কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-১ কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-২ কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৩ কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৪ কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৫ কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৬
কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৭ কয়লা্পোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৮
আস্তে ধীরে পার্কার ম্যাথিউজের চেহারা থেকে গাম্ভীর্যের মুখোশটা যেন খসে পড়তে থাকে। অবরুদ্ধ মনের যাবতীয় কথাগুলো যেন জলপ্রপাতের মতো সুতীব্র বেগে বেরিয়ে আসতে চায় হুড়মুড় করে। কিন্তু মতিনের পক্ষে তার ভাষার পুরোভাব হজম করা কঠিন বলেই হয়তো নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করে প্রাণপণে। তবু যতটা সম্ভব পারস্পরিক ভাব বিনিময়ে পিছিয়ে থাকে না মতিন।
পার্কার ম্যাথিউজ ইংল্যান্ডের কোনো একটি গ্রামে তার স্ত্রী এলিন আর দুমাসের বাচ্চা হার্ডিকে রেখে এসেছিল প্রায় বছর দুয়েক আগে। এর মাঝে তার স্ত্রী মাত্র দুটো চিঠি দিয়েছে তাকে। জানিয়েছে, যে টাকা সে পাঠায় তাতে সংসারের অনেক খরচই বাকি থেকে যায়। সেই বাকি খরচ মেটাতে এলিন একটি আঙুরের খামারে কাজ নিয়েছে। হার্ডিকে তার দাদির কাছে রেখে কাজে যায় সে। সপ্তাহে পঁচাত্তর শিলং বেতন। সংসারে কোনো অভাব নেই এখন। সে চেষ্টা করছে বেশ কিছু পাউন্ড জমাতে পারলে ইন্ডিয়ার জাহাজে চড়বে শীঘ্রই। সে যেন কোনো দুশ্চিন্তা না করে। কোম্পানি যদি তাদের থাকার জায়গা দিতে পারে তাহলে হার্ডির দাদিকেও সঙ্গে নিয়ে আসবে।
কথাগুলো বলবার সময় পার্কারের চোখ মুখ বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। রাতের বেলা দুজন একই বাংলা ঘরে ঘুমের জন্য আগাম আয়োজন করলে পার্কার তার পকেট থেকে একটি মাঝারি আকারের টিনের বোতল বের করে এক চুমুক খেয়ে বলে, রাতের বেলা কী খাবে সে?
কী খাবে এ নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না মতিনের মাথায়। পার্কারের মুখে খাবারের কথা শুনেই যেন তার ক্ষুধাটা জেগে ওঠে। পার্কার আরো বলল যে, কাছে একটি বাজার আছে, ইচ্ছে করলে সে সেখান থেকে খাবার নিয়ে আসতে পারে। পার্কার তার এক পরিচিত দেশি ভাইয়ের কাছে গিয়ে খেয়ে আসবে। ইচ্ছে করলে মতিনও যেতে পারে।
