somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিরাগ বা অনুরাগ

২৩ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাপ নাম রেখেছিল গঞ্জে আলি। কিন্তু কালক্রমে কখন যে গঞ্জালি হয়ে গেছে বলতে পারে না সে। এমন কি জমির পরচা খতিয়ান, জাতীয় পরিচয়পত্রেও নাম লেখা হয়েছে গঞ্জালি। অন্যান্যদের তুলনায় তার বসতবাড়ি মোটামুটি উন্নত হলেও ঘরের ভেতরটা খুব শান্তি দায়ক মনে হয় না। বাইরে বাইরে যখন সময় কাটায় তখনই খানিকটা ভালো লাগে তার। ঘরে ফিরে এলেই শুরু হয় অস্বস্তি। ঘরের অশান্তি বলতে খুব বড় কিছু না হলেও বা স্ত্রী মনি বেগমের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক কোনো সংকট না হলেও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অনর্থক চিৎকার-চেঁচামেচি করতে মনি বেগমের কোনো রকম ক্লান্তি নেই যেন। তা ছাড়া মুরগির কড়কড়ানি, বাচ্চাদের হৈ-হল্লায় ঘরটা যেন নরক হয়ে থাকে।

জ্যৈষ্ঠ মাসের বিশ্রী গরমে সব সময় গঞ্জালির শরীর থেকে চিটচিটে ঘাম বের হয়। তাই খাবারের সময়টা ছাড়া পারতপক্ষে ঘরে আসে
না। কাঁধের গামছাটা দিয়ে শরীর মুছতে গিয়ে সে টের পায় যে, পুরো শরীরে ঘামাচির মতো ছোট ছোট দানা বের হয়েছে। গামছার ঘষায় সেগুলো ছড়ে গিয়ে প্রচণ্ড জ্বলতে আরম্ভ করেছে। তখনই হঠাৎ জীবনটাকে তার কাছে অসহনীয় মনে হয়। মনে হয় এ জীবনের ভার যেন দিনকে দিন কুঁজো করে দিচ্ছে তাকে। বাকি জীবন কী করে সে এগিয়ে নেবে? যদিও ঘর ভাড়া আর ব্যাঙ্কে জমানো টাকার ইন্টারেস্ট মিলিয়ে ভালো একটা আয়ই তার ঘরে আসে। তবু কেন যেন জীবনটাকে তার কাছে বিশ্রী বলেই মনে হয়। এ পর্যন্ত সে কী না করেছে এমন একটা গণ্ডী থেকে বের হয়ে আসতে, তবু যেন তার মুক্তি ঘটবার সম্ভাবনা উঁকি দেয়নি একটিবারের জন্যেও।

সকালের দিকে বের হয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে বসে অন্তত দশ কাপ চা গিলে আর গোটা বিশেক বিড়ি টেনে ফিরে এসে দেখতে পায় একটি সাদা মুরগি বিছানার ওপর হাঁটাহাঁটি করছে। বালিশের ওপর ঠিক যেখানটাতে সে মাথা রেখে প্রতিদিন ঘুমায় ঠিক সে অংশটাতে কালচে কিছু একটা লেগে শুকিয়ে আছে। হয়তো মুরগির বিষ্ঠা। গঞ্জালির মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় ঘরের সব কিছু ভেঙে চুড়ে বাইরে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

জীবন যাপনে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে আরম্ভ করবার ফলে অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঘরের শূন্য অংশগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল বলে ঘরটাকে একটি গুদামের চেয়ে উন্নত কিছু মনে হচ্ছিল না তার কাছে। অথচ যখন সে দৈনিক মজুরিতে জুটমিলে কাজ করত ঘরটাকে যেমন প্রশান্তি দায়ক মনে হতো তেমনই মনি বেগমকেও বেশ স্নিগ্ধ আর নরম-সরম মনে হতো। আজকাল মনি বেগমের পান খাওয়া কালচে ঠোঁট আর গায়ে ভারী অলঙ্কারের উৎপাতের সঙ্গে সঙ্গে কোঁচকানো কপাল আর ভারিক্কী চেহারা দেখতে দেখতে ইদানীং বেশ ক্লান্ত বোধ করে সে। কবে যে শেষবার স্ত্রীর মুখে সত্যিকার হাসি দেখেছিল সে কথা আজকাল মনে করতে পারে না। মাঝে মধ্যে বাইরে বা আত্মীয়-স্বজনের সামনে মনি বেগমকে হাসতে দেখা গেলেও তা মেকি বলেই মনে হয় গঞ্জালির।

রান্নাঘরে মনি বেগম কিছু একটা করছিল। দরজার কাছে মনি বেগমের খালাতো বোন হাজেরার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। কিন্তু সে দৃষ্টি ভালো লাগে না তার। ভালো লাগে না পোশাক-আশাকও। একটা মানুষের শরীরে কতটুকু চাহিদা থাকতে পারে? যৌনতা ছাড়া কি দেহের আর কোনো নান্দনিক ব্যবহার নেই? অথচ মধ্য বয়সে এসে নারী বা পুরুষ এদিকটায় আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে।

