কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-১
কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-২
কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-৩
কোনো কারণে খুব ক্ষেপে আছে আজগর। মমতাজ এমন কি শরবতের নেসার সঙ্গেও বেশ কঠিন কঠিন কথা বলছে কদিন ধরে। মমতাজ এরই মধ্যে বার কয়েক বাপের বাড়ি চলে যাবার কথা ঘোষণা করেছে। মতিন গাই দুটোকে গোসল দিয়ে গোয়ালের বাইরে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে কাঁচা ঘাস খেতে দিয়ে বাছুর দুটোকে দুধ খাওয়ানোর ব্যস্ততার ফাঁকেই শুনতে পেয়েছিল অল্প-কিছু কথাবার্তা। কিন্তু কী নিয়ে তাদের মাঝে এ ধরণের কথাবার্তা হচ্ছে তা উদ্ধারে তেমন কোনো আগ্রহ তৈরি হয় না তার ভেতর।
এমনিতে তার ওপর সবাই খবরদারি করতে চায় অথচ সংসার বিষয়ে তারও যে দু একটা মতামত থাকতে পারে তা নিয়ে যেন কারো মাথা ব্যথা নেই। মাথা ব্যথা তখনই হয় কাজগুলো যখন আজগরের মনোমতো হয় না। তবে একথা সে আরো আগেই বুঝতে পেরেছে যে, আজগর তার ওপর সময়ে অসময়ে অনেক অন্যায্য দায় চাপিয়ে দিলেও পৈত্রিক সম্পদে তার অধিকারটা একচেটিয়া নয়। ইচ্ছে হলেই যা খুশি করে ফেলতে পারে না। টাকা-পয়সা বা সম্পদের ওপর যাদের দৃষ্টি থাকে তাদের ভাবনা-চিন্তাগুলোও তার বাইরে যেতে পারে না কখনও। মনের দিক দিয়ে উদার হওয়াটা তাদের ধাতে থাকে না। আজগর আর তার বউটাও ঠিক একই ধরনের মানসিকতার বলে তাদের সঙ্গে তার মিল হবার সম্ভাবনা নেই কোনো দিক দিয়েই। খুব দায়ে না পড়লে সে ও দুজনের মুখোমুখি হতে চায় না।
কিন্তু এক এলাকায় এক বাড়িতে বসবাস করতে গেলে কোনো না কোনো ভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়ে যায়ই। আর সে সুযোগটাই নিতে চায় মমতাজ। কখনও আকারে ইঙ্গিতে বলে, কয়দিন বাদে সাব অইয়া আরেক মেম বিয়া করলে কি আর আমরার কতা কারো মনে থাকবো? অহনই যহন কারো চোহে পড়ি না!
মতিন সে কথার উত্তরে কিছু বলতে আগ্রহ বোধ করে না। ছোট একটি কথা থেকে কোন কথার জন্ম হবে তার নিশ্চয়তা নেই। সেদিন অল্প একটি কথা থেকেই মমতাজ বলে উঠেছিল, জুত না লাগলে ভিন্ন অইয়া গেলেগাই পারেন। হুদাহুদি আমারে দোষ দেওনের কোন কাম?
কথাটা শুনতে পেয়েছিলেন শরবতের নেসা। মমতাজের কথার সূত্র ধরে বলে উঠেছিলেন, তাইলে আর তোমারে আনলাম কোন কামে? আমরা মায়-পুতেগো ভালার লাইগ্যা তোমারে আইন্যা যদি কতাই হুনন লাগে, তো মানষ্যে পুত বিয়া করায় কোন দিনের লাইগ্যা?
এ নিয়েই আসলে সূত্রপাত হয়েছিল, মাতা-পুত্রে আর বউ-শাশুড়িতে কথার মার-প্যাঁচের জটিলতর শীতল লড়াই। তারপর থেকে মমতাজ প্রায়ই থম মেরে থাকে। রান্না-বান্না শেষ করে পুকুর ঘাটে গিয়ে পানিতে নেমে বসে থাকে। কখনও আজগর এ নিয়ে চেঁচামেচিও করে। কিন্তু মমতাজ নির্বিকার। মার খেয়েও তার স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি।
মমতাজ বউ হয়ে আসবার আগে তাদের ঘরে কোনো একটা বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে বা মাতা-পুত্রে কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে বাক-বিতণ্ডার মতো ঘটনা হয়েছে এমনটি কেউ বলতে পারবে না। তবে আজকাল মাঝে মধ্যে বাড়ির অন্যান্য চাচি-জেঠি বা তাদের কন্যাদের কারো কারো মুখে শোনা যায়, বউডা বাইত আইয়া পাড়া দিয়া সারলো না আর শুরু অইছে অশান্তি!