মতিন এক সঙ্গে কেবল বাজার পর্যন্ত যেতে পারে। খাওয়ার ব্যাপারে বাজার থেকে পার্কারকে একাই যেতে হবে। সন্ধ্যার আলো থাকতে থাকতে তাই তারা দুজনেই বের হয়। দু রঙের দুজন মানুষ হলেও লোকজনের কৌতূহলী চোখ পড়ে মতিনের ওপর। তাদের যেন বিশ্বাস হতে চায় না যে, দেশীয় পোশাকের যুবকটি বাঙাল হতে পারে। তাই হয়তো তাদের চোখে খানিকটা ভয় আর সমীহ মিশে থাকে। বাজারে গিয়ে তেমন কিছুই চোখে পড়ে না তার। একটি মুদি দোকানে গিয়ে খানিকটা চিড়া আর গুড় নিয়ে ফিরে আসে দোকানীর গামছায় করে। পাশের পুকুর থেকে পানি আনবে ভাবতে ভাবতে কলসের সন্ধান করে সে আবার বাইরেও দৃষ্টি ঘোরায় ইতিউতি। বেশ খানিকটা দূরেই একটি ইঁদারা চোখে পড়ে তার। সন্ধ্যার আবছা আলোয় সে সেখানে এগিয়ে গিয়ে দেখে ইঁদারায় দড়ি বাঁধা থাকলেও পাত্রের অভাবে সেখান থেকে পানি তুলবার কোনো ব্যবস্থা নেই।
সে আবার ফিরে আসে ঘরে। কোণের দিকে একটি কলস দেখা গেলেও সেটা পানিশূন্য দেখে সে সেটা নিয়েই বের হয়। দড়িটাকে টেনেটুনে দেখে কেমন মজবুত আছে। সন্তুষ্ট হয়ে কলসিটাকে দড়ির সঙ্গে বেঁধে নিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গেই ইঁদারায় ফেলে। পানি তুলতে বেশ খানিকটা কসরৎ করতে হয় তাকে। পানি নিয়ে ফিরতে ফিরতে তার খানিকটা ভাবনা হয় পানিটার মান নিয়ে। আশপাশে কাউকে জিজ্ঞেস করবে এমন কাউকে চোখে পড়ে না তার।
চকমকির অভাবে লণ্ঠন জ্বালানো সম্ভব হয় না বলে অন্ধকারেই সে আবার বের হয় লণ্ঠন হাতে। স্টেশনের দিকে আগানোর সময় একজন পথিককে লণ্ঠন হাতে এগিয়ে আসতে দেখে তাকে বলল, জ্যাডা, আমার ল্যাণ্ডনডা ধরাইতাম আগুন দেওন যাইবোনি?
-যাইবো।
বলে, লোকটা থামে। সেই সঙ্গে পাশের একটি মরা গুল্ম জাতীয় গাছের শুকনো ডাল ভেঙে নিয়ে নিজেই লণ্ঠণ থেকে আগুন ধরিয়ে মতিনের হাতের লণ্ঠণ জ্বালিয়ে দিয়ে বলে, তোমারে নয়া নয়া লাগে, বাড়ি কই? আইছ কোনহানো?
-ইশটিশন আইছি। রেলগাড়ির কয়লাবরদারের চাকরি করি। আমার গ্যারাম সিদ্ধেশ্বরী।
-ও আইচ্ছা। আমি বনমালী দাশ। ইশটিশনের পরিদার। হাঙ্গে রাইত পরি দেই আর হাঙ্গে দিন ঘুমাই!
বলে, হাহা করে হাসে লোকটি। তারপর আবার বলে, আমরা তাইলে দুইজনেই কম্পানির মানু। রাইতে থাকবা কি কম্পানির বাংলাত?
-হ।
বলে, লণ্ঠণটা তুলে খানিকটা আলো বাড়িয়ে দেয় মতিন।
-খাইবা কই, কী খাইবা কোনো আঞ্জাম করছ?
-চিড়া আর মিডাই আনছি বাজারতে।
-আরে চিড়া খাইয়া থাকবা কয়দিন? আমার বাইত খাইবা অহন থাইক্যা। নাকি হিন্দুর খাওন হারাম?
বলেই, আরেক দফা হাসে বনমালী দাশ।
-না, জ্যাডা। আমি মিশনের সাবের কাছে পড়ালেহা করছি। আমার এত নাক নাক নাই!
-নিজেই কয়ডা সুরা-কালাম জানি, আর কিরম মোসলমান অইতারছি?
-আইচ্ছা ধর্মের কতা বাদ। কী নাম তোমার এইডা জিগাইলাম না।
-আবদুল মতিন।
-আইচ্ছা। লও আমার বাড়িডা দেইখ্যা আইবা। কেউ নাই আমার। একটা বিধবা মাইয়া আছে।
-নাহ। অহন যাইতাম না। খাইয়া ঘুমানের কাম।
-আরে ব্যাডা খাইয়া লইয়াই যাইস। টেরেইন ছাড়বো দিরং আছে। অন্দিকুন্দি কী করবি?