মনি বেগম হয়তো রান্নাঘর থেকেই বের হয়ে আসে। হাতে ধরা একটি বাটিতে ভাজাভুজি জাতীয় কিছু। কিন্তু হঠাৎ যে তার কী হয়, বিছানার ওপর মুরগিটাকে হাঁটতে দেখেই হয়তো পায়ের কাছে পড়ে থাকা ঝাড়ুটাকে পায়ের পাতা দিয়ে বিছানার দিকে ছুঁড়ে মারে। মুরগিটা ককর ককর কো করতে করতে উড়াল দিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ তার হাতে ধরা বাটিটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে উলটে যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় বাটির ভাজাভুজি জাতীয় বস্তুটি।

গঞ্জালির চোখ পড়ে বিছানায় বালিশের ওপর। ঝাঁটাটা বালিশে লেগে থাকা মুরগির বিষ্ঠা বা অন্য কিছুটাকে আরো ছড়িয়ে দিয়ে গেছে। গঞ্জালির মনে হয় বস্তুটা যেন তার গালের সঙ্গেই লেপটে আছে। সে অবস্থাতেই গঞ্জালিকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে মনি বেগম। সেই সঙ্গে কী বুঝে হয়তো রেগে উঠেই চিৎকার করে বলে, মরার ব্যাডাইত, মাগি ছাড়া বোজে না কোনোতান!

মনি বেগমের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে গঞ্জালির মস্তিষ্কের ভেতর হালকা বাও কুড়ানির মতো কিছু একটা পাক খায় হঠাৎ। সেটা রাগ না অভিমান বুঝতে পারে না। কেমন একটা ঘোরের ভেতর হারিয়ে যেতে থাকে সে। চোখ তুলে মনি বেগমকে দেখতে পায় না সে। ঘর থেকে বের হয়ে মহল্লার রাস্তায় উঠে আসে। মহল্লার একমাত্র চায়ের দোকান যেখানে সে প্রতিদিন সকাল থেকে প্রায় দুপুর অবধি সময়টা কাটায়, সে দোকানটিকে পাশ কাটিয়ে আরো এগিয়ে যেতে থাকে সে। পেছন থেকে লোকমান হাজি কিছু একটা বললেও বুঝতে পারে না সে। এমন কি পুনরাবৃত্তির জন্যে পিছু ফিরেও তাকায় না।

হাঁটতে হাঁটতে সে রেল লাইনটার পাশে এসে দাঁড়ায়। দূর থেকে নীলফামারী এক্সপ্রেসের ঝকঝক শব্দ ভেসে আসে। পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। দেখতে দেখতে ট্রেনটি তার সামনে দিয়ে চলে যেতে থাকে। বিভিন্ন বগির জানালা দিয়ে বের করে রাখা নানা বয়সের নারী পুরুষের মুখ দেখে সে। ট্রেনের গতির সঙ্গে ছুটে যাওয়ার অভিপ্রায়েই হয়তো লাইনের পাশে ছোটখাটো গুল্ম ঝোপ-ঝাড় দৌড় দেবার ভঙ্গিতে নুয়ে থাকে।

গঞ্জালি অপেক্ষা করে নীলফামারী এক্সপ্রেস কখন তাকে অতিক্রম করে যাবে। শেষ বগিটি তাকে অতিক্রম করে গেলে সে লাইন পেরিয়ে সামনের দিকে যায়। একটি শূন্য পানির বোতল লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অস্পষ্ট একটি শব্দে ফের ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় হলুদ রঙের কিম্ভূত আকৃতির একটি যান আসছে। জামাত-শিবিরের হরতাল আর নাশকতার সময় জায়গায় জায়গায় লাইন উপড়ে ফেলার সংবাদের সঙ্গে এ যানটির সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ।

গঞ্জালি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে এগিয়ে আসতে থাকা হলুদ রঙের যানটির দিকে। খুব কাছা কাছি আসতেই তার ইচ্ছে হয় লাইনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে ফুলমনির কথা। বছর খানেক আগে যাকে কথা দিয়েছিল মনি বেগমে অনাসক্তি এলে তার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেবে সে।

হলুদ যানটিকে পেছনে ফেলে সে আরো এগিয়ে যেতে থাকে। এবড়ো-থেবড়ো পথে সামনের দুটো গ্রাম পার হলেই এবারতপুর। যেখানে বাপের বাড়িতে অপেক্ষায় আছে ফুলমনি অথবা নতুন সংসার পেতেছে অনেক আগেই।

(ফোটো- গুগোল থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৩৭
১০টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×