক করতে পারছে না। এ সমাবেশের রাজনৈতিক চরিত্র নেই কিন্তু দাবীর মাধ্যমে বিএনপি এক ধরণের কুপোকাত অবস্থায় আছে, তাদের রাজনৈতিক মিত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা আন্দোলনের গরমে রুটি সেকছেন যেসব নেতা তারা হয়তো আন্দোলনের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ততটা স্পষ্ট ধারণা রাখছেন না কিংবা সাবধানে পর্যবেক্ষণ করছেন পরিস্থিতি।
বিএনপি এই ধাক্কায় একেবারে গোল্লায় যাচ্ছে, বিএনপিপন্থী কিংবা বিএনপির নেতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা রাজনীতিসচেতন মানুষেরা এ আন্দোলন সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে অনাগ্রহী। তবে একই সাথে এটা বিএনপিকে তারুণ্যের সমর্থনবঞ্চিত করছে। এটাই আওয়ামী লীগের আনন্দের উল্লাসের কারণ। বিএনপিকে তারুণ্যের বরশীতে বেধে আওয়ামী উল্লাস দেখে ভালো লাগছে, তারা সংশয়ে তাকিয়ে আছে তরুণদের দিকে। একই সাথে এটা টক শো বুদ্ধিজীবীদের উন্নাসিকতায় আঘাত করেছে। তাদের সকল অগভীর বিশ্লেষণ এখানে একেবারেই ঠুনকো কথার প্রাসাদ। তারুণ্যের চিৎকারে সে প্রাসাদ ভেঙে গেছে, তবে স্বীয় গাম্ভীর্যে তারা প্রাসাদপতনের আর্তনাদ না করে ভয়ে ভয়ে দেখছেন শাহবাগের আগুণ।
তবে একই সাথে এই অরাজনৈতিক সমাবেশের একটা ভিন্ন দিক আছে, অরাজনৈতিক বিধায় এর সাথে কোনো রাজনৈতিক দাবী সন্নিবেশিত নেই, বরং আন্দোলনটা এখনও পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধী বিরোধী। এখানে যারা আসছেন তারা ক্ষুব্ধ, কিন্তু এই জমায়েত তাদের ক্ষোভের প্রতিকার করছে না। তারা জানে তাদের প্রতিবাদ করতে হবে, নিত্যদিনের জীবনযাপনে তাদের মানসিক অস্থিরতার প্রতিকার এই দাবীদাওয়া নয় কিন্তু প্রতিবাদ হচ্ছে বলেই তারা এ দিকে উপস্থিত হচ্ছে। যতদিন এই সমাবেশ কিংবা গণজমায়েত কোনো স্পষ্ট দাবী পুরণের দিকে না ঝুঁকবে তত দিন এই ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদে উদগ্রীব মানুষেরা নিজেদের ভেতরের অস্পষ্ট ভাবনার সাথে এই দাবীর কোনো ঐক্য খুঁজতে যাবে না। দাবী স্পষ্ট উত্থাপিত হলে তারা হয়তো সংগ্রামী আবেগে এ দাবীর সাথে ভেসে যাবে কিংবা নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে এটা থেকে। তবে স্পষ্ট নির্দেশনা এবং ঘোষণা-ব্যতিরকে এই আন্দোলন আসলে জলন্ত ডিনামাইট।
ইমরান সে ডিনামাইট আওয়ামী লীগের উদগ্রীব মুখে এবং ঝোলায় ভরে দিয়েছে, তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো এই আগুণের নিয়ন্ত্রন এখন আর শাহবাগ মোড়ের প্রাথমিক কয়েকজন যুবকের হাতে নেই, তারা এই জমায়েত নিয়ন্ত্রনের কোনো ক্ষমতা রাখে না। সকল সম্ভবনা নিয়ে এ জমায়েত অন্ধ বেগে ছুড়ে যাওয়া ট্রেন, সেটা কোথায় কোন স্টেশনে থামবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ যদি গণ জমায়েতের পরিমাণ দেখে দাবী মেনে নেয় তাহলে এই যে সাধারণ মানুষ তাদের ভেতরের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না, তারা আসলে যে প্রতিবাদী আকাঙ্খা থেকে এখানে আসছে সেটা পুরণ হবে না, সুতরাং তারা আরও নতুন কোনো দাবীর প্রত্যাশা করবে। সেখানেই মূলত পরিবর্তনের সূচনা। ডমিনোর প্রথম ধাক্কাটা শাহবাগে লেগেছে, সেটার ধাক্কায় কোথায় কোন স্থাপনা ভেঙে যাবে সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আসলে গত কয়েকদিনে লোডশেডিং এর পরিমাণ কমেছে। সরকার এই গণজমায়েতের ক্ষুব্ধ মানুষদের অন্য কোনো অপ্রাপ্তি দিয়ে ক্ষুব্ধ করতে নারাজ।
সুমনের গানটা প্রাসঙ্গিক- প্রতিদিন সূর্য উঠে তোমায় দেখবে বলে, হে আমার আগুণ তুমি এবার ওঠো জ্বলে
আগুণ জ্বলে উঠেছে কিন্তু আগুণ আসলে কোথায় কি পোড়াবে কেউ জানে না, সকলের চোখের আর অন্তরের আগুণ এখানে মিশে আছে।