লোকটির রাগ বা অস্থিরতা প্রকাশ হয়ে পড়লেও সম্মত হয় না মতিন। প্রথম দিনেই অতটা খোলামেলা হওয়াটা তার ভালো লাগে না। বলে, আমরা দোনোজনেই যহন কম্পানির চাহুইরা, আওয়া যাওয়া কতাবার্তা তো অইতেই থাকবো। এত তরইয়া কী কাম।
-তাও কতা বেউজ্যা না!
বলে, কেমন কাশির ভঙ্গিতে হাসে বনমালী। তারপর বলে, আইচ্ছা যা, আমি মাইয়াডারে একবার দেইখ্যা আই আর চাইরডা খাইয়া আই।
-আইচ্ছা আইয়েন। বাংলাত আইয়েন কথা কওন যাইবো।
বনমালী তার বাড়ির দিকে যেতে থাকলে মতিন রেলের বাংলোর দিকে হাঁটে দ্রুত পায়ে। একা একাই যেন সে একটি মৃতপুরী দিয়ে হেঁটে চলেছে। বনমালী চলে যাবার পর আশপাশে আর কোনো মানুষ চোখে পড়েনি তার। এমন কি কোথাও একটি শিয়াল বা কুকুরের ডাকও শুনতে পায়নি। হাঁটতে হাঁটতে তার শরীরটা কেমন ছমছম করতে থাকে বলে বড় বড় পদক্ষেপে সে এগিয়ে চলে বাংলোর দিকে।
বনমালী দাশের সঙ্গে অদরকারি কথায় নিজের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না মতিন। তাই বাংলোতে ফিরেই সে চিড়া খাওয়াতে মনোযোগ দেয়। শুকনো চিড়া চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া ক্লান্তিকর। ঘরের ভেতর খুঁজে পেতে হাঁড়ি কিংবা সানকি দূরের কথা কিছুই পায় না। যতটা মনে পড়ে আশপাশে কোনো কলাগাছও তার চোখে পড়েছে বলে মনে করতে পারে না। চিড়া গুড় চিবাতে চিবাতে তার মনে হয় বনমালীর প্রস্তাবটাকে উপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হয়নি। এই প্রথম নিজেকে নির্বোধ আর অদূরদর্শী বলে মনে হলো তার কাছে। যেহেতু স্থানীয় মানুষ বনমালী তার ওপর বয়সের দিক দিয়ে প্রবীণ বলেই তার বাস্তব অভিজ্ঞতা বেশি। তার কথায় সম্মত হলে, আর কিছু না জুটুক একটি থালা নয়তো সানকিতে চিঁড়া ভিজিয়ে নিয়ে গুড় দিয়ে মাখিয়ে খেয়ে নিতে পারতো। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যে বড্ড আক্ষেপ হতে থাকে বলে শুকনো চিঁড়া চিবানোটা তার কাছে বিরক্তিকর মনে হয় আরো। গামছায় বাঁধা চিড়া আর কলাপাতায় মোড়ানো আঁখের গুড় এক পাশে সরিয়ে রেখে কলস থেকে পানি গড়িয়ে খেতে গিয়েও আরেকবার স্মরণ করে বনমালীকে। কোনো রকমে হাতের আঁজলায় পানি নিয়ে খেয়ে সে শুয়ে পড়ে। কিন্তু শুয়ে পড়তেই সে বুঝতে পারে চোখের পাতায় বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।
খড় বিছানো মেঝের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে কান পেতে রাখে বাইরে কোনো কিছুর শব্দ শুনতে পায় কিনা। বনমালী ফিরে আসবে বলেছিল, সে অপেক্ষাতেই হয়তো সে কান পেতে রাখে যাতে তার পায়ের বা হাতের লাঠি মাটিতে ফেলে এগিয়ে আসবার ঠকঠক শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু ঝিঁঝিঁ পোকার নিরবচ্ছিন্ন ডাক ছাড়া ভিন্ন কোনো শব্দ তার কানের পর্দায় ধ্বনিত হয় না বেশ কিছুক্ষণ। তা ছাড়া অন্ধকার ঘর বলে তেলাপোকা আর ইঁদুরের ছুটোছুটিও তার শান্তি ভঙ্গের জন্য বাড়তি উপদ্রব বলে চিহ্নিত হয়। লণ্ঠণের আলো বাড়িয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর ইঁদুর আর তেলাপোকার উৎস সন্ধানে তৎপর হলেও তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারে না সে।
হতাশ হয়ে ফের লণ্ঠনের আলো কমিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লে সে টের পায় পুরো শরীর কেমন খসখসে হয়ে আছে। বিগত কয়েক ঘণ্টার কয়লা পোড়া আগুনের উত্তাপ জনিত ঘাম আর কয়লার গুঁড়ো বা ছাই ঘামের সঙ্গে মিশে গিয়ে দেহের চামড়া চড়চড় করছে। আর এ জন্যেই ভালো করে গোসল করা দরকার ছিল। কিন্তু পরনের লুঙ্গী আর কোর্তাটি ছাড়া বাড়তি কিছুই তার সঙ্গে নেই। চিড়ার দোকান থেকে নিয়ে আসা গামছাটিও সকাল সকাল ফেরত দিয়ে আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসতে হয়েছে। আগে থেকে সব কিছু জানা থাকলে এমন একটা সমস্যায় পড়তে হতো না তাকে।
একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবছিল কী এমন একটি কথা বলতে চেয়েছিল কুট্টি যা পরে আর চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে বের করতে পারেনি। কুট্টি তো আগে বেশ খোলামেলা ছিল কথার দিক দিয়ে। আকারে ইঙ্গিতে বলার চেয়ে স্পষ্ট বলাটাই সে পছন্দ করতো, কিন্তু বিয়ে হয়ে গেল বলেই কি হঠাৎ করে বদলে গেল সে? ভেবে ভেবে কোনো থই পায় না সে। তখনই কিছুটা দূর থেকে ভেসে আসে, মতিন ঘুমাইছস?
বনমালী দাশের কণ্ঠ। মতিন উঠে গিয়ে দরজা মেলে বের হয়ে বলে, না জ্যাডা, শইল্যের চড়চড়ানির জ্বালায় ঘুম নাই।
বনমালী আরো এগিয়ে এসে হাতের লণ্ঠণটা উঁচিয়ে ধরে মতিনের মুখ দেখে হয়তো প্রকৃত অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করে। বলে, শইল্যের আবার কী অইল?
-এই যে ইঞ্জিনের ভিতরে আছিলাম, ঘাম, কয়লার গুঁড়া, ছালি সব মিল্যা শইলডা কিরম জানি করতাছে। গোসল করতারলে মনে অয় তদিল অইতাম।
-আমার বাইত ল। পুইরের জল দিয়া সান করবি।
-লগে কিছু নাই। না গামছা, না লুঙ্গী।
-সান কইরা আমার পুরান একটা ধুতি পিন্দিস।
-তোমার আবার জাত-পাতের কিছু অইবনি?
-আরে জাত-পাত হালাইয়া থো। নিজে বাঁচলে যেরুম বাপের নাম, খাইয়া বাঁচলে জাত-পাত!