চৈত্রের গরমের দিন বেজায় ঘাম হয় মতিনের। জামা গায়ে দিলে মনে হয় দেহের বহিরাংশ জ্বলছে। তাই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে খালি গায়ে থাকতে। কিন্তু এমনটা খুব অপছন্দ প্যাট্রিক জনসনের। কপালে ভাঁজ ফেলে বলেছিলেন যে, এমন বর্বরের মতো থাকতেই যদি সে পছন্দ করে তাহলে বিদ্যা অর্জনের কোন সুফলটা সে পাবে?
সে বোঝে সবই। তাই বিনা প্রতিবাদে জামাটা গায়ে দিয়ে বসেছিল। অল্প কিছুক্ষণের ভেতরই তার শরীর ঘেমে গিয়ে ভিজে উঠেছিল গায়ের জামা। নিজে নিজেই টের পাচ্ছিল ঘামের উৎকট গন্ধ। পাশে বসে থাকা কুটিলার ইয়াসিন তা দেখে মুখ টিপে হাসলেও কিছু বলছিল না। এমনিতে তার সঙ্গে খুব বেশিক্ষণ আলাপ হয় না। প্রয়োজনও পড়ে না তেমন। কিন্তু এখনকার হাসিটা তাকে ভেতরে ভেতরে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। একবার ভেবেছিল জিজ্ঞেস করবে কিনা এ ব্যাপারে। তখনই প্যাট্রিক জনসন সাহেব তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠেছিল, মাটিন! হোয়াট হ্যাপেন্ড?
হঠাৎ জিজ্ঞাসায় খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও তা প্রকাশ করে না মতিন। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কিছু না স্যার! এভরিথিং অলরাইট!
কথাগুলো বললেও সায়েব কেমন সরু দৃষ্টিতে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়েছিলেন তার প্রতি। কিন্তু এর পেছনে ঘটনাটা কী হতে পারে কিছুই ভেবে উঠতে পারে না। কেমন বোকাটে চেহারা করে দৃষ্টিতে নীরব জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে জনসন সায়েবের দিকে।
- আর ইউ গোয়িং অর কামিং?
হেয়ালী তো কখনও করে না সাহেব। তাহলে নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। ব্যাপারটা ধরতে না পেরে সে বলে উঠল, সাব, নট আণ্ডাস্ট্যান্ড।
-বল আই কুডনট আন্ডাস্ট্যান্ড!
-রিপিট ইউর কোশ্চেন, প্লিজ!
-লুক অ্যাট ইওর সার্ট!
বলেই হাহা করে হেসে উঠলেন তিনি।
প্রথমে নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে না পারলেও আস্তিনের সেলাইয়ের ওপর চোখ পড়তেই টের পেয়ে যায় মূল ঘটনা। আর তা বুঝতে পেরে নিজেও হেসে ওঠে মতিন।
প্যাট্রিক জনসন বললেন, স্যাটারডে হামি ঠাকিবে না। ডেভিড লুইস তোমাডের লেসন ডিবে।
মতিনের ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করে, কই যাইবা সাব? ডেভিড লুইসের কতা কিচ্ছু বুজি না! কিন্তু তার আর বলা হয়ে ওঠে না। হঠাৎ দরজার কাছে আজগরকে দেখতে পেয়ে তার পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অজানা কোনো এক অশনি সংকেত বেজে ওঠে মনের ভেতর। সে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভাই, তুই এহানো, বাইত কিছু অইছে?
-মার শ্বাস কষ্ট শুরু অইছে। অষুদ নিতাম আইছি।
দু ভাইয়ের কথা শুনছিলেন প্যাট্রিক জনসন। তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে আজগরকে বললেন, জাস্ট এ মিনিট! টোমার মাকে হামি অষুড ডিটেসি।
প্যাট্রিক সায়েব খানিকটা দ্রুত পায়ে নিজের ঘরের দিকে হেঁটে গেলেন। কিন্তু তার ফিরে আসবার জন্য অপেক্ষার ধৈর্য ছিল না। এমন কি আজগরকেও কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না মতিন। হঠাৎ ক্লাস থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকেই হয়তো দৌড়তে আরম্ভ করল ঊর্ধ্বশ্বাসে।
মতিন বাড়ির ভেতর ঢুকেই চিৎকার করে উঠল, মা, মাগো! ওই মা!
হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরের ভেতর ঢুকবার আগেই মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, কীরে পুত, অইছে কী তর?
স্বাভাবিক কণ্ঠেই শরবতের নেসা কথা বলেন ছেলের সঙ্গে। আর তা দেখে বিভ্রান্ত মতিন বলে উঠল, ওয়াট অ্যাপেন মা? ভাই যে কইল তোমার শ্বাস কষ্ট?