মতিনের মনে হলো বনমালী হিন্দু হলেও স্যাকরাদের মতন অতটা বাছ-বিচার করা লোক নয়। তার ওপর এখনও লোকটার কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। সে বলল, তাইলে আরেকটা কথা আছে।
-ক হুনি।
-একটা থালি নাইলে মাডির বাসন দিবা। দিবা একটা পানি খাওনের কিছু।
-আরে বলদা এর লাইগ্যাই কইসলাম আমার বাইত আইয়া খাইস! এমনে খাইতে শরমাইলে কয়দিন বাদে বাদে বাজার হাট কইরা আনিস, নাইলে দুই চাইর আনা দিস।
প্রস্তাবটা খুব খারাপ মনে হলো না মতিনের কাছে। বলল, পরেরডা পরে। আগে বাইত লও। আমার গোসল না করলেই না। বলে, মতিন ঘরের ভেতর গিয়ে লণ্ঠণ আর গামছায় বাঁধা চিঁড়া-গুড় হাতে ফিরে আসে। তারপর দরজাটা টেনে ওপরের দিকে শেকলটা লাগিয়ে দেয়।
বনমালী হাঁটতে হাঁটতে বলল, মাইয়াডা বাইত কোট্টে কোট্টে থাহে। রাইতে কয়বার যে যাইয়া পরি দেই। কওন যায় না বিপদ-আপদের কথা। আমার লগে নিজের জাতের কোনো সমন্দ নাই। রেলের পরিদার অইছি দেইখ্যা তাগো হগলতের মান-জাত গেছেগা বলে। কইছে তারার সমাজে না জানি যাই, তারার মন্দির, পূজা-পার্বণ আমার লাইগ্যা নিষেধ।
নিজের সমাজে একঘরে বনমালী। তাই হয়তো মনের দুঃখে জাত-পাতের অহংকার ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। নিজের জাতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে না পারলে বাধ্য হয়েই অন্য জাতের সংস্পর্শে আসতে হয়। তাহলে তো বনমালীর আত্মীয়-স্বজন থেকেও কেউ নেই। বিপদ-আপদে কেউ তাকে সাহায্য করা দূরে থাক আরো নিত্য-নতুন সমস্যা তৈরি করতে জোট বাঁধবে।
বনমালীর বাড়িটা বেশি দূরে নয়। একটি আলগা বাড়ি মনে হলো। কাছাকাছি কোনো ঘর দেখতে পেলো না। শন দিয়ে ছাওয়া একটি মাটির ঘর। ঘরের সামনে আরেকটি বাড়তি চাল জুড়ে দিয়ে বারান্দার মত করে মাটির হাত দুয়েক উঁচু দেয়াল। চালের সঙ্গে বাঁশের ফালি দিয়ে ঘন করে খুঁটি লাগানো। যার ফলে জানালা আর বেড়ার কাজ একটা ব্যবস্থাতেই সমাধান হয়ে গেছে।
ঘরের সামনে গিয়ে বনমালী হাতের লাঠিটা দিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল, মিনতি, মিনতি মা! ঘুমাইয়া লাইসসনি?
কিছুক্ষণ পর দরজা খুললে জ্বলন্ত কুপি হাতে মাথায় এলোমেলো চুলের একটি নারীমুখ চোখে পড়ে মতিনের। দেখতে হয়তো শ্যামলা নারীটি মমতাজের চেয়ে বছর কয়েকের বড় হবে বলেই তার ধারণা। পরনে সাদা থান।
দরজায় তার বাবাকে দেখতে পেলেও তার পেছনে অন্য কাউকে লণ্ঠণ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ত্রস্তে মাথায় আঁচল টানে মিনতি। খানিকটা নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, কারে লইয়া আইলা ইডা?
-কম্পানির। ইঞ্জিলের কয়লা দেওনের কাম করে। মাগো, আমার ছিঁড়া ধুতিডা দে চাই! পোলাডা সান করবো লগে কিচ্ছু আনছে না।
বনমালীর কথা শেষ হতেই দরজা থেকে কুপির আলো সরে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলো হাতে ফিরে আসে মিনতি। বাবার দিকে ধুতি বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিসানো স্বরে বলল, ভাত কইলাম নাই!
-ভাতের কাম নাই।
বলে, হাসল বনমালী। হাসতে হাসতেই বলে, একটা মাডির বাসন আর তর নানার মাডির বদনাডা জল ভইরা দুয়ারের বাইরে আইন্যা থুইস।
-কী করবা এত রাইতে?
-কাইল হুনিস। নে দুয়ার লাগাইয়া দে। আমরা যাই।
বনমালীর পেছন পেছন পুকুরের উদ্দেশ্যেই হয়তো হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছন ফিরে তাকায় মতিন। দরজাটা তখনও বন্ধ করে দেয়নি মিনতি। খানিকটা ফাঁক রেখে হয়তো তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে সে। দরজার ফাঁকে আলো আর ছায়া দেখে এমনটাই মনে হয় তার।
(আর একটা পর্ব বাকি আছে)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৩৯