হাসি মুখে তিনি জবাব দিলেন, সাইরা গেছেগা!
-ভাইরে দেখলাম বিলাতি সাবের কাছে ওষুধ চাইলো।
-উট্টানি পাইলাম শিশাডাত, হেইডাই পানি মিলাইয়া খাইছি।
-পানি দেও!
বলেই, মেঝেতে একটি পিঁড়ি টেনে বসে শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে দুহাত পেছনের দিকে ঠেস দিয়ে হা হয়ে থাকে।
শরবতের নেসা মতিনের অবস্থা দেখে বললেন, তুই এইরম হোফাইতাসত কা?
-কুত্তার দৌড়ানি খাইসেনি?
পেছন থেকে হঠাৎ বলে উঠেই ফিক ফিক করে হাসতে থাকে মমতাজ।
সোজা হয়ে বসে মায়ের হাত থেকে কাঁসার বদনিটা নিয়ে কানায় মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক পানি খেয়ে হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মোছে মতিন। তারপর বদনিটা সামনে রেখে মমতাজের উদ্দেশ্যে কিছু বলতেই হয়তো মুখ তুলে সে। কিন্তু তাকে দেখতে না পেয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে, ভাইয়েরে দেইখ্যাই আমার নাইয়া মোচড়া দিছে। যহন কইলো তোমার শ্বাস কষ্ট শুরু অইছে, হুইন্যা আমার আর হুঁশ নাই, দিলাম চালি!
পুত্রের কথা শুনে শরবতের নেসা হাসতে হাসতে চোখ মোছেন। তারপর বলেন, বাইচ্যা থাক পুত। বিয়া করলে মার লাইগ্যা এমন টান থাহেনি আল্লায় জানে! আজগররে থুইয়া ত বাইর-ঘরও করতাম পারছি না ভালা মতন!
-কোনোগুল দিয়া আপনের বড় পুতের টুট-ফাইট পাইছেননি?
মমতাজের কথা ভেসে আসে আবার।
মতিন বলে ওঠে, তুমি আইলা পশশু! কী দেখছ আর কী জানবা? পুটপুট কইরা ত সব কথাতই জব দিয়ালাও!
-জব দেই ভালা করি। আমার কতা মজা না লাগলে জোরাইয়া লইবাই না আরেকজন!
মতিন কিছু বলবার আগেই শরবতের নেসা বলে উঠলেন, বউ, ইডা কইলি কী তুই? কোন কথার ভিতরে কোন কথা টাইন্যা আনলি?
-হুনলেন না আপনের ছোড পুতের কথাডা?
জবাব দিয়েই মমতাজ মাটির কলস হাতে নিয়ে দুপদাপ পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে যায় মতিনের পাশ দিয়ে।
-দেখলানি মা, তোমার পুতের বউয়ের কাণ্ডুডা?
-থাউক পুত, দিন যাইতো দে! এমন ছুডুখাডু কথা লইয়া অশান্তি লাগাইস না।
তারপর তিনি বদনিটা তুলে নিয়ে বললেন, একটা কাম করিসচাইন পুত!
-কী কাম?
বলেই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মতিন।
-গাও-গোসল দিয়া খাইয়া লইয়া গুণবতী যাইতারবিনি?
-মামুগ বাইত কী অইছে?
-কিছু না। হাশেমরে কইস একবার আইতো।
-আইচ্ছা।
বলে, সে উঠে পড়ে গা থেকে ঘামে ভেজা জামাটা খুলে ঝাঁপের বেড়ায় ঝুলিয়ে দিয়ে লুঙ্গীটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পুকুর ঘাটের দিকে যেতে যেতে তার মনে পড়ে হোসেন মামার মেয়ে কুট্টির কথা। আর তার কথা মনে পড়তেই গুণবতী যাবার ইচ্ছেটা প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। কুট্টি অনেক পাজী। তাকে দেখলেই নানা ভাবে বিরক্ত করে জান তেজপাতা করে ফেলে। অতটুকু একটা মেয়ে অথচ মাথা ভর্তি হাজারো শয়তানি বুদ্ধি। কুট্টিকে উদ্দেশ্য করেই যেন সে বিড়বিড় করে বলে, হেই দিন আর নাই। এইবার কিছু কইরা চাইস...!
আপনমনে বলতে বলতে সে গাছের গুঁড়ি আর বাঁশের খুঁটি দিয়ে বানানো ঘাটে হাতের লুঙ্গীটা রেখে নেমে পড়ে পুকুরের পানিতে।
(চলবে)
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন
=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=
©কাজী ফাতেমা ছবি
মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।
হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।
ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে
ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি
গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন
জানা আপুর আপডেট
জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।
বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন